২০০২ সালে যখন জাতীয় নির্বাচন হয় তখন আমি মাত্র ১২ বছর বয়সের যুবক। ভোটের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখছি সবাই ভোট দিতে ভোট কেন্দ্রে যাচ্ছে। আমার মনের মধ্যে বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে। ইস! আমি যদি ভোটার হতাম তাহলে অন্য সবার মতো ভোট দিতে পারতাম। আহ! কখন আমি ভোটার হয়ে ভোট দিতে যাবো। আমার ভোট আমি দিবো, যাকে খুশি তাকে দিবো।
আম্মুকে বললাম কবে আমি ভোট দিবো। প্রতিউত্তরে আম্মু বললো ভোটার না হলে যে ভোট কেন্দ্রের আশেপাশেও যাওয়া যায়না। যাই হোক! স্বপ্ন ৫ বছর পরে হয়তোবা ভোটার হয়ে ভোট দিতে যাবো। ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ভোটার তালিকা হালনাগাদের সময় প্রথম ভোটার হয়েছিলাম ২০০৬ সালে। মাত্র ১৬ বছর বয়সে। তখন ছিলাম লম্বা টগবগে যুবক। বয়স ১৮ না হলেও অনেকটা লম্বার কারণে ফরম পূরণ করে ভোটার হয়ে গেলাম।
তখনকার সময়ে যাদেরকে ভোটারের ফরম পূরণের দায়িত্ব দেওয়া হতো তারা সঠিক বয়স ঠিকভাবে বিবেচনা না করে একটু লম্বা হলে আর চেহারার দিকে তাকিয়ে অপ্রাপ্ত বয়স্ক যুবকদেরকে ভোটার বানিয়ে ভোট দেওয়ার জন্য একটা স্লিপ ধরিয়ে দিতো। ঠিক আমার বেলাও একইটা হয়েছে।
আমি পড়াশুনার সুবাদে থাকতাম দাগনভূঁঞার ইয়াকুবপুর নানুবাড়িতে। ভোটার ফরম পূরণের দায়িত্বে ছিলো ঐ এলাকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক। তিনি আমার সব কিছু পূরণ করে একটা স্লিপ দিয়ে বলেন ভোটের দিন এই স্লিপ নিয়ে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিবে। স্যারকে একটা ধন্যবাদ দিলাম।
এবার আমি খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলাম। অনেকদিনের ভোট দেওয়ার স্বপ্ন এবার পূরণ হতে যাচ্ছে। যাক! এবছর আমাকে ভোটকেন্দ্রে যেতে কেউ আর আটকাতে পারবেনা। ইচ্ছেমত পছন্দের মানুষটিকে ভোট দিতে পারবো। সব জল্পনা-কল্পনা শেষে দেশে নির্বাচনের আগে শুরু হয়ে গেলো জরুরি অবস্থা। এভাবেই কেটে গেলো আরো দুটি বছর। এরমধ্যে আগেকার ভোটার তালিকা বাদ দিয়ে ভোটার আইডি কার্ডের প্রচলন শুরু হলো।
২০০৮ সালে গ্রামের বাড়ি ছাগলনাইয়ায় এসে ভোটার আইডি কার্ড বানানোর জন্য সবকিছু পূরণ করার পর একদিন পৌরসভা কার্যালয়ে ডাক এলো, যারা ভোটার হবে তাদের স্বাক্ষর ও ছবি তুলবে নির্বাচন অফিসের কর্মকর্তারা। এরপর ছবি তুললাম স্বাক্ষর ও দিয়ে আসার সময় তারা একটা স্লিপ দিয়ে বললো কার্ড নির্বাচন অফিসে এলে স্লিপটা দিয়ে নিয়ে যাবেন। দেখতে দেখতে এক বছর কেটে গেলো। কয়েকবার খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম ভোটার আইডি কার্ড আসেনি। কখন আসবে তাও কর্মকর্তারা জানেনা।
২০০৯ সালের শেষাংশে শুরু হতে যাচ্ছে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ভোটের মাস খানেক আগে উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়ে গিয়ে ভোট দেওয়া সংক্রান্ত বিষয়ে কথা বলতেই তারা জানালো যারা এই ভোটার আইডি কার্ড পেয়েছে শুধু তারাই ভোট দিতে পারবেন। এবার অনেকটা হতাশা মনে ফিরে এলাম আপন নীড়ে। রাতের বেলা ঘরে বেলকনির একপাশে নীরবে বসে ভাবছি, মনে হয় আর কখনো ভোট দিতে পারবোনা। ভোটার আইডি কার্ডটাও পেলাম না।
নির্বাচনের একবছর পর ২০১০ সালের শেষের দিকে হাতে পেলাম কাঙ্খিত স্বপ্নের ভোটার আইডি কার্ড। এর দুই বছর পর শুরু হতে যাচ্ছে পৌর নির্বাচন। নির্বাচনের আগে কনফার্ম হলাম এবার ভোট দিতে পারবো। যাই হোক! নির্বাচনের দিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে হাল্কা নাস্তা করে বের হয়ে পড়লাম পত্রিকায় ভোটকেন্দ্রের নিউজ কাভারেজ দেওয়ার জন্য। এরমধ্যে আমার সাংবাদিকতারও এক বছর গন্ডি পেরিয়ে গেলো। সকাল সাড়ে আটটায় প্রথম ভোটকেন্দ্রের নিউজ কাভারেজ ও নিজের ভোট দিতে যাই পৌর শহরের সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে। গিয়ে দেখি পুরুষ-মহিলা সবাই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে শান্তিপূর্ণ যাকে খুশি তাকে ভোট দিচ্ছে।
নিউজের জন্য কয়েকটি ছবি তুলে অন্যদের সাথে পুরুষ লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম জীবনের প্রথম ভোট দিতে। একে একে ভোট দিতে ভিতরে যাচ্ছে আর কাঙ্খিত ব্যক্তিটিকে ভোট দিয়ে মনের আনন্দে বের হয়ে যাচ্ছে। আমিও একইভাবে ভিতরে প্রবেশ করার পর একজন সহকারী প্রিজাইডিং কর্মকর্তা আমার আঙুলের মাথায় কলমের কালি বসিয়ে একটা স্লিপ দিয়ে বুথের ভিতরে পাঠায়। এমনভাবে কলমের কালি বসিয়ে দিলো যেনো ২য় বার আবার ভোট দিতে যেতে না পারি। এরপর বুথে প্রবেশ করে আপন মানুষগুলোকে ভালো করে সিল মেরে ভোট দিয়ে খুব খুশি মনে সেখান থেকে বেরিয়ে পড়ি। প্রথম ভোট দেওয়ার অনুভূতিটাই ছিলো অন্যরকম।
এরপর ২০১৪ সালে দশম জাতীয় নির্বাচনের বিএনপি ভোট বর্জন করায় আমাদের ফেনী-১ আসনে কোন নির্বাচন হয়নি। যার কারণে আর আমারও ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারিনি। উপজেলা নির্বাচনের সময় অসুস্থতার কারণে ভোট দিতে পারিনি। এরপর ২০১৬ সালে পৌর নির্বাচনের সময় ভোটকেন্দ্রে গিয়েও দিতে পারিনি। কারণ ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার পর দেখতে পাই আমার ভোট অন্য কেউ দিয়ে ফেলেছে।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।