যে পর্যটন কেন্দ্রে চোর নাই! • নতুন ফেনীনতুন ফেনী যে পর্যটন কেন্দ্রে চোর নাই! • নতুন ফেনী
 ফেনী |
১৭ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৪ বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

যে পর্যটন কেন্দ্রে চোর নাই!

ডা. ছরওয়ার আলমডা. ছরওয়ার আলম
  প্রকাশিত হয়েছেঃ  ০৫:০১ অপরাহ্ণ, ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

বাংলাদেশের কোথাও চোর এবং ছিনতাইকারী নাই সেটা ভাবাটা বেশ কঠিন। আমাদেরকে যারা নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্বে আছেন সেই পুলিশের মোটরসাইকেল চুরি হয় থানা থেকে, সাধারণ মানুষের কথাতো বাদ’ই দিলাম। গত ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ খ্রি. তারিখে ফেনী জেলার ক্লোজ সার্কিট টিভি টেকনোলজি এসোসিয়েশনের সাথে অতিথি হিসাবে পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটির সাজেক ভ্যালিতে গিয়েছিলাম আনন্দ ভ্রমনে। যাওয়ার সময় সেনাবাহিনী যেভাবে নিরাপত্তার সাথে আমাদের নিয়ে যাচ্ছেন, আমরা ধারনা করছিলাম যাদেরকে সরকার বা প্রশাসন এতো ভয় করে সেই আদিবাসীরা না জানি কত ভয়ঙ্কর। আমাদের সবার সাথে দামি মোবাইল ফোন, নগদ টাকা পয়সা আছে এবং সবচেয়ে বড় কথা জীবনের নিরাপত্তা কেমন হবে এসব বিষয় নিয়ে আমরা সবাই উদ্বেগ উৎকন্ঠা এবং দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিলাম। উৎকন্ঠার মধ্যেই অবশেষে সাজেক ভ্যালীতে পৌঁছলাম। যথারীতি আগেই বুকিং দেয়া তারেং রিসোর্টে উঠলাম। আমাদের ২৫ জন ট্যুরিষ্ট থাকার জন্য ১৭ হাজার টাকায় ৬ টি ছোট রুম আগে থেকেই ভাড়া করা আছে। দেখলাম রুমগুলো ৮ ফুট বাই ১২ ফুট সাইজের হবে, প্রতি রুমে ৫ ফুট সাইজের সাধারণ ২টি খাটে আমরা ৪জন করে থাকবো। দেখি কাঠের খুঁটির উপর টং ঘর। চতুর্দিকে বাঁশের বেড়া উপরে টিন, ফ্লোর কাঠের। হাঁটাচলা করলে পুরো ঘর নড়ে, ঘরের সামনের দিকে মেইন রাস্তা পেছনের দিকে কয়েকশ ফুট গভীর গর্ত। তাই  আমাদের অনেকের মনে ভয় ছিল এতগুলি মানুষ নিয়ে টং ঘরটি না জানি পিছনের গভীর গর্তে উল্টে পড়ে যায় কিনা। যাক রিসোর্টে কাপড়চোপড় রেখে ফ্রেশ হয়ে আছরের সালাত আদায় করে আমরা সবাই ঘুরার উদ্দেশ্যে বের হলাম। দুই দিনে স্থানীয় আদিবাসীদের সাথে মিশে, তাদের সাথে কথা বলে, তাদের জীবনযাপন প্রনালী, তাদের খাদ্যাভ্যাস, তাদের স্বভাব চরিত্র, তাদের বিয়েশাদির পদ্ধতি, আনন্দউৎসব, তাদের ধর্মীয় রীতিনীতি, তাদের মৃতদের সৎকার পদ্ধতি প্রভৃতি নিয়ে তাদের সাথে নানা কথা হয়।
তারা বলেন তাদের আদিবাসীদের মধ্যে যারা পাহাড়ের সন্তান অর্থাৎ লুসাই, কুকি, ত্রিপুরা তারা সাধারণত উঁচু পাহাড়ে বাস করে। তাদেরকে তংখা বলে। তাদের ভাষায় তংখা মানে পাহাড়ের সন্তান, উচুস্থানে বসবাস করার মানুষ। আর খিয়ংখা যারা তারা সাধারণত নীচু অংশে নদীনালা কাছাকাছি বাস করে। এরা চাকমা সম্প্রদায়। তাদের ভাষায় খিয়ংখা মানে নদীনালা সন্তান। তংখা এবং খিয়ংখাদের মধ্যে স্বভাব চরিত্রে আচার ব্যবহার, খাদ্যাভ্যাস, বিয়েশাদিতে অনেক পার্থক্য আছে। অনেক অমিল আছে। অনেক দ্বন্দ্ব আছে। তাদের মধ্যে অনেক মারামারিও হয়।

যাক সাজেক সহ পাহাড়ের উঁচু যায়গায় তংখরা বসবাস করে। তারা আবার লুসাই, কুকি, ত্রিপুরা সহ ছোটখাটো আরো অনেক গোত্রে বিভক্ত। তারা সাধারনত তাদের স্বস্বস্থানের সর্বোচ্চ উচু স্থানে ভূমি থেকে কয়েক ফুট উপরে খুঁটির দিয়ে কাঠের ও বাঁশের ঘর তৈরি করে। তারা কখনো নীচু স্থানে বসবাস করে না। তাদের সকলের ঘর প্রায় একই ডিজাইনের। ঘরের মধ্যে সবার আলাদা শোবার রুম আছে। প্রতিটি ঘরের সামনের অংশে একই উচ্চতায় বেলকনির মত বেশ কিছু যায়গা ঘেরাও করে রাখে। ঐ যায়গায় তারা তাদের হাড়িপাতিল রাখে, খাদ্য উপকরণ শুকায়। বিকালে বা রাত্রে বিশ্রাম করে খোশগল্প করে।

তাদের সাথে আলাপচারিতায় যা বুঝলাম তাদের তেমন কোন অর্থবিত্ত বা ধনসম্পদ নাই, তবে কোন অভাবও নাই। তাদের মধ্যে কেউ উপবাস থাকা লাগেনা। তাদের মধ্যে কারোরই সাধারণত বাড়তি কোন চাহিদা নাই। আজকের দিন যেভাবে গেল সেটাতে তারা সন্তুষ্ট। আগামী কালের জন্য তারা চিন্তা করেনা। তাদের ঘরের সঞ্চয় করে রাখা এমন কোন খাদ্যদ্রব্য দেখলাম না। তারা নিজেদের হাতে তৈরী ছোট প্রকৃতির কাপড়চোপড় পরে। নারীরা নীচে ছোট স্কার্ট উপরে ছোট ব্লাউজ জাতীয় কাপড় পরে। পুরুষেরা নিজেদের তৈরী লুঙ্গী জাতীয় কাপড় পরে ও মাথায় গামছার মত একটি কাপড় বেঁধে রাখে। সামান্য কাপুড়  তারা সন্তুষ্ট, তাদের কারো মধ্যে অশালীন আচরণ নাই। অথচ আমাদেরর মধ্যে যারা দামী পোশাক পরেছে, তাদের পোশাকে চেহারায় অশালীনতার ছড়াছড়ি। তাদের মধ্যে সবার হাতে দা এর মত ধারালো অস্র থাকে, এটা ছাড়া এরা সাধারণত বের হয়না। তারা পাহাড় পর্বত থেকে প্রতিদিনের খাবার প্রতিদিন সংগ্রহ করে। সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত থাকে। তাদের মধ্যে উচ্চাকাঙ্খা বা উচ্চবিলাস কাজ করেনা। তারা জানান তাদের এলাকায় কোন চোর নাই, তাদের জিনিসপত্র কখনো চুরি হয়না। চুরি এবং ব্যবিচারকে তারা মহা অপরাধ মনে করে। এ ধরনের কাজ কেউ করে থাকলে তারা তাদেরকে হত্যা করে পেলে।

আমরা প্রতিদিন যারা হাজার হাজার পর্যটক সাজেক ভ্যালিতে যাই তাদের সবার সাথে দামী মোবাইল, নগদ টাকা পয়সা সহ কোটি কোটি টাকার জিনিসপত্র থাকে। আদিবাসীদের দ্বারা এসব কিছু খোয়া যাবার বা চুরি হবার সম্ভাবনা নাই। কারন ধনসম্পদ বা টাকা পয়সার প্রতি তাদের তেমন কোন লোভ নাই। আমরা যে চাঁদের গাড়িতে করে সাজেক যাই সেই গাড়ির ড্রাইভার জানান গত ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সে সাজেক- খাগড়াছড়ি লাইনে গাড়ি চালান। এখন যেটা ৩ ঘন্টার পথ যখন কাচা রাস্তা ছিল তখন এখানে আসতে পুরো একদিন লাগতো। সকালে রওয়ানা দিলে সন্ধ্যার আগে পৌঁছতেন। তখন থেকে এখন পর্যন্ত তিনি এখানে কোন চোর দেখেননি। এখন প্রতিদিন প্রায় ২শ চাঁদের গাড়ি সহ শতাদিক মোটরসাইকেল ও প্রাইভেট গাড়ি ১ দিন রাস্তায় পড়ে থাকে। এগুলি পাহারা দেবার জন্য এখানে কোন পুলিশ ও দারোয়ান নাই। আমরাও কেউ এগুলি পাহারা দিইনা তারপরও আমাদের এখানে কোন চুরির টেনশন নাই। খাগড়াছড়ি থেকে ভাড়ায় মোটরসাইকেলে ২ জন করে পর্যটক পরিবহন করেন এমন একজন জানান, তাদের প্রায় ২শ দামী মোটরসাইকেল প্রতিদিন রাস্তায় পড়ে থাকে এমনকি মোটরসাইকেলের চাবিও তারা বেশিরভাগ সময়ে গাড়ি থেকে না খুলে  ১/২ দিন রাস্তায় রেখে তারা বিশ্রামে থাকেন।কিন্তু কেউ ধরে না। এভাবে তারা গত ৫/৬ বছর ধরে এ লাইনে প্রতিদিনের জন্য দেড় দুই হাজার টাকার বিনিময়ে নিরাপদে পর্যটক পরিবহন করে আসছেন। কোন চুরি নাই। আমরা ২ দিন অবস্থান করে সেখানে কাউকে ভিক্ষা করতে দেখলাম না। টাকাপয়সার প্রতি তাদের লোভ থাকলে তারা প্রতিজনে দৈনিক বহু টাকা ভিক্ষা করেও উপার্জন করতে পারতেন। পরিবহন সেক্টরে সেখানে কোন চাঁদাবাজি দেখলাম না। আমরা আদিবাসীদের চেহারায় কোন হতাশা, টেনশন বিষন্নতা ও দুশ্চিন্তার ছাপ দেখলাম না। তারা সব সময় হাসিখুশি, প্রফুল্ল। আমরা যারা শহরে বন্দরে বসবাস করি তাদের অনেকেই হতাশা, দুশ্চিন্তা দুর করতে স্বল্প সময়ের জন্য সাজেক যাই। আদিবাসীরা সম্পূর্ণ প্রতিকুল পরিবেশ ও দুর্গম পরিবেশে যুগযুগ ধরে বসবাস করেও মনে হল তারা চিরসুখী।  তারা আরো জানান, তাদের তেমন কোন অসুখবিসুখ হয় না। তাদের থেকে আমরা যা শিক্ষা পেলাম তা হল অর্থবিত্তে নয়, সন্তুষ্টিতেই সুখ। ধন্যবাদ আদিবাসীদের।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক পরিষদ, ফেনী জেলা।

আপনার মতামত দিন

Android App
Android App
Android App
© Natun Feni. All rights reserved. Design by: GS Tech Ltd.