গোলাপ গ্রাম • নতুন ফেনীনতুন ফেনী গোলাপ গ্রাম • নতুন ফেনী
 ফেনী |
২৯ মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

গোলাপ গ্রাম

মো. কামরুল হাসান, নিজস্ব প্রতিনিধিমো. কামরুল হাসান, নিজস্ব প্রতিনিধি
  প্রকাশিত হয়েছেঃ  ০৮:৩০ অপরাহ্ণ, ১৯ মার্চ ২০১৯

দীর্ঘদিনের স্বপ্ন গোলাপ গ্রামে যাওয়ার। কিন্তু আফিসে কাজের চাপ ও ব্যস্ততার কারণে আজ যাচ্ছি কাল যাচ্ছি করে যাওয়া হচ্ছে না বহুদিন ধরে। অবশেষে আকাশে মেঘ না থাকা স্বত্বেও হঠাৎ বৃষ্টির মতো যাওয়ার দিনক্ষণ ঠিক করা হলো। গেলো শুক্রবার আমরা চার পথিক বাসা থেকে বের হলাম। গন্তব্য কাঙ্খিত স্বপ্নের গোলাপ গ্রাম।

প্রথমে আমি আর আমার অফিসের কলিগ আরিফ সহ বের হয়ে একটি বাসে করে বাসাবো গেলাম। সেখানে আগে থেকে অপেক্ষারত মামাতো ভাই খালিদ সাইফুল্লাহ দাঁড়িয়ে আছে। এরপর তিনজন মিলে আরেকটি বাসে করে উত্তরার জসিমউদ্দিন গেলাম। সেখানে আমাদের সাথে যোগ দিলো কলেজ লাইফের বন্ধু বাপ্পি।

এরপর উত্তরা হাউজ বিল্ডিং দিয়ে লেগুনায় করে দিয়াবাড়ি বটতলা হয়ে অটোরিকশা দিয়ে পঞ্চবিথি পর্যন্ত যাই। আরেকটি বাসে করে বিরুলীয়া ব্রীজ। সেখান থেকে আবারো ১শ’ ৫০ টাকা ভাড়ায় একটা টমটম নিয়ে রওয়ানা দিই সাদুল্লাহপুরের দিকে। বিরুলীয়া ব্রীজ পার হয়ে আকরান বাজারের ভিতর দিয়ে সাদুল্লাহপুরের দিকে যেতে রাস্তার দু’পাশে চোখে পড়লো লাল সুবুজে অরণ্য চোখ জুড়ানো গোলাপ ফুলের সারি সারি বাগান।

স্থানীয়দের কাছে সাদুল্লাহপুর হলেও অসংখ্য গোলাপের বাগান থাকায় ওই গ্রামটি গোলাপ গ্রাম হিসেবে বেশ পরিচিত। যাইহোক! টমটমে বিশ মিনিট পথ চলার পর আমরা চার পথিক পৌঁছে গেলাম কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের নগরী গোলাপ গ্রামে। প্রখর রোদ, সূর্যটা মাথার উপরে।ঘড়ির কাটায় ঠিক তখন ১ টা বেজে গেলো। যেখানে গাড়ি থেকে নামলাম তার পাশে মসজিদে ইমাম সাহেবের খুতবার আওয়াজ শুনতে পেলাম। এরপর সবাই মসজিদে গিয়ে জুমার নামাজ আদায় করে নিলাম। বের হয়ে দুপুরের খাবার সেরে সবাই চলে গেলাম গোলাপ বাগানের দিকে। যেদিকে চোখ যায় সারি সারি সব গোলাপের বাগান। তখন মনে হলো, আহ! স্বপ্নের রাজ্যে বাস্তবে প্রবেশ করলাম।

বাতাসে ভেসে আসা ফুলের সৌরভ আমাদের মনকে আকৃষ্ট করে। আর সেখানে মন মাতাবে যে কাউকেই। বাগানের ভিতরে অনেক দোকানী তাজা ফুলের পসরা সাজিয়ে বসে আছে। আবার কেউ মেয়েদের মাথায় লাগানোর জন্য প্লাস্টিকের চাকতির মধ্যে তাজা লাল গোলাপ বেঁধে বিক্রি করছে ৪০ টাকা থেকে ৬০ টাকা দামে। অনেকে পরিবার পরিজন নিয়ে গোলাপের সাথে সখ্যতা করে সেলপিতে মগ্ন হয়ে আছেন। বাগানের আইল ধরে কিছুদূর যেতেই চোখে পড়লো চাষীরা গাছ থেকে তাজা ফুলগুলো বাজারে বিক্রি করার জন্য কাটার দিয়ে কেটে আঁটি বেঁধে পানি রাখার পাত্রের মধ্যে ডুবিয়ে রেখেছেন। যাতে এগুলো শুকিয়ে নষ্ট না হয়ে যায়।

সেখানে দেখা হলো স্থানীয় চাষী মোঃ সুমন’র সাথে। গাছ থেকে তাজা ফুল সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। এক মহূর্তের জন্যও দম ফেলানোর ফুসরত নেই তার। সুমন’র সাথে কথা বলে জানা যায়, গোলাপ চাষই এখানকার ৯০ ভাগ লোকের একমাত্র ভরসা। গোলাপ চাষ করে তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। তিনিও তার পূর্ব-পুরুষদের এ পেশাকে ধরে রাখতে ৮ বছর আগে তার বাবার ১শ’ শতক জায়গার উপর তিন টাকা দরে ১৫ হাজার গোলাপের চারা লাগান।

সপ্তাহে একবার করে গাছের গোড়া পরিস্কার করতে হয় এবং পোকামাকড়ের হাত থেকে গাছ ও ফুলকে রক্ষা করার জন্য পোকলেম, ভাইটামাইট ওষুধ স্প্রে করতে হয়। চারা লাগানোর কয়েক মাস পর থেকে গাছে ফুল ধরা শুরু হয়। প্রতিদিন ১৫’শ থেকে ২ হাজার পিস গোলাপ সকালে অথবা বিকালে একবার করে বাগান থেকে ফুলগুলো কাটার দিয়ে কেটে ভ্যানগাড়ি করে নিয়ে স্থানীয় শ্যামপুর ও সাদুল্লাহপুর বাজারে পাইকারি দামে বিক্রি করেন। একশ প্রতি দুই থেকে তিন টাকা দরে দু’শ থেকে তিনশ টাকায় বিক্রি করেন। আবার বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ছাড়াও বিভিন্ন দিবসে এক থেকে দেড় হাজার টাকায়ও বিক্রি করেন। গোলাপের চাষ ও বিক্রি করে বাবা মা এবং স্ত্রী দুই ছেলে মেয়েকে নিয়ে অনেক সুখেই দিন কাটছে তার।

সেখানে আরো কথা হয় স্থানীয় আরেক চাষী অর্ধশত বছর বয়সী মোমিন মিয়ার সাথে। তিনি বলেন, এখানকার শতকরা ৯০ ভাগ লোক গোলাপ চাষ করেই তাদের জীবিকা নির্বাহ করে। এখানে মূলত মিরান্ডা প্রজাতির লাল গোলাপের চাষ হয়। পুরো গ্রাম জুড়ে সারা বছরই হয় ফুলের চাষ। লাল গোলাপের পাশাপাশি রয়েছে সাদা গোলাপ, জারবেরা ও গø্যাডিওলাস ফুলের বাগান। প্রতিদিন প্রায় ৬০ থেকে ৭০ হাজার ফুল বিক্রি হয় এখান থেকেই। যা ঢাকার শাহাবাগ সহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিয়ে বিক্রি করেন বিক্রেতারা। ৩’শ পিসের গোলাপ ফুলের এক আঁটি বিক্রি হয় ৬’শ টাকা থেকে ৭’শ টাকায়। বাজারভেদে কখনো দ্বিগুণ দামও পায়।

তিনি আরো বলেন, প্রকৃতির এই কোলাহলময় গোলাপ নগরীতে নিজেদের গাঁ বাসাতে প্রতিদিন দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন অনেক ভ্রমন পিয়াসু মানুষ। নারায়নগঞ্জ থেকে পরিবার নিয়ে বেড়াতে আসা আইএফএস ট্যাক্সওয়ার (প্রাঃ) লিমিটেড’র কোয়ালিটি ইনচার্য সাগর ভাইয়ের সাথে কথা হয়।

তিনি বলেন, ফেসবুকে এই গোলাপ গ্রাম দেখে অনেক ভালো লাগলো। বিকেলের প্রকৃতিটা অনেক সুন্দর। তাই স্ত্রী, ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে চলে এসেছেন প্রকৃতির নান্দনিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে। এরপর সেখানে আরো কয়েকটি বাগান ঘুরে ঘুরে দেখলাম। গোলাপের সাথে সখ্যতা করে নিজেরাও কিছু ছবি তুলে নিলাম। যাইহোক! এবার সবাই আপন নীড়ে ফেরার পালা। আসার পথে চাষী সুমন’র বাগান থেকে শতাধিক গোলাপ দু’শ টাকায় কিনে নিলাম। আমাদের এই চার পথিকের আনন্দময় মুহূর্তগুলো ছিলো অনেক মনোমুগ্ধকর।
সম্পাদনা: আরএইচ/এমকেএইচ

আপনার মতামত দিন

Android App
Android App
Android App
© Natun Feni. All rights reserved. Design by: GS Tech Ltd.