তবে কি অন্ধকারের শেষ সুরঙ্গে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে প্রিয় বাংলাদেশ! যেন দৃশ্যত কোথাও কোনো আলোর আভা আর নেই। ফেনীর মেয়ে ‘বিদ্রেহিনী’ নুসরাত জাহান রাফি এক লম্পট মাদ্রাসা-অধ্যক্ষের যৌন লালসার শিকার হয়ে পরীক্ষাকেন্দ্রে পুড়তে পুড়তে আমাদের চোখের সামনে ভস্ম হয়ে গেল। পাঁচদিন অসহনীয় যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে ঢামেকের বার্ন ইউনিটে প্রাণ বিসর্জন দিল। বিশ্ববাসী নির্মম এ জঘন্য ঘটনায় স্তম্ভিত হল। ফেনীসহ পুরো দেশবাসী বাকহীন। পরক্ষণেই প্রতিবাদি নুসরাতের বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে, লোক থেকে লোকান্তরে।
অন্ধকার সুরঙ্গে আটকে যাওয়া অমানবিক স্বদেশ এবং তার অপর প্রান্তে ক্রমাগ্রসর রোদের চিকচিকে সর্বশেষ আলোও যেন মিইয়ে পড়ছে, সবই যেন দূরাগত দুঃস্বপের ভয়াল আশংকা নিয়ে উপস্থিত। এমন মুহূর্তে আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়েছে নতুন বছর- পহেলা বৈশাখ। পহেলা বৈশাখ বাঙালির আত্মপরিচয়কে উদ্বোধিত করে নিঃসন্দেহে। পহেলা বৈশাখ উদযাপন আমাদের স্বাধীনতার অন্যতম ভিত্তিও রচনা করেছে। কিন্তু এমন এক ভয়ঙ্কর শোকার্ত পরিবেশে সেদিন ফেনী শহরের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে ‘পাঁচদিনব্যাপী’ বৈশাখী মেলার উদ্বোধন আমাদের অবাকই করেছে বটে!
বৈশাখী মেলা একটি আনন্দযাপন প্রক্রিয়া। এ বছর এই আনন্দটিকে আমরা কি সংক্ষিপ্ত করতে পারতাম না? গত ৬ এপ্রিল হত্যার উদ্দ্যেশ্যে পরিকল্পিতভাবে নুসরাতকে দগ্ধ করার পর এবং ১০ এপ্রিল নুসরাত ধুকে ধুকে শহীদ হওয়ার এ হত্যাঘটনায় পুরো ফেনী ফুঁসে উঠেছে। বর্তমানে ফেনী শহরে চলমান বৈশাখী মেলার কেন্দ্রস্থল এই শহীদ মিনারের গা ঘেঁষে, গত দশদিনে সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি নুসরাতের হন্তারকদের কঠোর শাস্তির দাবিতে শত-শত সংগঠন প্রতিবাদ ও মানববন্ধন করেছে। পহেলা বৈশাখের দিনও প্রতিবাদে উত্তাল ছিল ফেনীর রাজপথ। এখনো জ্বলছে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের আগুন। অথচ শহীদ মিনারের দেয়ালের এক বিঘত দূরত্বের ‘উৎসবের প্রাঙ্গণে’ সেই শব্দ পৌঁছুচ্ছে না। দিনভর শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে, বিকালে অনুষ্ঠিতব্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানকে সামনে রেখে ‘এখানে কিছু একটা হচ্ছে’- সাধারণ মানুষকে এমন ম্যাসেজ দেওয়াজনিত উচ্চস্বরে হিন্দি ফিল্মের ও ব্যান্ডের গানগুলো- দেয়ালের বাইরে নুসরাত রাফির হন্তারকদের ফাঁসির দাবিতে শত শত বিক্ষুব্ধ জনতার গগনবিদারি প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে যেন ক্ষীণ করে দিতে চায়, এ দৃশ্যে বড় অসহায় হয়ে ওঠে প্রতিবাদী সভাগুলো! মোদ্দা কথা হল, আমরা যে ‘খুব’ বাঙালি- এটা প্রমাণ করার জন্য ‘এমন মর্মান্তিক মুহূর্তে’ পাঁচদিনের মেলার স্থলে একদিনই কি যথেষ্ঠ ছিল না!
ফেনী জেলা প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে পেশাসূত্রে ও আন্তরিক সখ্য থাকার সুবাদে কাছ থেকে দেখেছি ও বিস্মিত হয়েছি, তাদের মধ্যে কী চৌকশ ও ট্যালেন্টেড অফিসার রয়েছে! পুলিশ প্রশাসন তার ধারে কাছেও নেই। সেটা অন্য প্রসঙ্গ। অথচ কারোরই মনে হল-না যে, মেলাটি সংক্ষিপ্ত করা প্রয়োজন। এই মুহূর্তে ফেনী জেলা প্রশাসনের আয়োজনে পাঁচদিনব্যাপী মেলার এই উৎসবটি ফেনীবাসী হিসাবে আমাদেরকে যুগপৎভাবে বিব্রত, লজ্জিত, দুঃখিত ও মর্মাহত করছে। আমরা এমন শোকার্ত পরিবেশে এই মেলা সংক্ষিপ্ত করার জন্য ফেনী জেলা প্রশাসনের প্রতি আহবান জানাই। এ প্রসঙ্গে ফেনীর সাংস্কৃতিককর্মীদেরও দায় রয়েছে। এবার এ প্রসঙ্গে দু-এক কথা।
হাজার এক আরব্য রজনীর ‘আলাদিন ও আশ্চর্যপ্রদীপ’ নামীয় বিখ্যাত গল্পের কথা আমরা সবাই জানি। আশ্চর্যপ্রদীপ যখন যার হাতে থাকে প্রদীপের সেই ভয়ঙ্কর দৈত্য মাথা নত করে মুখ বুজে তার সব হুকুম তামিল করে থাকে। এখানে দৈত্যরূপী সেই প্রাণিটির নিজস্ব কোনো মত নেই। দৈত্যটি বস্তুত মহা শক্তিধর হলেও সে নিজের শক্তি সম্পর্কে একেবারেই উদাসীন ও অজ্ঞান। ফলে সে ছোট্ট আলাদিনের ক্রীড়নকে পরিণত হয়। আমাদের সংস্কৃতিকর্মীরাইবা নুসরাত ইস্যুতে, শোকস্তব্ধ এই জনপদে, এমন পরিস্থিতিতে কীভাবে পাঁচদিনের মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সায় দেয়। যেখানে অনুষ্ঠানে কিছুক্ষণ পরপরই দর্শকরা হর্ষধ্বনি দেয়?
এ প্রসঙ্গে সোনাগাজী উপজেলা প্রশাসনকে ধন্যবাদ দিতে হয়। এটি এ কারণের জন্যে যে, নুসরাতকে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনায় তারা সোনাগাজীতে বৈশাখের অনুষ্ঠানকে সীমিত করেছেন। এদিকে ফেনী শহরে ‘ফানুসিয়ানা’ নামের সংগঠন তৃতীয়বারের মত তাদের নির্ধারিত বৃহৎ একদিনের আয়োজন ফানুস উড়ানো কর্মসূচি পহেলা বৈশাখের সন্ধ্যায় ফেনী পাইলট হাইস্কুল মাঠে সম্পন্ন করেছে। পহেলা বৈশাখের উদযাপনের মতই, তারাও তাদের আয়োজন সঙ্গত কারণেই বন্ধ করতে পারেনি। তবে আশার কথা হল, এ আয়োজনে নুসরাতের নির্মম হত্যাকাÐের প্রতিবাদে ও খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে একহাজার মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করে তারা। শান্তি-সম্প্রীতির প্রতীকে আকাশে ওড়ে ছয়শ’ ফানুস। সংগঠকরা এ উৎসবে শোক প্রকাশে কালো ব্যাচ ধারণ করে। ফলে সেটি সর্বমহলে গ্রহণীয় হয়ে উঠেছে।
এবার শেষ কথা। গতকাল সারাদেশের মত ফেনীও দিনভর বিভিন্ন সংগঠনের আয়োজনে নুসরাতের হত্যার প্রতিবাদে মুখর ছিল। বিকালে সুজন-নামের একটি সংগঠন সুসরাত হত্যার প্রতিবাদে ফেনী শহীদ মিনারের পাশে মানববন্ধন করে। এ মানববন্ধনে জেলার সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও একাত্মতা ঘোষণা করেন। বিকাল পাঁচটা দশ মিনিটে মানববন্ধন শেষ হলে দেখা যায়, ‘মানসিক ভারসাম্যহীন’ এক কিশোর (পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জেনেছি, তার নাম খালেদ, বাড়ি ছাগলনাইয়া) সুন্দর বাংলা ও ইংরেজিতে নুসরাতের হত্যার প্রতিবাদ জানাচ্ছে। তখন উৎসুক জনতা তার অনানুষ্ঠানিক বক্তব্য ভিডিও করছে। তখন আমিও শুনেছিলাম নুসরাত হত্যার প্রতিক্রিয়ায় তার প্রতিবাদি কণ্ঠস্বর। পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেই ভিডিও থেকে তার ভাষ্যটি আমি লিপিবদ্ধ করি। আবেগে কাঁপতে কাঁপতে খালেদ বলছিল, ‘নুসরাত আমাদের বোন। আমাদের বোনকে যদি কেউ এ রকমভাবে হত্যা করে, তাহলে কি আমরা বিদ্রোহ করব না, আমরা কি লড়াই সংগ্রাম করবো না? এই হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে আমাদের কী করতে হবে? আমাদের প্রাণ খুলে বিদ্রোহ করতে হবে…’
মানববন্ধন শেষ করে দ্রæত ছুটছি অনুজপ্রতিম বন্ধু রাশেদুল হাসানের ‘নতুন ফেনী’ অফিসে। ঢাকায় পাঠাতে হবে নুসরাতের সর্বশেষ খবর। লিখতে হবে লম্পট অধ্যক্ষ সিরাজ কীভাবে জেলে থেকেই নির্দেশ দিয়েছিল মায়াবতী নুসরাতকে হত্যার! লিখতে হবে সাহসিকা নুসরাতের গায়ে পাষন্ড নুর উদ্দিন, শামীম গংরা কীভাবে এক লিটার কেরোসিন ঢেলে দিয়েছিল সেই স্বীকারোক্তির বর্ণনা! লিখতে হবে কাউন্সিলর মাকসুদের কয় দিন রিমান্ড হল। সমালোচিত ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে করা মামলার বয়ান। ‘আজ’ গ্রেপ্তার একজন নাকি দুজন! এ নির্মমমতার আগের অংশীদার আটককৃত পপিই কি সেই ‘শম্পা’!
এতো এতো খবর নিয়ে যখন হয়রান, তখন মনের কোণে একটি কথাই বারবার ঘুরে ফিরে আসছিল। একটু আগে মানববন্ধন শেষে পাগল ঠাহর করা নুসরাতের ‘ভাই’ খালেদের কথা। আসলেই কি ছেলেটি ‘পাগল’! নাকি আমরাই ‘মানসিক ভারসাম্যহীন’!
লেখক: কবি ও সাংবাদিক
[প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। নতুন ফেনী’র সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য নতুন ফেনী কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে কোনও ধরনের দায় নেবে না।]