আলমগীর মাসুদ
বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক–এর উপন্যাস ‘নিষিদ্ধ লোবান’ থেকে একাত্তরের ধ্বংসস্তুপ কাহিনী নিয়ে নাছির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু ‘গেরিলা-য়’ রুপান্তরিত করে। সৈয়দ শামসুল হকের উপন্যাস নিষিদ্ধ লোবান থেকে গেরিলা অনেকটাই আবর্তিত। বাংলা ছবি তথা মানব সমাজে আজ পর্যন্ত বেশি দূর এগুতে পারেনি। পারছেনা সত্যিকার সংস্কৃতিকে লালন করতেও। ১৯৫৬ সালের ‘মুখ ও মখোশ’ দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রের যাত্রা শুরু হলেও তা আজও শুভ সূচনা করতে পারেনি। কিন্তু তার ভেতরও আমরা যখন দেখি একের পর এক সামাজিক ও সাহিত্য নির্ভর উপন্যাসিকদের উপন্যাস অবলম্বনে যে সব ছবি গুলো যেমন, ভাত দে, বিরাজ বৌ, গোলাপী এখন ট্রেনে, পদ্মা নদীর মাঝি, দেবদাস, চাকা, হাজার বছর ধরে, রানওয়ে এবং আমার বন্ধু রাশেদ, কাগজের ফুল, নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ প্রভৃতি ছবিগুলো, সিনেমা হল গুলোতে দ্রুততার সাথে সহজে সাধারণ মানুষের হৃদয়ে জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারেনা। তারপর দেখতে পাই পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ব বাংলা যৌথ প্রযোজনায় মুক্তি পাওয়া লালনের মনের মানুষ। বাংলাদেশ সহ অনেক জায়গায় ছবিটি পুরস্কিত হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় ছবিটি বোদ্ধা মহলে প্রশংসিত হলেও, আমাদের গুটি কয়েক সংস্কৃতিপ্রেমী ছাড়া তেমন ভিড় দেখা যায়নি সিনেমা হলে।
দুই.
আজ আমরা খুব দুঃখের সাথে বলতে পারি যেখানে ভারতের ছবি গুলো বাংলাদেশী চলচ্চিত্রপ্রেমীরা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখেন। তাতে ভারতীয় চলচ্চিত্রকারেরা আরো তোড়জোড় হয়ে উঠে। যে আমাদের বাংলা সিনেমা হল গুলোতে তাঁদের ছবি গুলো মুক্তি পাক। কারণ, তাঁরা চায় তাঁদের কালচার দেখে দেখে আমাদের বাঙালি সমাজও তাঁদের মত নগ্ন হয়ে উঠোক। আমাদের আজকাল সমাজে নারী ও পুরুষদের মাঝে হিন্দি সিনেমা গুলো খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তার কারণ ওখানে যৌনতা আছে। আছে ওপেন কিস খাওয়ার প্রতিযোগিতা। যা দেখে আমাদের সমাজ দিন-দিন হচ্ছে অপসাংস্কৃতির অগ্রাসনে দূষিত। তরুণ তরুণীরা অল্প বয়সে বিপদগামী হয়ে বিকৃত মনা মানুষ হিসেবে দিন-দিন পরিচিত হচ্ছে। তা দেখে হাসে আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র, আর আনমনে বলে, মনে হয় আমরা জিতে গেছি। সত্যি তাঁরা জিতে যায়। কারণ, দেখা যায় তাঁদের ধর্মের সাথে অনেকটা বাস্তবতার মিল রেখেই পরিচালকেরা ছবি গুলো তৈরি করেন। আর সে ছবিতে নগ্ন হয়ে নায়িকারা অভিনয় করে। সে সাথে তাঁদের দেব দেবীদেরও খুশি করাতে পারেন বৈকি। দেখা যায় মা-মেয়ে, বাবা-মেয়ে অথবা ভাই-বোন মিলে যখন মন্দিরে যায় তখন তাঁরা কি শিখে?
নিশ্চই পূজার নামে পূজারিরা দেব-দেবীদের উলঙ্গ ও নগ্ন শরীরের স্পর্শকাতর অঙ্গগুলোর দিকে মগ্ন হয়ে খানিক নিজেরাও উলঙ্গ ও নগ্ন হয়ে যায়। তাই তো ভারতীয় ছবিগুলোতে যে যত বেশি নগ্ন ও উলঙ্গ হবে সে তত বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করে। এতে তাঁদের কোন শাস্তি নেই বরং উৎসাহ আছে। যেমন তাঁদের পূজা মুর্ছানায় বেশির ভাগ দেব দেবীর মূর্তি ল্যাংটা যৌন স্থান দেখিয়ে চোখে টান-টান ভ্রু লাগিয়ে এক ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে থাকে। আর সেই উলঙ্গ দেব-দেবীদের মন্দিরে পূজার নামে দল বেধে যুবতী মেয়েরা ডুকে। সেখানে উপস্থিত বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ, মা-মেয়ে, বাবা-মেয়ে এবং কি ভাই বোন মিলে প্রার্থনা করে, সেজদা দেয় আর পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নেয় যাতে পরীক্ষায় কি জীবন চলার পথে ভাগ্যদেবী মাথার মনিতে থাকে। কিন্তু কাজ হয় উল্টো। পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ দেশ ভারতে প্রতি বছর সবচেয়ে বেশি নারীরা যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের শিকার হয়। শুধু তাই নয় ভারতীয় বাজারে মেয়েরা অনেকটা পণ্য হয়ে জীবন-জাপন করে। হেইট ষ্টোরি, ডার্টি পিকচার, শিলা কি জোয়ানি, মুন্নি বদনাম হুয়ি, জিশান টু, কুইন, রাগিনি এমএমএস টু, মাডার সিকুয়্যাল, …রাম লীলা, ইশক জাদা, হার্টলেস, ওয়ান বাই টু এবং কি তেরে নেশা, এক ভিলেন, মে তেরা হিরো, হাম্পটি শার্মা কি… হেট ষ্টোরি টু ইত্যাদি গান ও ছবি গুলোতে প্রধান-প্রধান চরিত্রে বর্তমান সময়ে অল্পবয়সী মেয়েরা নায়িকার খ্যাতি পাওয়ার জন্য কতটা যৌনতা ও নগ্ন হয়ে অভিনয় করতে পারে কিংবা তাঁর প্রভাবে আমাদের বাংলা চলচ্চিত্র ধ্বংস হচ্ছে। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকেও ছোট করছে এমন ছবিও তৈরি হচ্ছে এবং হয়েছে যেমন ১৪ ফেব্রুয়ারি মুক্তিপ্রাপ্ত যশরাজ ফিল্মসের ছবি ‘গুন্ডে’তে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করেছে। আমাদের চলচ্চিত্র প্রেমীরা দিন-দিন ঐ ছবি ও নায়িকা গুলোর প্রতি মগ্ন যেমন হচ্ছে, মেয়েরা হারাচ্ছে তাঁদের সতীত্ব। এখনকার মেয়েরা ফাইভের গন্ডি ফেরিয়ে হাইস্কুলে উঠতে না উঠতেই কিছু বাহিরের ছেলে ও ক্লাসমেটের প্রতি আবেগ অনুভূতির মোহে পড়ে যায়। তারপর নাম্বার বিনিময়। প্রথম-প্রথম রাত জেগে এসএমএস তারপর কলে সেক্স আলাপ…। এভাবেই ঐ তরুণ-তরুণীরা একজনের প্রতি অন্য জন ফ্রি হয়ে যায়। আর এতেই বেশির ভাগ মেয়ে তাঁদের কুমারিত্ব হারায়। আবশ্য ওই মেয়ে গুলো সহজে নষ্ট হওয়ার পেছনে তাঁদের মা বাবারাই একটু বেশি দায়ি। কারণ, মেয়েকে অনর্থক হাতে মোবাইল নামক বস্তুটি তুলে দেয়া, ডিসে মেয়েদের ইচ্ছে মত হিন্দি চ্যানেল গুলো দেখা থেকেই তাঁদের নষ্ট হওয়ার পথ অনেকটা সহজ হয় বৈকি।
তিন.
আমাদের বাংলাদেশ যেমন সুন্দর সবুজ প্রাকৃতিময়, তেমনি আমাদের সংস্কৃতিও অনেক সুন্দর। এই সংস্কৃতি থেকে আমাদের যেমন অনেক কিছু শিখার আছে তেমনি অনেক কিছে দেয়ারও আছে।
আজ আমাদের সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান সিনেমা হল গুলো আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, এটা নিঃসন্দেহে কোন সু-সংবাদ নয়। সেই সাথে বাংলা সংস্কৃতির দর্শকও দিন-দিন কমছে। অতএব, আমাদের সংস্কৃতি আমাদের মনে লালন করে জনপ্রিয়তা বাড়াতে হবে। সে সঙ্গে অন্য দেশের অশ্লীল সাংস্কৃতিকে দূরে নিক্ষেপ করে প্রমাণ করতে হবে আমরা হাজার বছরের সুন্দর সংস্কৃতি সৃষ্টি করতে পারি।
লেখক: কবি ও গল্পকার







