ডাঃ ছরওয়ার আলম।
মোঃ গোলাম রসুল। বয়স ৫০। সোনাগাজী, ফেনী। ৬ জুলাই ২০০৭ খ্রি. তারিখে আমাদের নিকট তাঁর জন্ডিসের চিকিৎসার জন্য আসেন। রোগী জানালেন ৪/৫ দিন ধরে তাঁর প্রস্রাব হলুদ। প্রস্রাবে সামান্য জ্বালাপোড়া আছে। জিহ্বায় সব কিছু তিতা লাগে। ঘুম কম, হাত পায়ের তালুতে জ্বালাপোড়া ও শরীরে চুলকানি আছে। ক্ষুধা কম, একটু খেলে পেট ভরে গেছে মনে হয়। গ্যাস্ট্রাইটিস আছে। মিষ্টি প্রিয়। পায়খানা কষা প্রকৃতির। বিকালে বেশী ক্লান্তি লাগে।
রোগী আরো জানালেন, সে ক্রোধী স্বভাবের, খিটখিটে ও উত্তেজনা প্রবন, মিথ্যা ও অন্যায় সহ্য করতে পারেনা। যে কোন কাজ করতে প্রথমে জড়তা কাজ করে তবে কোনমতে কাজ শুরু করলে তা পূর্নউদ্যমে শেষ করে। সঞ্চয়ী মনোভাব বেশী। পরীক্ষা করে দেখলাম চোখ, জিহ্বা, নখ ও চর্মে হলুদাভাব আছে। ব্লাড সিরাম বিলিরুবিন ৫ (নরমাল-১), ব্লাড সুগার ৮ (নরমাল-৬)। আমরা রোগীর বর্তমান রোগ, সার্বদৈহিক লক্ষনাবলী মুল্যায়ন করে ঔষধ নির্বাচন করলাম ‘লাইকোপোডিয়াম’। ১ সপ্তাহের ঔষধ দিয়ে ঔষধ শেষে জানাতে বললাম। সাথে বিশ্রামে থাকা ও সহজপাচ্য নরম খাবার ঘন ঘন খেতে উপদেশ দিলাম।
৩ দিন পরে রোগীকে নিয়ে তাঁর পরিবারের লোকজন চেম্বারে আসলেন। দেখলাম রোগীর অবস্থা ভয়ানক। অস্বাভাবিকভাবে বিলিরুবিন বেড়ে গেছে এবং রোগী প্রচন্ড দুর্বল হয়ে গেছে। পরীক্ষা করিয়ে দেখলাম সিরাম বিলিরুবিন (জন্ডিসের মাত্রা) ২৮, ও ব্লাড সুগার (ডায়াবেটিস) ১৮। জিজ্ঞাসাবাদে জানলাম, রোগী ঔষধ সেবনের পাশাপাশি পথ্য ও উপদেশ সমূহ যথানিয়মে পালন করেনি। জন্ডিসের ক্ষেত্রে অধিকাংশ রোগী উপদেশ ও পথ্যের নিয়ম মানতে চায়না কিন্তু এক্ষেত্রে পথ্য ও বিশ্রামের গুরুত্ব অনেক বেশী। এছাড়া রোগীরা এক্ষেত্রে গ্রাম্য লোকদের বিচ্ছিন্ন উপদেশ এবং টোটকা চিকিৎসাকে বেশী গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। যাক, অবস্থা বেগতিক দেখে উন্নত চিকিৎসার জন্য এম্বুলেন্সে করে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ায় পরামর্শ দিলাম।
তাঁরা দ্রুত তাঁকে পুরান ঢাকার মিডফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি করলেন। কিন্তু রোগী কোনভাবেই সেই হাসপাতালে থাকবেন না। কারন উনি যে বিভাগে ভর্তি হয়েছেন সেই বিভাগের টয়লেট সংখ্যা বেশ কয়েকটি হলেও টয়লেটের দরজা আছে মাত্র ২ টি। তাও আবার রোগীরা টানাটানি করে টয়লেট থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। এখন ঐ বিচ্ছিন্ন দরজা যে জোর করে দখলে নিতে পারে সে টয়লেট ব্যবহার করতে পারে তাও আবার বাহিরে কেউ পাহারা দিয়ে দরজা দখলে রাখতে হয়। না হলে রোগীদের টয়লেট করা অবস্থায় অন্যরা দরজা ছিনিয়ে নিয়ে যায়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁকে জালাল, সরকারের বরাদ্ধ না থাকাতে এভাবেই সেবা দিতে হচ্ছে। এর বাহিরে তাদের কিছু করার নাই। সরকারী হাসপাতালে রোগী সেবার এই অবস্থা জানা থাকলে মুমুর্ষ অবস্থায় তিঁনি সেখানে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করতন না বলে জানান। যাক রোগী জীবন বাঁচানোর উদ্দেশ্যে পরে মিডফোর্ড হাসপাতালে পার্শে বেসরকারী ‘ঢাকা হাসপাতালে’ ভর্তি হয়ে জনৈক গ্যাষ্ট্রোলিভারের প্রফেসরের তত্বাবধানে থাকেন। কিন্তু রোগী জানান, ঐ চিকিৎসকে ঢাকা হাসপাতালে তাঁর চেম্বারে বিকাল ৫টা থেকে রাত ১২ টা পর্যন্ত প্রায় ২০০ রোগী দেখার পরে হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের দেখার সুযোগ দেয়া হয়। ঐ চিকিৎসক তখন শুধু রোগীদের একনজর দেখে যান। এর বাহিরে রোগীর অসুস্থতা বিষয়ে আর কিছু জানতে চাননা। রোগীর বক্তব্য ঢাকা হাসপাতালে ভর্তি হয়ে টাকার বিনিময়ে একটা এসি রুম আর টয়লেট সুবিধা ছাড়া উল্লেখ করার মত আর কোন সেবা পরিসেবা পাননি। ১৬ দিন রোগী হাসপাতালে ভর্তি থেকে প্রায় ১ লক্ষ টাকা খরচ হওয়ায় পর অবস্থার এমন কোন উন্নতি না বুঝায়, সব কিছু ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে চলে আসেন। আমরা রোগী আসার পর অগ্রগতি জানতে চাইলে রোগী জানালেন, উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। ১৬ দিন পর বিলিরুবিন (জন্ডিসের মাত্রা) ২০, ও ব্লাড সুগার (ডায়াবেটিস) ১২। হাসপাতালে শুধু স্যালাইন দিয়ে শুয়ে রেখেছে। ডাক্তার এমন কোন ঔষধ দেননি। তাই অধৈর্য হয়ে এবং হাসপাতালের অতিরিক্ত বিলের কথা চিন্তা করে চলে আসলাম। আমি এখন আবার হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা নিব।
আমরা রোগীর বিশেষ অনুরোধে আবার চিকিৎসা দিতে রাজি হলাম। ঔষধ পূর্বেরটাই। লাইকোপোডিয়াম। চরিত্রগতভাবে “লাইকোপোডিয়াম” ঔষধটি একটু ধীরগতিসম্পন্ন হওয়াতে এবং রোগী পথ্য এবং নিয়ম মানার ক্ষেত্রে মনের অজান্তে অনিয়ম করাতে প্রথমাবস্থায় রোগী উপকার বুঝতে পারেনি এটা আমরা যেরকম বুঝতে পেরেছি। রোগীকেও বুঝিয়ে বললাম। এছাড়া রোগী ঢাকা থেকে ঘুরে এসে অনেক কিছু উপলব্ধি করতে পেরেছেন। উক্ত ঔষধ সেবনে রোগী ধীরে ধীরে সুস্থ্য হয়ে উঠে। প্রায় ২ মাস চিকিৎসার পর রোগীর জন্ডিস এবং ডায়াবেটিস সম্পূর্ণ সুস্থ্য হয়।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক পরিষদ, ফেনী জেলা।
জন্ডিস রোগ চিকিৎসায় হোমিওপ্যাথি







