এম মাঈন উদ্দিন, মিরসরাই থেকে>>
স্কুল থেকে ঝরে পড়া সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়মিত পাঠদানের মাধ্যমে স্কুলমুখী করার জন্য কাজ করছে মিরসরাইয়ের সোনালী স্বপ্ন সংগঠন। উপজেলার শাহেরখালী ইউনিয়নের গজারিয়া বেড়িবাঁধ এলাকার জেলেপাড়ার শিশুরা সমাজের অন্যান্য শিশুদের থেকে একটু আলাদা প্রকৃতির। কয়েক বছর আগেও তাঁরা বাবা কিংবা বড় ভাইয়ের সাথে কাজ করার জন্য অল্প বয়সে সমুদ্রে মাছ ধরতে কিংবা কাঠ কাঠতে চলে যেতো। সে অনগ্রসর ও স্কুল বিমুখ শিশুদের স্কুলমুখী করতে উদ্যোগ নেয় একদল শিক্ষিত যুবক। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের বিনাপয়সায় পাঠদান, শিক্ষা সামগ্রী বিতরণ, বৃক্ষরোপন, শীতবস্ত্র ও ইফতার সামগ্রী বিতরণ সহ বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রম করে যাচ্ছে সংগঠনটি। উপজেলাতে শতাধিক সামাজিক সংগঠন থাকলেও অন্যদের থেকে ব্যতিক্রমী উদ্যোগটি নিয়ে কাজ করছে সোনালী স্বপ্ন।
জানা গেছে, ২০১১ সালে উপজেলার সাহেরখালী ইউনিয়নে একদল শিক্ষিত যুবক গড়ে তুলেন সোনালী স্বপ্ন সংগঠন। শুরুতে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মাঝে নতুন কাপড়, ইফতার সামগ্রী বিতরণ ও বৃক্ষ রোপন কর্মসূচীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো সংগঠনটির কার্যক্রম। পরবর্তীতে গত চার বছর সাহেরখালী ইউনিয়নের গজারিয়া ডোমখালী বেড়িবাঁধ এলাকার প্রাথমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া শিশুদের নিয়মিত পাঠদানের মাধ্যমে পুনরায় স্কুল মুখী করতে কাজ করে যাচ্ছে সংগঠনটির নেতৃবৃন্দ। সপ্তাহে ৩দিন বিকেলে শতাধিক শিক্ষার্থীকে বিনাপয়সায় নিয়মিত পাঠদান করায় সংগঠনের উদ্যোক্তারা। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পড়ালেখা করানোর জন্য খুলেন সোনালী স্বপ্ন পাঠাগার।
সোনালী স্বপ্ন পাঠশালার পরিচালক ও সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন জানান, আমরা বন্ধুরা মিলে একদিন বিকেলে ডোমখালী বেড়িবাঁধ এলাকায় ঘুরতে যায়। ওই এলাকার বেশীর ভাগ পরিবার সমুদ্র থেকে মাছ ধরার সাথে জড়িত। জেলে সম্প্রদায়ের শিশুরা বাবার সাথে সমুদ্রে মাছ ধরা ও কাঠ কাটার কারণে শিক্ষার আলো থেকে দূরে সরে যায়। আমার বন্ধু সুমন আহমেদ, মইনুল হোসেন টিপু, মাঈন উদ্দিন রিপন, গোলাম নুর নুহিন মিলে ঝরে পড়া শিশুদের পুণরায় স্কুলমুখী করার চিন্তা করি। পরবর্তীতে আমরা ঠিক করি সপ্তাহে ৩দিন ঝরে পড়া শিশুদের বিনাপয়সায় পড়ানোর। পড়ানোর জন্য বেড়িবাঁধের উপর অবস্থিত সাহেরখালী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম নুরুল মোস্তফার অব্যবহৃত মক্তব (আরবী শিক্ষার ঘর) ব্যবহার করার জন্য আমরা চেয়ারম্যানকে জানায়। চেয়ারম্যান সাহেব আমাদের প্রস্তাব শুনে অনুমতি দেন। সেই থেকে আমরা সপ্তাহে ৩দিন বেডিবাঁধের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পড়ালেখার উদ্যোগ নিই। যা আজ অবদি চালু রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, শুরুতে আমরা ১৪ জন শিক্ষার্থী নিয়ে সোনালী স্বপ্ন পাঠাগার শুরু করি। যা এখন শতাধিক শিক্ষার্থীর পাঠাগারে পরিণত। পাঠাগারের শিক্ষকরাও ছাত্র। তাঁরা বিভিন্ন কলেজে অনার্স এবং মাস্টার্সে অধ্যয়নরত। বর্তমানে ক্লাবের ৬জন সদস্য শিশুদের বিনাপয়সায় নিয়মিত পাঠদান করে আসছেন। পাঠাগারে পড়ালেখার পাশাপাশি শিশুদের স্যানিটেশন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও পুষ্টি বিষয়ক সচেতনতার শিক্ষা দেওয়া হয়। পাঠদানের পাশাপাশি আমরা শিশুদের মাঝে প্রতিবছর শিক্ষা সামগ্রী ও নতুন পোশাক বিতরণ করি। শিশু শ্রেণী থেকে ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের পাঠদান করানো হয়। পাঠাগারে ঝরে পড়া শিশুদের নিয়মিত পাঠদান করিয়ে তাদের গজারিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, নাজিরপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, জামাল শফি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করানো হয়। গত বছর প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় বেড়িবাঁধ এলাকার ৬জন শিশু পাশ করে। যা বেড়িবাঁধ এলাকায় প্রথম।
সোনালী স্বপ্নের সাবেক সভাপতি মইনুল হোসেন টিপু জানান, বেড়িবাঁধ এলাকার শিশুরা আগে পিতা বা বড় ভাইয়ের সাথে মাছ ধরার জন্য সমুদ্রে চলে যেতো। তারা স্কুলে নিয়মিত ছিলো না। আমরা তাদের স্কুলে নিয়মিত করার জন্য বিনাপয়সায় শিক্ষার ব্যবস্থা করি। শিক্ষার গুরুত্ব এবং ভবিষ্যত প্রজন্মকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য অভিভাবকদের সাথে একাধিক মতবিনিময় করি। পরবর্তীতে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের আমাদের পাঠাগারে নিয়মিত পাঠান। বর্তমানে বেডিবাঁধের শতকরা ৯০ ভাগ শিশু স্কুলে যায়। আস্তে আস্তে বেড়িবাঁধ এলাকায় শিক্ষার হার বাড়তেছে।
টিপু আরো বলেন, বেড়িবাঁধের জেলেপাড়ার সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পড়ালেখা শিখানোর বিষয়টি কিছু দুর্বৃত্তের পছন্দ হয়নি। তাই তারা চলতি বছরের মার্চ মাসের দিকে সোনালী স্বপ্নের অস্থায়ী পাঠাগারটি ভেঙ্গে দেয়। ঘর ভেঙ্গে ফেলার পরও আমরা থেমে থাকিনি। এখন খোলা আকাশে শিশুদের ক্লাশ করানো হয়। বৃষ্টিতে ক্লাশ বন্ধ থাকে। আমরা সবাই ছাত্র। নিজেরা পড়ালেখার ফাঁকে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পড়ালেখার জন্য কাজ করি। এখন শিশুদের পড়ালেখা করানোর জন্য একটি ঘর প্রয়োজন। সমাজের বিত্ত্ববানরা যদি এক্ষেত্রে এগিয়ে আসে তাহলে সোনালী স্বপ্ন সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সোনার মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেবে।
সম্পাদনা: আরএইচ/এমইউ







