মুগ্ধতা ছড়ালো ‘ব্যালে বালিকা’ • নতুন ফেনীনতুন ফেনী মুগ্ধতা ছড়ালো ‘ব্যালে বালিকা’ • নতুন ফেনী
 ফেনী |
১৬ মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মুগ্ধতা ছড়ালো ‘ব্যালে বালিকা’

নতুন ফেনী ডেস্কনতুন ফেনী ডেস্ক
  প্রকাশিত হয়েছেঃ  ১০:০২ অপরাহ্ণ, ২৮ জানুয়ারি ২০২২

মোবাশ্বিরা কামাল ইরার পরিচয় আর নওগাঁ সরকারি কলেজে সীমাবদ্ধ নেই। আটকে নেই নওগাঁ জেলায়ও। তার নাম দেশ ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে বিদেশেও। এই পরিচয় এনে দিয়েছে তারই কীর্তি, তারই নৃত্য। তার পরিচয় এখন ‘ব্যালে বালিকা’।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরসহ বিভিন্ন স্থানে তার ব্যালে নৃত্যকলা দারুণ মুগ্ধতায় ডুবিয়েছে শিল্প-সংস্কৃতিপ্রেমীদের। কেউ তাকে দিচ্ছেন ‘উচ্ছল মুক্ত বিহঙ্গ’ উপাধি। কেউ বলছেন ‘বাংলার উড়ন্ত মানবী’। কারও মতে ‘আগুন ডানার পাখি’। কেউবা তার নৃত্যের প্রকাশকে বলছেন ‘নারীমুক্তির অভিব্যক্তি’ হিসেবে।

যে কলা-কৌশলে ছবিতে পোজ দেওয়া হয়েছে, সেটি নাচের একটি নতুন ধরন। ব্যালে ও জিমন্যাস্টিকসের সমন্বয়ে নাচের এ ফর্ম। এখানে নাচের সঙ্গে অভিনয় এবং সংগীতের অপূর্ব সমন্বয় ঘটে। ছবির ব্যাকগ্রাউন্ডে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্ল্যাকার্ড ও পোস্টার থাকায় অনেকে এমন নান্দনিক প্রকাশকে ‘সংকট থেকে মুক্তির প্রতীক’ও বলছেন। কেউ কেউ আবার ছবির ক্যাপশনে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার পঙক্তিও দিচ্ছেন।

এই ব্যালে নৃত্যের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানোর পর ইরা যেমন ভাসছেন প্রশংসার জোয়ারে, তেমনি সামলাতে হচ্ছে গণমাধ্যমকেও। এমন ব্যস্ততার ফাঁকেই নওগাঁ শহরের জগৎসিংহপুর মহল্লার বটতলা মোড় সংলগ্ন বাড়িতে কথা হয় ইরার সঙ্গে।

আবু হায়াৎ মোহাম্মদ কামাল ও ফাহমিদা আক্তার দম্পতির চার মেয়ের মধ্যে মোবাশ্বিরা কামাল ইরা তৃতীয়। বাবা ব্যবসায়ী এবং মা গৃহিণী। নওগাঁ সরকারি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষে বাণিজ্য শাখায় পড়ছেন ইরা। এর আগে ২০২০ সালে নওগাঁ সীমান্ত পাবলিক স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন।শৈশব থেকেই ইরা ছিলেন অদম্য মেধাবী ও চঞ্চল প্রকৃতির। বেড়ে ওঠা নওগাঁ শহরেই। বরাবরই নাচ করতে ভালোবাসেন।

শৈশবে শিক্ষক সুলতান মাহমুদের কাছে নাচ শিখেছেন। পরে ঢাকায় ভরতনাট্যম শেখেন। তবে ব্যালে নৃত্যের ভাবনা মনে আসে ২০২০ সালের লকডাউনের সময়। ঘরে বসেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে শিখতে শুরু করেন ব্যালে। এজন্য তিনি কঠোর পরিশ্রম করেন। ২০২১ সালে সাধনা নামে একটি নাচের সংগঠনের সঙ্গে কাজ শুরু করেন ইরা।

এর মধ্যে পরিচয় হয় ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার জয়িতা আফরিনের সঙ্গে। তিনি থাকেন ঢাকার ধানমন্ডিতে। গত ২০-২২ জানুয়ারি ঢাকায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে নৃত্য উৎসবে যোগ দিতে এসে জয়িতার সঙ্গে যোগাযোগ করেন ইরা। দুজনে ফটোগ্রাফির আলাদা একটা অর্থ তৈরি করার চিন্তা করছিলেন। ২৩ জানুয়ারি সকালে দুজনে বেরিয়ে পড়েন। এমন সময় চোখে পড়ে রাজু ভাস্কর্যের পাশে চলমান বিভিন্ন আন্দোলনের প্ল্যাকার্ড-পোস্টার। সেখানে কয়েকটি ফটোশুট করেন। পরে ২৫ জানুয়ারি বিকেল ৪টার দিকে ফেসবুকে আপলোড দেওয়া হয়। সে ছবিগুলোই ছড়াতে ছড়াতে এখন সবার মুখে মুখে ইরার নাম।

ব্যালে বালিকা ইরা বলেন, ৫-৬ বছর বয়স থেকেই শিক্ষক সুলতান মাহমুদের কাছে নাচ শিখেছি। ২০২০ সালে এসএসসি পাস করলাম। সে সময় ভারতে গিয়ে শাস্ত্রীয় নৃত্য ও ভরতনাট্যমের ওপর কিছু শেখার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে দেশে লকডাউন ঘোষণা হলে মন খারাপ হয়ে যায়। তখন ভাবলাম আমার দ্বারা কিছু হবে না বা কিছুই করতে পারবো না। তখন মা পরামর্শ দিলেন ইউটিউব দেখে ঘরে বসে নাচ করতে। বলা যায় ইন্টারনেট দেখেই ‘ব্যালে’ শেখা। সবসময় ইচ্ছা ছিল নতুন কিছু শেখার। বাংলাদেশে ব্যালে করে এমন শিল্পী খুবই কম আছেন। কিন্তু দেশের বাইরে ব্যালের ব্যাপক প্রচলন আছে। আমার ইচ্ছা আছে ব্যালে নিয়ে কাজ করার।

তিনি বলেন, লকডাউনের সময় ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপ ফেসবুকে আপলোড করতাম। সেখান থেকে সাগর দেবনাথ নামে একজনের সঙ্গে পরিচয় হয়। তার ইচ্ছা ছিল এ ধরনের (ব্যালে) ফটোশুট করার। আমিও সমর্থন দিলাম। তারপর ঢাকায় যমুনা ফিউচার পার্কে কিছু ফটোশুট করলাম। তারপর জয়িতা আফরিন আপু ছবিগুলো দেখেন এবং তিনিও এ ধরনের ছবি নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে পোষণ করেন। গত বছরের ২ নভেম্বর ধানমন্ডির লেকের পাড়ে ফটোশুট করা হয়। সেই ছবিগুলো ফেসবুকে আপলোডের পর মোটামুটি ভালো একটা সাড়া পাওয়া যায়। তারপর থেকে ঢাকার বিখ্যাত বিভিন্ন জায়গায় ফটোশুট করার পরিকল্পনা করি আমরা।

ইরার মেঝ বোন জুয়াইয়া কামাল অর্ক। পড়াশোনা করছেন রাজশাহী হোমিও কলেজে। তিনি বলেন, আমরা অনেকেই চেষ্টা করেছি ছোট বোন ইরার মতো ব্যালে করতে। কিন্তু সেটা না পারায় আফসোস থেকে গেছে। আশা করছি সে আরও ভালো করবে। আমাদের মুখ উজ্জ্বল করবে। দেশকে আরও পরিচিত করাবে।

ইরার মা ফাহমিদা আক্তার বলেন, শুরু থেকে পারিবারিক তেমন সাপোর্ট পাওয়া যায়নি। মেয়ের ইচ্ছা ও আগ্রহ থাকায় আমি চেষ্টা করেছি এ জায়গা পর্যন্ত পৌঁছানোর। ২০১৭ সাল থেকে তার নাচে হাতেখড়ি। মেয়ের একটার পর একটা সাফল্য আসতে থাকে। কোথাও তাকে থেমে থাকতে হয়নি। তার প্রতিভা দেখে আমারও আগ্রহ বাড়তে থাকে যে—যদি একটু সহযোগিতা করা যায়, মেয়ে হয়তো আরও ভালো করতে পারবে।

তিনি জানান, ২০১৯ সালে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি থেকে তুরস্ক যান ইরা। সেখানে বিশ্বের ৪৫টি দেশের অংশগ্রহণে শিশু সমাবেশ হয়। বাংলাদেশ শিশু একাডেমির দলনেত্রী হিসেবে ওই আয়োজনে পুরস্কার পান ইরা। ফাহমিদা বলেন, মেয়ে যেন প্রকৃত মানুষ হয় এবং পড়াশোনার পাশাপাশি সে যা করছে তা চালিয়ে যাবে, এটাই আমার কাম্য।

ইরার বাবা আবু হায়াৎ মোহাম্মদ কামাল বলেন, প্রথম চাওয়া মেয়ে পড়াশোনা করে শিক্ষিত হবে এবং চাকরি করবে। আর দ্বিতীয়ত এ নাচকে সারাবিশ্বে পরিচিত করে দেশের সুনাম বয়ে নিয়ে আসবে। মেয়ে যতটুকু সামনে এগিয়ে যেতে পেরেছে সবটুকু চেষ্টা তার মায়ের। মেয়ের জন্য সে অনেক চেষ্টা ও ত্যাগ স্বীকার করেছে।

ইরার নাচের শিক্ষক ও নওগাঁর ‘নৃত্য রং একাডেমি’র প্রশিক্ষক সুলতান মাহমুদ বলেন, মোবাশ্বিরা কামাল ইরা ছোট থেকেই আমার কাছে নাচ শিখেছে। সব শিক্ষার্থীকে আমি আমার সন্তানের মতো ভালোবাসি। হাতেগোনা যে কয়জন প্রথম সারির শিক্ষার্থী রয়েছে সে তাদের মধ্যে একজন। সে খ্যাতি অর্জন করে নওগাঁবাসীর মুখ উজ্জ্বল করবে এটাই আমার চাওয়া। তার জন্য অনেক শুভ কামনা রইলো।

সম্পাদনা: আরএইচ

আপনার মতামত দিন

Android App
Android App
Android App
© Natun Feni. All rights reserved. Design by: GS Tech Ltd.