রাশেদুল হাসান
‘রোয়ানু’ একটি ঘূর্ণিঝড়ের নাম। শব্দটি মালদ্বীপের একটি আঞ্চলিক শব্দ। এর অর্থ ‘নারিকেলের ছোবড়ার তৈরি দড়ি। কোন বিবেচনায় এ ঘূর্ণিঝড়ের নাম ‘রোয়ানু’ দেয়া হয়েছে জানা না থাকলেও এর ভয়ঙ্কর পরিণতির কথা সবারই জানা। বাংলাদেশের উপকূলীয় অতিক্রম করবে রোয়ানু এমন তথ্য আবহাওয়া অধিদপ্তর দিয়ে আসছে। ২১ মে শনিবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা নাগাদ ‘রোয়ানু’ নোয়াখালী, লক্ষীপুর, ফেনীর সোনাগাজী উপকূল অতিক্রম করবে এমন তথ্যও সবার জানা। রোয়ানু’র ভয়ঙ্কর থাবায় শ্রীলঙ্কায় ৮০ জনের মৃত্যুর ঘটনায় দেশ ব্যাপী আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। দেশব্যাপী ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। উপকূলীয় জেলা গুলোতে শুক্র ও শনিবার সরকারী ছুটি বাতিল করা হয়েছে। এসব অঞ্চলে খোলা হয় কন্ট্রোলরুম।
পায়রা সমূদ্র বন্দর থেকে ১৩৫ কিলোমিটার দূরে উৎপন্ন ‘রোয়ানু’ ফেনীর সোনাগাজী উপকূলীয় অঞ্চল অতিক্রিম করবে। ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন একাধিকবার জরুরী সভায় বসে। শুক্র ও শনিবার এ জেলায়ও সরকারী ছুটি বাতিল করা হয়। সরকারী বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জড়ো হন সোনাগাজীতে। রেডক্রিসেন্ট, রেডক্রসসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ২ হাজারের অধিককর্মী ছুটে যান। এসব স্বেচ্ছাসেবীদের ৯২টি গ্রুপে বিভিক্ত করে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া হয়। প্রস্তুত রাখা হয় ৯৬টি মেডিকেল টিম। উপকূলীয় কয়েক হাজার মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে আসার নির্দেশ দেয় আবহাওয়া অধিদপ্তর। বিপদ সংকেত ৪ থেকে বাড়িয়ে ৭ করা হয়। উপকূলীয় এলাকার মানুষ নিরাপদ আশ্রয় যেতে মাইকিং শুরু হয়। খুলে দেয়া হয় উপজেলার ৩৮ আশ্রয়নকেন্দ্রসহ শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রশাসনের আগাম প্রস্তুতি ও স্বেচ্ছা সেবীদের অনুরোধে শুক্রবার রাতেই অনেক মানুষ আশ্রয়ন কেন্দ্রে অবস্থান করে। প্রস্তুত রাখা হয় চিড়া, গুড়সহ কয়েক ধরণের শুকনো খাবার। ঝড়ের তীব্রতা দেখে সকাল থেকে আশ্রয়ন কেন্দ্রে মানুষের ভীড় বাড়তে থাকে। মানুষ ঘরবাড়ী ছেলে ছেলে-মেয়ে গরু-ছাগল নিয়ে উঠে আশ্রয়ন কেন্দ্রে।
শনিবার সকালে ধেয়ে আসা রোয়ানু’র প্রভাবে বৃষ্টি ও ধমকা হাওয়া শুরু হয়। বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় গোটা জেলায়। বেলা বাড়ার সাথে সাথে সবার দৃষ্টি সোনাগাজী। প্রশাসনের লোকজন ছাড়াও সোনাগাজীতে জড়ো হয় বিভিন্ন মাধ্যমের সংবাকর্মীরা। এক অজানা আতঙ্ক চোখে-মুখে। বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় ‘রোয়ানু’ সম্পর্কে জানতে মোবাইল ফোনে অনলাইন গণমাধ্যমের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। কি হচ্ছে দেশে, ‘রোয়ানু’ কতটুকু আসছে এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে গোটা জেলায়।
দুপর ২টার দিকে সোনাগাজী উপকূলীয় এলাকায় ঝড়ের তান্ডব শুরু হয়। উপজেলার তিন ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রাম পানিতে তলিয়ে যায়। ‘রোয়ানু’র প্রভাবে উপজেলার চরখোয়াজ, চর খোন্দকার, জেলেপাড়া, দক্ষিণ চরচান্দিয়া, পূর্ব বড়ধলী, চরচান্দিয়া বেড়িবাঁধের বাইরের অংশ, বাহিরচর, চর নারায়ন ও চর আবদুল্লাহ এলাকায় ৫ থেকে ৬ ফুট পানি উঠে। এসব এলাকায় বাড়ি-ঘরে জোয়ারের পানি প্রবেশের পাশাপাশি কৃষি জমি ও মাছের ঘের তলিয়ে গেছে। ভেঙে পড়েছে রাস্তার গাছপালা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিভিন্ন ইউনিয়নের সংযোগ সড়ক।
দুটি বাংলাদেশের সমান ব্যাসার্ধ নিয়ে ধেয়ে আসা ‘রোয়ানু’ সোনাগাজী অতিক্রম করেছে এমন সংবাদে যেন স্বস্থি ফিরে আসে ফেনীর মানুষের মাঝে। আমরা গণমাধ্যামকর্মীরা ‘রোয়ানু’র ক্ষয়ক্ষতির খোঁজ-খবর নিয়ে ব্যস্ত। কোথাও কোন হতাহতের কোন খবর নেই। মনটা শান্তিতে ভরে উঠলো। সন্ধ্যায় খবর আসে উপজেলার চরচান্দিয়া ইউনিয়নের ভূঁইয়া বাজার এলাকার মহিষ আনতে গিয়ে পানিতে ডুবে নূর আলম নামে এক যুবক মারা যায়। প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও উদ্ধারকর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে রোয়ানু’র মত ভয়াবহ দূর্যোগ থেকে রক্ষা পেলেও সামান্য অসচেতনতায় প্রাণ গেল আলমের।
লেখাটা শুরু করেছিলাম ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ নিয়ে। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সাগর তীরের আট দেশের আবহাওয়া দপ্তর ও জাতিসংঘের এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের আবহাওয়া সংস্থা ‘এস্কেপ’ ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করে থাকে। প্রথম যে ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করা হয়েছিল, সেটা ছিল প্রায় তিনশ’ বছর আগে শ্রীলংকার মহাপরাক্রমশালী রাজা মহাসেনের নামে। ২০১৬ সালে মহাসেন আঘাত হেনেছে। ২০০৭ সালে আঘাত হানে ‘সিড়র’। শ্রীলঙ্কার দেয়া এ নামের অর্থ চোখ। এটি বাংলাদেশের উপর আঘাত হানে। ২০০৮ সালে ‘নার্গিস’ নামে একটি ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি দেশে আঘাত হানে। নামটি ভরতে দেয়া। জানা যায়, এটির নামকরণ করা হয়েছে ভারতীয় বিখ্যাত নায়িকা ‘নার্গিস’র নামানুসারে। এরপর ২০০৯ সালে বাংলাদেশের উপর দিয়ে ভয়ঙ্কর যে ঘূর্ণিঝড়টি বয়ে যায় তার নাম ‘আইলা’। মালদ্বিপের দেয়া এ ঘূর্ণিঝড়ের অর্থ ডলফিন বা শুশুক।
সবশেষে ধন্যবাদ দিতে চাই ফেনীর প্রশাসনকে। যাদের সঠিক দিক নির্দেশনায় এমন ভয়াবহ ক্ষতির হাত থেকে সোনাগাজী তথা ফেনী রক্ষা পেল। আর যারা জীবন বাজি রেখে সোনাগাজী উপজেলার মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন কৃতজ্ঞ তাদের প্রতি। সকালের সম্মিলিত প্রচেষ্টার রক্ষা পেলাম আমরা।
লেখক: সম্পাদক, নতুন ফেনী ডট কম