জাতীয় নির্বাচন ও আমাদের প্রত্যাশা • নতুন ফেনীনতুন ফেনী জাতীয় নির্বাচন ও আমাদের প্রত্যাশা • নতুন ফেনী
 ফেনী |
২৯ মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

জাতীয় নির্বাচন ও আমাদের প্রত্যাশা

রাশেদুল হাসানরাশেদুল হাসান
  প্রকাশিত হয়েছেঃ  ০৫:৫৫ অপরাহ্ণ, ১৩ নভেম্বর ২০১৮

গণতন্ত্রের জন্য মানুষের আকাঙ্খা সুপ্রাচীন। গণতন্ত্রের প্রতি মানুষের আকর্ষণ শ্বাশ্বত, গণতন্ত্রের আবেদন বিশ্বজনীন। ১৭৮৯ সালের ফরাসী বিপ্লব, ১৭৭৬ সালের আমেরিকান বিপ্লব এবং আধুনিক যুগের অন্যান্য বিপ্লব ও বিদ্রোহে গণতন্ত্রের বিজয় বার্তাই ঘোষিত হয়েছে বিশ্বের দিকে দিকে। গণতন্ত্র মানে গণমানুষের জন্য গণমানুষের শাসন ব্যবস্থা। মার্কিন ইতিহাসের মহানায়কদের অন্যতম দিকপাল আব্রাহাম লিংকন যখন এমন এক সরকারের কথা বলেন যা জনগণের জন্য, জনগণের সরকার এবং জনগণের দ্বারা নির্বাচিত তখন তিনি গণতান্ত্রিক সরকারের কথাই বলেন। গণতন্ত্র মানেই আইনের শাসন, প্রগতি ও উন্নয়ন। গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থা ছাড়া মানব সমাজে শুভ, কল্যাণ, উন্নয়ন ও অগ্রগতি সম্ভব নয়।

গত শতাব্দী (বিংশ শতাব্দী) মূলতঃ ছিল গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা ও বিজয়ের শতাব্দী। বিংশ শতাব্দীতে গণতন্ত্রের জন্য বিশ্বব্যাপী গণআকাঙ্খা ও গণসংগ্রাম যতটা জোরদার হয়েছে ততটা স্বাভাবিক কারণেই এর আগে হয়নি। গণতন্ত্রের পথে সকল বাধা ও বিপত্তি এবং গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থায় অগণতান্ত্রিক সকল কূপ্রথা এই শতাব্দীতে একের পর এক অপসারিত হয়েছে। এই শতাব্দীতে আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের মতো উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে নারীদের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর আগে তা ছিল না। বিংশ শতাব্দীতে চরমপন্থী, উগ্রবাদী ও অগণতান্ত্রিক সকল মতবাদ যেমন ফ্যাসিবাদ, নাজিবাদ এবং কমিউনিজমের উত্থান যেমন হয়েছে তেমনি একই শতাব্দীতে এসব মতবাদের পতনও হয়েছে। মানুষের গণতান্ত্রিক আশা আকাঙ্খার কাছে সামরিক একনায়কত্ব, রাজতন্ত্রসহ সকল ধরণের একনায়তন্ত্র ধ্বসে পড়েছে একের পর এক। সমরবাদী জাপানের দর্পচূর্ণ হয়ে আধুনিক গণতান্ত্রিক জাপান আত্মপ্রকাশ করেছে। যুদ্ধবাজ নাৎসি জার্মানী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে গণতান্ত্রিক মিত্র শক্তির কাছে। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে ভারত আত্মপ্রকাশ করেছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় ঘৃণিত বর্ণবাদের অবসান ঘটেছে। বিশ্বের দিকে দিকে রাজতন্ত্র আর রঙ বেরঙের স্বৈরশাসনের পরাজয় ঘটেছে। ইসরাইলের মতো জায়নবাদী (জাতিসংঘের ভাষায় যা বর্ণবাদ) রাষ্ট্র জাত্যাভিমান বিসর্জন দিয়ে আরব প্রতিবেশীদের সাথে আলোচনার টেবিলে বসেছে স্থায়ী শান্তির অণে¦ষায়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পেছনেও গণতন্ত্রের জন্য মানুষের সংগ্রাম এবং এক লোক এক ভোটের মাধ্যমে প্রতিফলিত ঐতিহাসিক গণরায় কাজ করেছিল বলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম সারাবিশ্বের, বিশেষ করে গণতান্ত্রিক বিশ্বের অকুন্ঠ সমর্থন লাভে সক্ষম হয়েছিল। যে সকল দেশের সরকার এই সংগ্রাম সরাসরি সমর্থন করেনি সে সব গণতান্ত্রিক দেশের মানুষও এই সংগ্রামে নৈতিক ও মানবিক সাহায্য সমর্থন যুগিয়ে ছিল। নতুবা দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশের রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর উত্তর পূর্বাঞ্চলে নতুন কোনো স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যূদয় মোটেও সহজ ব্যাপার ছিল না।

বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের পেছনে গণতন্ত্রের জন্য মানুষের আকাঙ্খার কথা স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকপালগণ সম্যকরূপে অবহিত ছিলেন। দেশ শত্রু মুক্ত হওয়ার পর তারা তা বিস্মৃত হননি। তারই প্রমাণ ১৯৭২ সালের নভেম্বর মাসে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধান। গণপ্রতিনিধিদের দ্বারা প্রণীত ও অনুমোদিত বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই সাংবিধানিক দলিলে গণতন্ত্রকে এই রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বস্তরে গণতান্ত্রিক বিধিবিধান, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি চর্চার রূপরেখাও এই সংবিধানে মূর্ত ও বিধৃত হয়েছে।

গণতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায়বিচার আমাদের সংবিধানের অন্যতম স্তম্ভ হলেও আমাদের দেশের গণতন্ত্র চর্চার পরিসরটা এখনও মসৃণ হয়ে ওঠেনি বরং বারবার কন্টকিত ও কলঙ্কিতই হয়েছে। অনেকটা আনুষ্ঠানিকতা ও নিয়মরক্ষার গণতন্ত্রই চালু আছে আমাদের দেশে। আর সে ধারা এখনও অব্যাহতই আছে এবং ব্যতিক্রম কিছু না ঘটলে আগামী দিনেও থাকবে বলেই মনে করার যথেষ্ঠ কারণ আছে বৈকি! আমাদের কেতাবে অনেক কিছুই থাকলেও গোয়াল যে প্রায় শূন্য তা বলতে খুব একটা পান্ডিত্য অর্জনের প্রয়োজন নেই। আসলে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার জন্যই আমরা মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম। কিন্তু যে আশায় বুক বেঁধেছিলাম তা অনেকাংশের পূরণ হয়নি বরং আমাদেরকে বারবার আশাহতই হতে হয়েছে।

মূলত স্বাধীনতা প্রত্যেক জাতির জন্যই আরাধ্য ও কাঙ্খিত। কিন্তু আমরা এমনই এক দুর্ভাগা জাতি যে, অনেক ত্যাগ ও কোরবানীর বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করলেও স্বাধীনতার সুফলগুলো আজও অনেকটা অধরাই রয়ে গেছে। আমাদের কাঙ্খিত গণতন্ত্রও হাতে এসে ধরা দেয়নি। স্বাধীনতা পূর্ব সময়ে আমাদের গণতন্ত্র যেভাবে সমস্যা শংকুল ছিল প্রায় পাঁচ দশক অতিক্রান্ত হওয়ার পরও আমরা সে সংকীর্ণতার ঘুর্ণাবর্তেই ঘুরপাক খাচ্ছি। তেমন হেরফের হয়েছে বলে মনে হয় না। যা আমাদের জন্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক।

জনগণের ভোটাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা এক দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সে গণতন্ত্রই বারবার সংকটের মুখে পড়েছে। একশ্রেণির রাজনৈতিক মতলববাজ গণতন্ত্র নিয়েই খেলেছেন, এখনও খেলছেন এবং আগামী দিনে যে এর অন্যথা ঘটবে তেমনটা মনে করার মত কোন আভাস আপাত পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা গণতন্ত্রের নামে অনেক লম্বা-চওড়া কথা বললেও নিজেরা এখনও পুরোপুরি গণতন্ত্র মনস্ক হতে পারিনি। এমনকি আমাদের মানসিক দাসত্ব থেকেও বেরিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। আর মানসিকভাবে দাসপ্রবণ কোন জাতিই গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার সুফল পেতে পারে না। খুব সঙ্গত কারণেই আমরা গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিবর্তে আত্মতন্ত্র চর্চায় অভ্যস্ত হয়েছি। এ মুদ্রাদোষ থেকে আমরা কোন ভাবেই বেরিয়ে আসতে পারছি না। গণতন্ত্রকে বানিয়েছি রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার মোক্ষম হাতিয়ার। যা আমাদের জাতীয় জীবনের অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে।

আমাদের দেশের প্রচলিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কথিত গণতন্ত্রের মহাজনেরা উপকৃত হচ্ছেন। উপেক্ষিত থাকছেন দেশের সাধারণ মানুষ। এমনকি দালাল-ফড়িয়ারাও কম যাচ্ছে না। কিন্তু আমজনতার ভাগ্যে অশ্বডিম্ব বৈ কিছুই জুটছে না। জনগণের স্বার্থ ও গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পক্ষে অনেক চটকদার কথা বলা হলেও আমাদের দেশের প্রচলিত গণতন্ত্র একটা সংকীর্ণ গলি পথেই আটকে গেছে। সেখান থেকে অগ্রপশ্চাৎ কোন দিকেই বেরিয়ে আসা সম্ভব হচ্ছে না বরং সময় যত যাচ্ছে ততই সম্ভবনাগুলোরও একের পর এক অপমৃত্যু ঘটছে। আর এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে আমাদের ভবিষ্যৎ যে কুসুমাস্তীর্ণ হবে না, বরং কন্টকাকীর্ণ হবে তা অন্তত দিব্যি দিয়েই বলা যেতে পারে।

বর্তমান গণতান্ত্রিক বিশ্বে একথা অনস্বীকার্য যে, গণতান্ত্রিক বিশ্বের কোন দেশের গণতন্ত্রই বিতর্ক মুক্ত নয়। বিশ্বের গণতন্ত্রের সূতিকাগার খ্যাত আমেরিকার নির্বাচন নিয়েও বিতর্ক হয়। কিন্তু তা খুবই সীমিত পরিসরে। তা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা থাকলেও তা একেবারে সহনীয় মাত্রায়। তাই প্রত্যেক দেশের নির্বাচন নিয়ে টুকটাক আলোচনা-সমালোচনা থাকলেও নির্বাচন অগ্রহণযোগ্য ও বাতিলযোগ্য হয়েছে মর্মে কোন প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু আমাদের দেশই বোধহয় সে ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। কারণ, স্বাধীনতা পরবর্তী আমাদের দেশের নির্বাচন নিয়ে সূক্ষ্ম কাপচুপি, পুকুরচুরি ও সাগর চুরির অভিযোগ রয়েছে। এমন অভিযোগ বিশ্বের অন্যকোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কালেভদ্রেও শোনা যায় না। কিন্তু আমাদের দেশে এসব অভিযোগ অনেকটা ধাত সওয়া হয়ে গেছে। তাই এসব নিয়ে যাদের ভাবা ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার তারা ভাবেন না। আর যারা ভাবেন তাদের হাতে করার মত কিছু থাকে না। সঙ্গত কারণেই এই বিতর্ক নিরসনে আমরা এখনও কোন গ্রহণযোগ্য ও সমাধানযোগ্য ফর্মূলা বের করতে পারিনি। বিষয়টি নিয়ে মাঠ গরম আর পানি ঘোলা যে হয়নি এমন নয়। কিন্তু অর্জনটা প্রায় অন্তঃসারশূণ্য বলে মনে করার যথেষ্ঠ কারণ আছে।

দেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার ধারণা থেকেই যে স্বাধীনতা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছিল এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। এর জন্য আমাদেরকে একটু অতীতের দিকেই তাকাতে হবে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক আইনসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল। পূর্ব পাকিস্তান কোটার ২ টি আসন ছাড়া বাকি সবগুলোতে জয়ী হওয়ার জন্য জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠতাও অর্জন করেছিল বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ। নির্বাচনের ফলাফল পাকিস্তানের দু’ অংশের মধ্যে মেরুকরণ সৃষ্টি করে। পশ্চিম পাকিস্তানের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো, মুজিবের স্বায়ত্বশাসনের নীতির প্রবল বিরোধিতা করেন। ভুট্টো এ্যাসেম্বলি বয়কট করার হুমকি দিয়ে ঘোষণা দেন যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান মুজিবকে সরকার গঠনের জন্য আহ্বান জানালে তিনি সে সরকারকে মেনে নেবেন না। উদ্ভূত পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে ইয়াহিয়া খান সংসদ ডাকতে দেরি করছিলেন। ফলে পূর্ব পাকিস্তানীরা উপলব্ধি করতে পারে যে, আওয়ামী লীগকে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও সরকার গঠন করতে দেয়া হবে না। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় শেখ মুজিব জনগণকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। পরিস্থিতি মোকাবেলায় ইয়াহিয়া খান সামরিক আইন জারি করেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা এবং শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতাদের গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী রাজনৈতিক ও জনসাধারণের অসন্তোষ দমনে ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট শুরু করে। পরবর্তীতে স্বাধীনতার ঘোষণা আসে। মূলত আমাদের নায্য অধিকার ও গণতন্ত্রের সংকট থেকেই মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয় এবং অনেক ত্যাগের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করলে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামের শিশু রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। কিন্তু অতীব পরিতাপের বিষয় যে, যে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধিকার অর্জন করেছিলাম তা কিন্তু আজও অধরাই রয়েছে গেছে।

গণতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্যই আমরা মুক্তি সংগ্রামে অবর্তীর্ণ হয়েছিলাম। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পাক শাসকচক্র নির্বাচনের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতির কারণেই পাকিস্তানে অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। পরবর্তীতে তা সর্বাত্মক স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নেয়। কিন্তু যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে আমরা মুক্তি সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলাম সে গণতন্ত্রকে আজও শৃঙ্খলমুক্ত করা সম্ভব হয়নি। অতীতে সমস্যা যে তিমিরে ছিল সে তিমিরে রয়ে গেছে। এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে তার অবনতিও লক্ষ্য করা গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে যার বাস্তব প্রমাণও মিলছে।

স্বাধীনতা পূর্ব সময়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করা হলেও জনগণ নির্বিঘেœ ভোট দিতে পেরেছিল এবং জনমত যাচাই করা সম্ভব ছিল। এখন সে পথও রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়ে পড়েছে। কাগজে-কলমে গণতন্ত্রের কথা বলা হলেও দেশের মানুষ আর নির্বিঘেœ ভোট দিতে মোটোই স্বাচ্ছন্দবোধ করেন না বরং নির্বাচন জনমনে একটা অনাকাঙ্খিত ভীতির সঞ্চার করে। আমাদের দেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর জনগণের আস্থা এখন প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। কারণ, তারা ধরেই নিয়েছেন যে, আমাদের দেশের সাম্প্রতিক সময়ের নির্বাচনগুলোতে জনমতের প্রতিফলন ঘটে খুবই সামান্য। তাই এই বিষয়ে তাদের আগ্রহটা এখন রীতিমত তলানীতে নেমে এসেছে।

স্বাধীনতা পরবর্তীতে আমাদের দেশে এ পর্যন্ত জাতীয় সংসদের ১০টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে কোন নির্বাচনই বিতর্কের উর্ধ্বে উঠে অনুষ্ঠিত করা সম্ভব হয়নি। শুধুমাত্র ১৯৯১ সালের পঞ্চম ও ২০০১ সালের নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অন্য নির্বাচনগুলোর চেয়ে অপেক্ষাকৃত গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। কিন্তু তা স্বত্ত্বেও নির্বাচনে পরাজিত দলগুলো নির্বাচনে অনিয়ম হয়েছে মর্মে অভিযোগ তুলেছিল। তবে তা নির্দলীয় সরকারের অধীনে হওয়ায় খুব একটা হালে পানি পায়নি। নবম সংসদের নির্বাচন জরুরি সরকারের অধীনে হলেও এ নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্কের কোন অন্ত ছিল না এবং এখনও নেই।

যাহোক স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ৩টি জাতীয় সংসদের নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের অধীনে হওয়ায় তা অনেকাংশে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে অপেক্ষাকৃত গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। কিন্তু আপরাপর নির্বাচনগুলো কোন মহলেরই কাছেই পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য বা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠেনি। আমাদের দেশের চরম বাস্তবতায় নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। কিন্তু আমাদের ভাগ্যটা মোটেই সুপ্রসন্ন ছিল না। তাই জাতীয় ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতির সুফলও আমরা ধরে রাখতে পারিনি। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। আমাদের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এখন মারাত্মক হুমকীর মুখে পড়েছে। দেশের নির্বাচন ব্যবস্থার ভিত্তি এখন খুবই ভঙ্গুর। রাজনৈতিক পক্ষগুলো কেউ কারো ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। এতে দেশে এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আর রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবেই আমরা সেই সংকীর্ণ বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে একাদশ সংসদ নিবার্চন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু আগামী দিনের নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো এখনও কোন ঐক্যমতে পৌঁছতে পারেনি। ফলে দেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট ক্রমেই অবনতির দিকেই যাচ্ছে। একটি নির্বাচন অবাধ, নিরেপক্ষ ও সুস্থ হওয়াসহ সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সত্যিকার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হলে; একটি আদর্শ বিচারিক কাঠামো গঠন করা, নিরপেক্ষ প্রশাসন ও সেই সাথে সুষ্ঠু অংশগ্রহণ মূলক নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত জাতীয় সংসদ প্রতিষ্ঠা জরুরী। আমাদের মত দেশে যেখানে মতবিরোধ অত্যন্ত প্রবল, নিজ দলের বাইরে অন্য কারো মতের কোন মূল্য নেই। যেখানে ব্যক্তিস্বার্থ দল বা দেশের স্বার্থের উর্ধ্বে। যেখানে দলের ভেতর গণতন্তের চর্চা নেই বললেই চলে। শাসকদল সর্বদা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে চায় সেখানে সত্যিকার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত কঠিন।
বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে, আগামীর জন্য সুস্থ ও টেকসই নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে বিএনপি, আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য দলের উচিত আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার পথ তৈরি করা। আমরা কোন আনুষ্ঠানিকতা বা নিয়মরক্ষার নির্বাচন দেখতে চাই না বরং এমন একটি নির্বাচন চাই যে নির্বাচনে জনগণের মতামতের বাস্তব প্রতিফলন ঘটবে এবং দেশে প্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। জাতি প্রত্যাশা করে অংশগ্রহণকারী ক্ষমতাসীন দল, জোট এবং বিরোধী দলগুলো পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করে নির্বাচনী সংস্কৃতিকে সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে নিতে যত্মবান হবেন। অন্যথায় আমাদের গন্তব্য হবে একেবারেই লক্ষ্যহীন। আমরা শুধু নষ্ট নির্বাচনী সংস্কৃতির ঘূর্ণিপাকে ঘুরতে থাকব; সোনার বাংলার স্বপ্ন থেকে যাবে অধরাই।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক

আপনার মতামত দিন

Android App
Android App
Android App
© Natun Feni. All rights reserved. Design by: GS Tech Ltd.