বিলোনিয়া যুদ্ধের রণকৌশল ও ফেনী মুক্ত দিবস • নতুন ফেনীনতুন ফেনী বিলোনিয়া যুদ্ধের রণকৌশল ও ফেনী মুক্ত দিবস • নতুন ফেনী
 ফেনী |
২৮ মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৪ চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

বিলোনিয়া যুদ্ধের রণকৌশল ও ফেনী মুক্ত দিবস

রাশেদুল হাসানরাশেদুল হাসান
  প্রকাশিত হয়েছেঃ  ১২:০১ অপরাহ্ণ, ০৬ ডিসেম্বর ২০১৮

বৃটিশ শাসকগোষ্ঠির বিরুদ্ধে, বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে ১৯০৫ সালের পর হতে বাঙালির স্বদেশী আন্দোলন, সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন সহ চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন এবং ২য় মহাযুদ্ধের শেষে রণক্লান্ত বৃটিশ সরকার ভারতকে দুই ভাগ করে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান-ভারত দুইটি রাষ্ট্র উপহার দিয়ে যায়। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের দুইটি ভূখন্ডের মাঝখানে ১২০০ মাইল ব্যবধান। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা ছিল বাংলা, যা ৫৪.৬% এবং বাদবাকিরা বিভিন্ন ভাষাভাষী। রাষ্ট্রভাষাকে কেন্দ্র করে ১৯৪৮ সালে ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ আন্দোলন শুরু হয় এবং ১৯৫২ সাল পর্যন্ত চলতে থাকে।

১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্ট ২১ দফা কর্মসূচী দিয়ে অকল্পনীয় সাফল্য লাভ করে। এতে পশ্চিম পাকিস্তানী নেতারা ভীষণ ক্ষুব্ধ হয় এবং পূর্ব পাকিস্তানে যুক্তফ্রন্টকে মন্ত্রীসভা গঠন করতে দিতে রাজী ছিলনা। শেষ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর চৌধুরী খালেকুজ্জামানের প্রচেষ্টায় শেরেবাংলার নেতৃত্বে মন্ত্রীসভা গঠিত হলেও তা টিকতে দেয়নি। ১৯৫৪ সালের পরবর্তী দীর্ঘ সময়ে পাকিস্তানে চলেছে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি। সমগ্র দেশে চলেছে দূর্নীতি। পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের স্পিকার আবদুল হাকিমের পরিবর্তে ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলীকে দায়িত্ব দেয়া হয়। তখন আইন পরিষদের অধিবেশনে ২৬ সেপ্টেম্বর দুই দলের চেয়ার মারামারিতে আহত হন ডেপুটি স্পিকার। পরবর্তীতে তিনি হাসপাতালে মৃত্যু বরণ করেন। এই মৃত্যুকে কেন্দ্র করে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা ৭ অক্টোবর দেশে সামরিক আইন জারী করেন, ৮ অক্টোবর উহা কার্যকর হয়। এরপর সেনা প্রধান জেনারেল আইউব খান ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ক্ষমতায় বসেন। ১৯৬৫ সালে মৌলিক গণতন্ত্রের ভিত্তিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আইউব খান কৌশলে বিজয়ী হন। পাক-ভারত যুদ্ধের পর ১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামীলীগের ওয়ার্কিং কমিটিতে ৬ দফা অনুমোদন করলে উহা শেখ মুজিবুর রহমান উত্থাপন করেন। পাকিস্তান সরকার বহু রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা, জেল-জুলুম, হামলা শুরু করে। উহার প্রেক্ষিতে ৬৬ সালের ৮ মে শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হন। তাঁর নিঃশর্ত মুক্তির দাবীতে ৭ জুন হরতাল পালিত হয়। ঐ হরতাল পালন কালে মনু মিয়া সহ ১১ জন পুলিশের গুলিতে নিহত হন। প্রায় ১১ মাস জেলে থাকার পর শেখ মুজিবুর রহমান ৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি গভীর রাতে ছাড়া পেলেও জেল গেট পেরুতে না পেরুতে মিলিটারি ভ্যান সামনে এসে হাজির হয় এবং তাকে পুনরায় গ্রেফতার করে ঢাকা সেনানিবাসের একটি কক্ষে আটকে রেখে সাজানো হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। আরো অনেককে এতে আসামী করা হয়। আসামীদের খতম করার জন্য চালানো হয় বিভিন্ন রকম ষড়যন্ত্র ও অন্যায়, অত্যাচার, নির্যাতন। উক্ত মামলার আসামীদের গোপনে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন একজন বাঙালি সামরিক অফিসার সাদেকুর রহমান চৌধুরী। এ মামলার শুনানী হয় ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন ও ২৯ জুলাই। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাকে কেন্দ্র করে গণ-আন্দোলনের উচ্চারণ ছিল স্পষ্ট, যা “জাগো বাঙালি জাগো,” “বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর,” “আমার দেশ, তোমার দেশ-বাংলাদেশ, বাংলাদেশ,” ধ্বনি ও “জয় বাংলা” শ্লোগানের মাধ্যমে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ঘেরাও আন্দোলন শুরু হয়। ৬ ডিসেম্বর, ১৯৬৮ সালে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর পল্টনের জনসভায় জনতার গর্জন ছিল-জেলের তালা ভাঙব,শেখ মুজিবকে আনব। ভাসানী সেদিন লাট ভবন ঘেরাও করেছিলেন। ৭ ডিসেম্বর, ১৯৬৮ সালে হরতালের দিনটি ছিল অবিশ্বাস্য ও অভূতপূর্ব। মিলিটারির গুলি জনতাকে থামাতে পারেনি। সেদিন হরতালে বহু লোক আহত-নিহত হয়। মাওলানা ভাসানী ৮ ডিসেম্বর বায়তুল মোকাররমের সামনে হরতালে নিহতদের গায়েবানা জানাজা পড়েন। আন্দোলন চলতে থাকে।

১৯৬৯ সালে সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের গণঅভ্যূত্থানের পেছনে ৬ দফা ও ১১ দফার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। ১৯ জানুয়ারি, ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে। ২০ জানুয়ারি পুলিশ-ইপিআর এর সাথে ছাত্র-যুবকেরা বীর বিক্রমে লড়াই করেছিল। এ সময় মিছিলে ব্যান্ডেজ বাঁধা কৃষক নেতা আসাদুজ্জামানকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছিল। তাঁর লাশ ছিনিয়ে নেয়ার জন্য জনতা পুলিশের সাথে মুখোমুখি লড়াই করে। ২৪ জানুয়ারি আহুত প্রতিবাদ দিবস হয়ে উঠল গণ-অভ্যূত্থান দিবস। সচিবালয়ের সামনে কিশোর রুস্তম আলী, মকবুল, ৯ম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান পুলিশের গুলিতে নিহত হল। ঐ নিহতদের লাশ নিয়ে জনতা বিশাল মিছিল বের করে এবং বহু পাকিস্তানী আমলার বাস ভবনে অগ্নি সংযোগ করে। অপরদিকে পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচারাধীন বন্দিদের হত্যা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকে। কাশ্মিরী অফিসার লেঃ নাসিরুদ্দিনের অসতর্কতায় শেখ মুজিব বেঁচে গেলেন। কিন্তু সার্জেন্ট জহুরুল হক রেহাই পেলেন না। ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯ সালে ভোর বেলায় তাঁকে জেলের ভিতর নৃশংসভাবে হত্যা করে। ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

প্রাঙ্গণে ডঃ শামসুজ্জোহাকে বেয়নেট আর বুলেট দিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। সে রাতে কারফিউ ভঙ্গ করে হাজার হাজার মানুষ সামরিক বাহিনীর সাথে বীরের মত লড়াই করেছিল, তখন আইউব খানের পতন অনিবার্য হয়ে উঠল। ২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯ সালে ভাইস-এডমিরাল এজি খান ঢাকায় এসে ঘোষণা করলেন-আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করা হল। এরপর সকল আসামীকে মুক্তি দেয়া হয়।

১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রেস্কোর্স ময়দানে ঢাকার বিশাল জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান সহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার খালাসপ্রাপ্ত আসামীদের সম্বর্ধনা দেয়া হয়। এ সম্বর্ধনা সভার আয়োজক ছিলো ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম প্রধান অঙ্গ সংগঠন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়ন, ডাকসু ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ। উক্ত সম্বর্ধনায় বাংলার সাতকোটি মানুষের ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে ছাত্র সমাজের নেতা, ডাকসু’র ভাইস-প্রেসিডেন্ট জনাব তোফায়েল আহমেদ বাংলার মানুষের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে এক মহা গৌরবের সম্মান উপহার দিলেন- “বঙ্গবন্ধু।” এক্ষণ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এ রূপান্তরিত হলেন।

বাঙালিদের তীব্র আন্দোলনের মুখে টিকতে না পেরে প্রেসিডেন্ট আইউব খান সেনা প্রধান ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ২৫ মার্চ, ১৯৬৯ রাজনীতি থেকে বিদায় নেন। ইয়াহিয়া খান প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ক্ষমতায় থেকে পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণীঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বহু লোক মারা যায়। ৭ ডিসেম্বর জাতীয় ও ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের তারিখ স্থির করা হয়। উক্ত নির্বাচনে আওয়ামীলীগ জাতীয় পরিষদে ১৬৭ আসন ও প্রাদেশিক পরিষদে ২৯৮ আসন পেয়ে জয়লাভ করে। এ বিপুল জয়ের পরও আওয়ামীলীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ইয়াহিয়া খান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে যোগসাজশ করে বিভিন্ন অপকৌশল শুরু করে, কেননা নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী ক্ষমতা হস্তান্তর করলে আওয়ামীলীগ তথা বঙ্গবন্ধুর হাতে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ক্ষমতা চলে যাবে।

১৯৭১ সালের ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। এর বিরুদ্ধে দেশব্যাপী বিক্ষোভ মিছিল, প্রতিবাদ সমাবেশ আরম্ভ হল। পাকিস্তানী বাহিনীর জুলুম অত্যাচারও বৃদ্ধি পেল। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ২ মার্চ হরতাল পালন করে। এসময় আসম আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখন, নুরে আলম সিদ্দিকী এবং শাহজাহান সিরাজের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। শাহজাহান সিরাজ স্বাধীন বাংলার ইশতেহার পাঠ করেন এবং আসম আবদুর রব পাকিস্তানী পতাকার পরিবর্তে সর্বপ্রথম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করা হয়। ৩ মার্চ হতে সারাদেশে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। ৭ মার্চ রেসকোর্স মাঠে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক জনসভায় স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের দিক নির্দেশনামূলক বক্তব্য রাখেন, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার। ১৫ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান কুমতলব নিয়ে ঢাকায় আসেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনার নামে সময় ক্ষেপন করতে থাকেন। পূর্বপাকিস্তানে আন্দোলনের ভয়াবহতা দেখে জেনারেল টিক্কা খানকে সামরিক আইন প্রশাসক ও গভর্নর নিয়োগ করেন। এ দিকে ১ মার্চ হতে ২৩ মার্চ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তান হতে অস্ত্র, গোলাবারুদ এনে গোপনে জমা করা হতে থাকে। ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান সামরিক বাহিনীকে বাঙালি নিধনের নির্দেশ দিয়ে ঢাকা ত্যাগ করেন।

২৫ মার্চের কালোরাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম গণহত্যা শুরু করে। নিরীহ ঘুমন্ত বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সর্বশক্তি নিয়ে। ২৬ মার্চ রাত ১টায় বঙ্গবন্ধু ওয়্যারলেস সেটের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষনা দেন। ঘোষনাপত্রটি টেলিগ্রামের মাধ্যমে দেশের সকল সদরে প্রেরন করা হয়। উক্ত পত্রটি চট্টগ্রামে এমএ হান্নানের নিকট যাওয়ার পরেই তিনি বেলা দুইটার সময় এটি প্রচার করেন। আবার সন্ধ্যা ৭.৪০টায় এটি প্রচার করা হয়। ২৭, ২৮ ও ৩০ মার্চ উক্ত ঘোষনাটি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মেজর জিয়াউর রহমানের কন্ঠে ধারন করে ঘোষনা পাঠক হিসাবে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার করা হয়। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর গণহত্যার কারনে ঢাকা সহ বিভিন্ন শহর হতে বাঙালিরা আত্মরক্ষার জন্য গ্রামে ও সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আশ্রয় নিতে শুরু করে। তাৎক্ষনিক ভাবে আওয়ামীলীগের সংগ্রাম কমিটি ও নেতৃবৃন্দের আহবানে সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্য ও সর্বস্তরের জনগণ হানাদার বাহিনীর সাথে মোকাবেলা করার জন্য প্রতিরক্ষা ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির লক্ষ্যে স্থানীয়ভাবে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ শুরু করে।

ফেনীর উত্তর পূর্বাঞ্চলের দৈর্ঘ্যে প্রায় ২০ মাইল প্রস্থে ৮ মাইল তিনদিকে ভারত বেষ্টিত এ এলাকাটি দেখতে পকেটের মত। অত্র এলাকার আদি নাম রৌশনাবাদ এর অংশ খন্ডল পরগনা। তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালির সর্বপ্রকার আন্দোলন ও খন্ডলের ন্যায্য দাবী-দাওয়ার তুখোড় আন্দোলনকারী হিসেবে পরিচিত নাম জাহাঙ্গীর খন্ডলী এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে একজন মহান সংগঠক। মুক্তিযুদ্ধে রণকৌশলের জন্য এ অঞ্চলটি একটি মডেল। মুক্তিযুদ্ধের শুরু হতে শেষ পর্যন্ত এখানে যতগুলো যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে, সেগুলো বিলোনিয়ার যুদ্ধ হিসেবে ব্যাপক ভাবে প্রচারিত ও পরিচিত। ২৭ মার্চ হতেই সীমান্তের ক্যাম্পগুলিতে যে সব অবাঙালি ইপিআর ছিল তাদের সারেন্ডার করানোর জন্য স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতা আমিনুল করিম মজুমদার খোকা মিয়া ও মৌলভী আজিজুল হক মজুমদার সহ প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য এএফকে সফদারের নির্দেশে কার্যক্রম চলতে থাকে। ২৮ মার্চ ক্যাপটেন (অবঃ) এম ইসহাক এর নেতৃত্বে সুবেদার (অবঃ) ইমাম হোসেন ও সুবেদার মিজানুর রহমানসহ অন্যান্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের পরশুরাম পাইলট হাইস্কুল মাঠে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করেন।

অপর দিকে আবদুর রহিম মাহমুদের তত্ত্বাবধানে পরশুরাম সিও অফিসের পশ্চিম পাশের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। উক্ত ক্যাম্পে মোঃ শহীদ উল্লাহ বাবুল ও নুরুল ইসলাম মজুমদার দুইজন দুই দায়িত্বে কর্মরত ছিলেন। ৪ এপ্রিল বিলোনিয়া সীমান্তে মজুমদার হাট ইপিআর ক্যাম্পে অবাঙালি ইপিআরদের সারেন্ডার করানোর জন্য ক্যাঃ ইসহাকের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা সকাল থেকে প্রস্তুতি চালায় এবং বিকাল চারটা হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত অক্লান্ত চেষ্টা চালিয়ে তারা সফল হলেও মুক্তিবাহিনীর রৌশন ও আজিজ হানাদারদের গুলিতে শহীদ হন।

এদিকে ছাগলনাইয়াতে ২৬ মার্চ, ১৯৭১ এ সকাল প্রায় ১১ টার দিকে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ছাত্রনেতা মীর আবদুল হান্নান ও ফয়েজ আহমদ এবং ইসমাইল হোসেন ছাগলনাইয়া হতে ভারতের শ্রীনগরে বিএসএফ ক্যাম্পে যান। তাঁরা ক্যাপ্টেন পিকে ঘোষ এর সাথে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। এ সময় পিকে ঘোষ বাঙালিদের ভারতে আসা-যাওয়ার মৌখিক অনুমতি দেন এবং ২৮ মার্চ হতে ছাগলনাইয়া স্কুল/মাদরাসা মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ চলতে থাকে। সীমান্তে যে সকল অবাঙালি ইপিআর ছিল, তাদের সারেন্ডার করানোর কার্যক্রম চলতে থাকে। হানাদার বাহিনী ছাগলনাইয়া প্রবেশের পর স্থানীয় প্রশিক্ষণরত মুক্তিযোদ্ধারা শ্রীনগর, নলুয়া, হরিণা, দুমইখ্যা ও মনুতে চলে যায় এবং পরবর্তী সময়ে মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রশিক্ষণ নিয়ে সম্মুখ যুদ্ধ ও গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেয়। এছাড়া ফেনীর দক্ষিণ ও পূর্ব অঞ্চলটি ছিল গেরিলা বাহিনী ও বিএলএফ এর আক্রমণের বিশেষ স্থান।

১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল সিলেট জেলার তেলিয়াপাড়ায় চা বাগানে বাঙালি অফিসারগন মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার ব্যাপারে এক আলোচনায় মিলিত হন। এ বৈঠকে কর্নেল এমএজি ওসমানীকে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর প্রধান ও মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ঘোষনা করা হয় এবং সমগ্র দেশকে ৪টি অঞ্চলে ভাগ করে ৪জন অফিসারকে এলাকার স্থান নির্ধারণ করে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। ৬ এপ্রিল থেকে পাকিস্তানীরা ঢাকা হতে দেশের বিভিন্ন স্থানে সৈন্য পাঠাতে থাকে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১০ এপ্রিল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে এ সরকার আত্মপ্রকাশ করে ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ সালে। দেশের বিভিন্ন স্থানে বাঙ্গালী যোদ্ধারা প্রয়োজনীয় অস্ত্রের অভাবে পাকবাহিনীর এই চলাচলে বাধা দিতে পারেনি। হানাদার বাহিনী ফেনী দখল করার পর শহরের উত্তরে দোস্ত টেক্সটাইল মিলস পর্যন্ত তাদের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে নেয়। এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে ক্যাপটেন জাফর ইমাম তাঁর সহযোগী অফিসার এবং অধীনস্থ বাহিনী নিয়ে মুন্সীর হাট-বন্ধুয়ায় ডিফেন্স স্থাপন করার প্রাক্কালে ফুলগাজী ও বন্ধুয়ার ব্রীজগুলি উড়িয়ে দেয়া হয়। ১ জুন থেকে ১৮ জুন পর্যন্ত পাকবাহিনীর সাথে মুক্তিবাহিনীর বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ চলে। এ যুদ্ধে মন্সীর হাট মোক্তার বাড়ী কাচারী ঘরে পাকবাহিনীর আর্টিলারী গোলাবষর্নের আঘাতে হাবিলদার নুরুল ইসলাম শহীদ হন।

হানাদার বাহিনীর ঢাকা-চট্টগ্রাম চলাচলের মধ্যবর্তী পয়েন্ট ফেনী হওয়ায়, ফেনীকে দখলে রাখার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে। ১৮ জুন হানাদারদের প্রচন্ড আক্রমনে টিকতে না পেরে মুক্তিবাহিনী ডিফেন্স ছেড়ে দিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। ফলে ফেনী হতে বিলোনিয়া পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীর হাতছাড়া হয়ে যায়।

উক্ত অবস্থার প্রেক্ষিতে স্থানীয় সকল নেতৃবৃন্দ সহ জনগন ভারতে আশ্রয় নেয়ার পর মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন সেক্টরের সাব সেক্টরের সদরদপ্তর ভারতের বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করা হয়। অপর দিকে ভারতের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প হতে প্রশিক্ষিত যোদ্ধারা সদর দপ্তরে একত্রিত হলে নিয়মিত বাহিনী জোরদার হতে লাগল। ২ নং সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপটেন জাফর ইমাম মুহুরী নদীকে কেন্দ্র করে নদীর উত্তর পশ্চিম অংশে প্রতিরক্ষা পরিখা স্থাপন করেন। ১ নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর রফিকুল ইসলাম তাঁর সদর দপ্তর হরিনা হতে গুথুমার পূর্বে ভারতের সোনাইছড়ি এলাকায় স্থানান্তর করেন। আগস্ট মাসের দিকে মুক্তিবাহিনীর সমর কৌশলের দিক হতে ফেনীর উত্তর-পূর্বাঞ্চলটি অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হওয়ায় ‘সম্মুখ সমরের’ পরিকল্পনার প্রস্তুতির আলোকে, ভারতীয় মিত্র বাহিনীর প্রচেষ্টায়, লেঃ জেনারেল সগত সিং এর অধীনে, ২৩ মাউন্ট ডিভিশনের অধিনায়ক জেনারেল আরডি হীরা, বিএসএফ মেজর জেএন প্রধান এর পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের নিয়ন্ত্রণে রণক্ষেত্রের সকল তথ্য প্রদানের জন্য, যা ফেনীর উত্তর-পূর্বাঞ্চলের লোকেশান, রাজনৈতিক ব্যক্তি, স্বাধীনতা বিরোধী বিভিন্ন শত্রুর অবস্থানের উপর জ্ঞান, ধারণা, দক্ষতা আছে, এ ধরনের একজন বিশ্বস্ত ২০/২১ বছর বয়সী যুবকের সন্ধানে জেনারেল আরডি হীরা ও মেজর জেএন প্রধান ভারতের বিলোনিয়া শহরের বনকর এলাকায় তৎকালীন জাতীয় সংসদ সদস্য, বৃহত্তর নোয়াখালীর পলিটিক্যাল চীফ, জননেতা খাজা আহমদের কার্যালয়ে অন্যান্য দায়িত্ববান আওয়ামীলীগ নেতাদের সাথে উক্ত ব্যাপারে এবং রণক্ষেত্রের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এক সভায় মিলিত হন। আলোচনাক্রমে সাহসী যুবকের অনুসন্ধানের প্রস্তাব আসলে যাচাই বাছাইয়ের মাধ্যমে তখনকার প্রবীণ রাজনৈতিক ব্যক্তি, মহকুমা আওয়ামীলীগের সম্পাদক এমএস হুদা (টুকটাক হুদা)’র প্রস্তাবে, জনাব খাজা আহমদ সহ সকলের সমর্থনে অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে পরশুরাম থানার সলিয়া গ্রামের সাহসী ছাত্র-যুবক তথা অত্র লেখক নুরুল ইসলাম মজুমদারকে উক্ত অঞ্চলে অবস্থান করে সকল তথ্য প্রেরণের গুরুদায়িত্ব অর্পণের সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। কারন ঐ ছাত্র-যুবক ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য অধ্যক্ষ ওবায়েদ উল্লাহ মজুমদার ও এএফকে সফদার সাহেবের নির্বাচনী কাজে প্রতিটি এলাকায় তখনকার ছাত্রনেতা অধ্যক্ষ এম ওয়াজী উল্লাহ ভূঁইয়া সহ কাজ করেছিল বিধায় তাকে সকলে এ কাজের যোগ্য বলে সমর্থন করেন। এছাড়া ছাত্রলীগের জিএস হিসেবে তার অত্যন্ত পরিচিতি ছিল এবং বড়মাপের নেতারা বিলোনিয়া যাওয়ার আগে তিনি বিলোনিয়ায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনমত গঠনে সচেষ্ট ছিলেন। এর পরদিন মেজর জেএন প্রধান নুরুল ইসলাম মজুমদারকে নিয়ে ত্রিপুরা রাজ্যের উদয়পুরে গিয়ে ৯২ ব্যাঃ ব্রিগেঃ হেড কোয়ার্টারে গোয়েন্দা বিভাগে ইন্টেলিজেন্সের উপর বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন।

নুরুল ইসলাম মজুমদার প্রশিক্ষণ গ্রহণ শেষে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মিত্র ও যৌথ বাহিনীর অধীন ফেনীর উত্তর-পূর্বাঞ্চল তথা দুইটি সাব সেক্টরের অংশের দায়িত্ব নিয়ে, সকল প্রকার ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় চলাফেরার সুবিধার্থে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের নিকট হতে একটি আইডি সংগ্রহ করে। এভাবে নিজের আসল পরিচয় গোপন রেখে শত্রুপক্ষের অবস্থান, গতিবিধি, কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ, গেরিলা বাহিনীর পথ-পরিদর্শক সহ রণকৌশলের সকল সাফল্য-ব্যর্থতার গোয়েন্দা প্রতিবেদনের কাজ সূচারু রূপে চালাতে থাকে। সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে অভিনব রণকৌশলের স্থান নির্ধারনের জন্য তদন্ত ও পর্যবেক্ষণ পূর্বক একটি প্রাক্কলন ও প্রতিবেদন তৈরী করা হয়। পূর্ব-পশ্চিম সীমান্তে ৮ কিলোমিটার এলাকার চন্দনা-ধনীকুন্ডা-সলিয়া-গুথুমা পর্যন্ত “রেড লাইন” বরাবর মুহুরী-কহুয়া নদী সহ তিনটি বড় সড়ক পথকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে এলাকার সকল অবস্থানের উপর লিখিত গোয়েন্দা প্রতিবেদন লোকেশন ম্যাপ সহ মুক্তি-মিত্র বাহিনীর উর্ধ্বতন কমান্ডারের নিকট উপস্থাপন করা হয়। উক্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সকল কমান্ডার, ডেপুটি-কমান্ডার ও কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে সভায় বিস্তারিত আলোচনা করে সমর কৌশলের একটি আধুনিক মডেল প্রণয়ন করা হয়।

অক্টোবর মাসের শেষার্ধে ২ নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফের মাধ্যমে সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপটেন জাফর ইমাম সহ সকল অফিসারকে নিয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলার অদূরে ভারতীয় সেনা শিবিরে জেনারেল আরডি হীরা, মেজর জেএন প্রধান ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে উক্ত গোয়েন্দা প্রতিবেদনের উপর বিস্তারিত আলোচনার পর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি অভিনব সমর কৌশল হিসেবে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় উক্ত ‘রেড লাইন’ বরাবর দ্বি-মুখী আক্রমণের চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। উক্ত পরিকল্পিত রণক্ষেত্রের উত্তর-দক্ষিণে দুইটি সেক্টরের সীমানা। পরশুরাম-ছাগলনাইয়া রাস্তার পূর্ব পাশে ১ নং সেক্টরের অধীন। পশ্চিম পাশে ফেনী-বিলোনিয়া রাস্তা ২ নং সেক্টরের অধীন। যাহাতে দক্ষিণ দিক হতে হানাদার বাহিনীর কোন সাহায্য বা সরবরাহ উত্তর দিকে যেতে এবং উত্তর দিক হতে কোন শত্রু দক্ষিণ দিকে যেতে বা পালানোর চেষ্টা করতে না পারে সে স্থান হতে নজরদারী করা সহজ ছিল।

“সম্মুখ সমরে” রণক্ষেত্রের সকল প্রস্তুতি শেষে বৈরী আবহাওয়াকে কাজে লাগিয়ে, মাহে রমজানে অত্যন্ত গোপনীয়তায় ২ নং সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার, ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা অধিনায়ক, সদ্য পদোন্নতি প্রাপ্ত মেজর জাফর ইমাম এর নেতৃত্বে পূর্বে ধার্য্য তারিখ অনুযায়ী ২ নভেম্বর রণসাজে সজ্জিত হয়ে তার সকল দল, উপদল, হাওলাতি দলের অধিনায়ক সহ পূর্ব পরিকল্পনীয় নিজ নিজ স্থানে সতর্ক ভাবে অবস্থান নেন। এদিকে সিএনসি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তখনকার তুখোর ছাত্রনেতা জনাব জয়নাল আবেদীন হাজারী তাঁর অধীন যোদ্ধাদের নিয়ে রণপ্রস্তুতিসহ মির্জানগর ইউনিয়নে অবস্থান নেন। অপরদিকে ১ নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর রফিকুল ইসলাম তাঁর অধীস্থ ক্যাপ্টেন সামছুল হুদার আকস্মিক মৃত্যুতে তাঁহাকে দাফনের কাজে কিছুটা বিলম্ব হলেও তার সকল দল, উপদলকে পরিকল্পনা অনুযায়ী নিজনিজ অবস্থানে সতর্কভাবে অবস্থান নেন। তাঁর নিয়ন্ত্রিত ক্যাপ্টেন মাহফুজের নেতৃত্বে তাঁর দলকে দুই সেক্টরের সীমানায় “রেড লাইন” বরাবর সলিয়া দীঘির চারপাশে সবচেয়ে শক্ত ঘাঁটি স্থাপন করেন। পূর্বের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মিত্র বাহিনীকে সীমান্তে ভারী অস্ত্র সহ সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়।

২ নভেম্বর দিবাগত রাত হতে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত সকল আক্রমণের সংক্ষিপ্ত বিবরণ ঃ সকল মুক্তিযোদ্ধা আক্রমণের সংকেতের জন্য অপেক্ষমান। চিথলিয়া-পরশুরাম এর মাঝ বরাবর সলিয়া গ্রাম। ৩ নভেম্বর ভোর বেলায় হানাদার বাহিনীর একটি রেল ট্রলি দক্ষিন দিক হতে চিথলিয়া স্টেশান পার হয়ে উত্তর দিকে সলিয়া গ্রামের মধ্যভাগ বরাবর আসা মাত্রই রেল লাইনের নিকটে বাংকারে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা হঠাৎ আক্রমণ করে। ফলে ঘটনাস্থলেই একজন অফিসার সহ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ছয়জন সৈন্য মারা যায়। এসময় হাবিলদার এয়ার আহমদ উল্লাস করতে করতে বাংকার থেকে বেরিয়ে আসেন। চিথলিয়া স্টেশানে অবস্থানরত পাকিস্তানী সৈন্যরা বিষয়টি বুঝতে পেরে গোলাগুলি শুরু করলে হাবিলদার এয়ার আহমদ মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। ঐদিন সারাক্ষণ উভয় পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় চলে। রাতের বেলায় হানাদার বাহিনীর অপর একটি বড় দল দক্ষিণ দিক হতে ক্যাপ্টেন লীক রোড হয়ে ক্যাপ্টেন মাহফুজের ডিফেন্সের ভিতর ঢুকে পড়লে উভয় পক্ষের মধ্যে মুষ্ঠিযুদ্ধের মত হাতাহাতি লড়াই শুরু হয়। এর সাথে উভয় পক্ষের গোলাবর্ষণ চলতে থাকে। এ অঞ্চলের সবচেয়ে বৃহৎ এ “সম্মুখ সমরে” পাক বাহিনীর একশত বিশ জন সৈন্য নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের পাঁচ জন গুরুতর আহত হয়ে শাহাদাত বরণ করেন। এদের একজনকে সলিয়া দীঘির উত্তর-পশ্চিম কোণায় বাংকারে দাফন করা হয়।

পরদিন ৪ নভেম্বর বিকেলে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ৪ টি জঙ্গি বোমারু বিমান হঠাৎ খুব উপরে দেখা যায়। এদের দুইটি বিমান চোখের পলকে নিচে নেমে আসে এবং সলিয়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের উপর ব্যাপক বোমা বর্ষণ করে। এতে বহু বাড়িঘর পুড়ে যায় এবং ১৪/১৫ জন বেসামরিক লোক মারা যায়। মুক্তিযোদ্ধারা বোমারু বিমানকে লক্ষ্য করে এমএমজি দ্বারা গুলি করলে বিমানের কোন ক্ষতি না হয়ে, বরং বিমান থেকে ঐ এমএমজি লক্ষ্য করে বোমা বর্ষণ করায় এমএমজিটি ধ্বংশ হয়ে যায় এবং এর চালক মোমিন ঘটনাস্থলে শহীদ হন। এই যুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানী হানাদারের কবলে পড়ে, বহু নিরীহ সাধারন মানুষ গণ্যহত্যার স্বীকার হয়েছে, গণহত্যার স্বীকারের উল্লেখযোগ্য স্থান সমূহ হলো-মালীপাথর, পরশুরাম, সলিয়া, ফুলগাজী, মুন্সিরহাটসহ আর বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা চালায়।

৫ নভেম্বর আবার পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর তিনটি বিমান বহু উপর হতে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। মিত্র বাহিনী বিমানগুলোকে লক্ষ্য করে কামানের গোলা নিক্ষেপ করলে বিমানগুলি দ্রুত পালিয়ে যায়। এ সময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী তাদের আটকে পড়া সৈন্যদের উদ্ধারের জন্য সব চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। এ দিন সেক্টরের নির্দেশ মত একটি টহল দলকে শালধর বাজারে অবস্থানরত হানাদার বাহিনীর গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য পাঠানো হয়। মুক্তিযোদ্ধা টহল দল পাকিস্তানী শত্রুদের কবলে পড়ে যায়। এ সময় উভয় পক্ষে গোলাগুলি শুরু হলে মুক্তিবাহিনীর আজিজ ও তৌহিদ ঘটনাস্থলে শহীদ হন। আরো কয়েকজন আহত হন। এ খবর সেক্টর সদরে পৌঁছলে আরো সৈন্য ভারী অস্ত্র নিয়ে রাতেই তিনদিক থেকে শালধর ক্যাম্প আক্রমণ করে শত্রুদের পর্যুদস্ত করে। ৬ নভেম্বর ভোরে শালধর বাজার শত্রুমুক্ত হয়। এখানে রণক্ষেত্রে কয়েকজন প্লাটন কমান্ডারের দূরদর্শী ভূমিকা ছিল তাঁহারা মাহাবুবুল আলম মফিজ, জয়নুল হক শাখী চৌধুরী, সুবেদার সেকেন্দার, আহসান উল্লাহ, ছিদ্দিক, সুবেদার বশির, সুবেদার আবদুল হালিম প্রমুখ। এখানে এই ঘটনাটি যদিও ঘটে ছিল ১৯৭১ সালে সেপ্টেম্বর মাসে, যাহা সাব সেক্টর কমান্ডার জাফর ইমামের নির্দেশে ফুলগাজী আক্রমন করে দখল করা উদ্দেশ্যে মুক্তিযোদ্ধারা রাতে নীলক্ষী গ্রামে পরিখা খননের মাধ্যমে ডিফেন্স স্থাপন করে। রাত প্রায় ১২.১৫ মিনিটে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী সাথে তুমুল লড়াই শুরু হয়। নেতৃত্বদানকারী শাখী চৌধুরী ও সুবেদার ইউনুছ ৬৫ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে এই আক্রমন করে। উক্ত যুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ৭ জন সেনা নিহত হন এবং বহু হতাহত হয়ে পেছনে হটিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধার পক্ষে উক্ত যুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদারের আর্টিলারী ও এল.এম.জির ব্রাশ ফায়ারে সাহসী বীর যোদ্ধা মোসলেহ উদ্দিন কচি ঘটনাস্থলে এবং আইয়ুব আর্টিলারীর গোলাবষর্ণে শহীদ হন। ৬ নভেম্বর দিনের বেলায় পরশুরামের আশেপাশে আটকে পড়া পাক সেনাদের সারেন্ডার করতে বাধ্য করানোর জন্য দিনভর মুক্তিবাহিনী গুলিবর্ষণ করে। রাতে যৌথ বাহিনী আর্টিলারির সাহায্যে একটানা আধাঘন্টা গোলা বর্ষণ করে পাক বাহিনীর সকল বাংকার ধ্বংশ করে দেয়। বহু পাকিস্তানী সেনা আহত-নিহত হয়। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর অবস্থান নিরব হয়ে যায়। ভোর বেলায় বিভিন্ন জায়গা থেকে বেরিয়ে দুই জন অফিসার সহ ৭২ জন পাকিস্তানী সৈন্য একত্রিত হয়ে মুক্তিবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে। এভাবে ৭ নভেম্বর বিলোনিয়া হতে চিথলিয়া পর্যন্ত শত্রুমুক্ত হয়। পরশুরাম থানা সদরে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়।

৮ নভেম্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী তাদের ডিফেন্স দক্ষিণ চিথলিয়া হতে ঘনিয়ামোড়ায়-ফুলগাজী নিয়ে যায়। মুক্তিবাহিনীও তাদের আক্রমণ করতে করতে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়। এভাবে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী পশ্চাদপসারণ করতে করতে ফেনীর দিকে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা ২১-২৩ নভেম্বর পাঠান নগর, কাচারী বাজার, জিএম হাট, বন্ধুয়ায় অবস্থান করে ডিফেন্স নেয়। এ সময় পাকিস্তানী পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল যুদ্ধ হয়। এভাবে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী পর্যুদস্ত হয় এবং ৬ ডিসেম্বর ফেনী সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত হয়।

পরিশেষে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, যা দুঃখজনক হলেও সত্য বটে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চরম দুঃসময়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত এদেশের বিপন্ন জনগনকে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-চিকিৎসা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণসহ অস্ত্র-শস্ত্র, সৈন্য, মনোবল, জনবল ও প্রযুক্তির মাধ্যমে সাহায্য সহযোগিতা করে মানবিক ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু যুদ্ধের সময় রণক্ষেত্রের বিভিন্ন কাজে ভারতীয় বাহিনী তথা মিত্রবাহিনীর অধীনে এবং নিয়ন্ত্রনে সমগ্র বাংলাদেশে যে সকল প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধা জীবনের মায়া ত্যাগ করে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত হয়ে রণকৌশলের সমর বিভাগে ও গোয়েন্দা বিভাগের ইনটেলিজেন্স এর অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ তথ্য সংগ্রহের গেরিলা কাজে বীরত্বের ভূমিকায় অবদান রেখেছেন, বিগত কোন সরকারের পক্ষ হতে তাদের কোন প্রকার পদক-পদবী, খেতাব বা পুরস্কার প্রদান করা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময় বিভিন্ন সরকারের পট পরিবর্তনের কারনে দেশের বিভিন œস্থানে মুক্তিযুদ্ধের কোন চিহ্ন বা প্রতিকি স্থাপনা ও সঠিক ইতিহাস পাঠ্য পুস্তকে আনায়ন করিতে পারে নাই বিধায়, পরবর্তী প্রজন্ম উহা ধারন বহন করিতে ব্যর্থ হচ্ছে। বর্তমানে যে সকল স্থানে সরকার মুক্তিযুদ্ধের কিছু স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণ করতে গিয়ে, কিছু ব্যক্তির কারনে উহা অবহেলিত অবস্থায় রহিয়াছে বিধায় তাহা দেখার কোন মহলের অভাব রয়েছে প্রতীয়মান হচ্ছে।

মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি, প্রতিক্রিয়াশীল চক্র যেখানে সিংহহৃদয় মহাপুরুষ, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে শান্তিতে দেশ পরিচালনা করতে দেয়নি, সেখানে সেই নাজুক সময়ে যুদ্ধকালিন ক্ষতিগ্রস্থ ঐ স্বাধীনতা বিরোধী শত্রুর কারনে দায়িত্বশীল মুক্তিযোদ্ধারা পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে নিজেদেরকে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিতেও বহু বছর আতংকবোধ করেছেন। তাঁরা তাঁদের সেই বীরত্বের স্বীকৃতি না পেয়ে দীর্ঘবছর যাবত হতাশাগ্রস্থ। জীবনের শেষপ্রান্তে এসেও যদি সেই সব বঞ্চিত মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের স্বীকৃতি পান, তবে তাদের ত্যাগ ও শ্রম সার্থক হবে। আমাদের স্বাধীনতা হবে অর্থবহ।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, সলিয়া, পরশুরাম, ফেনী।

আপনার মতামত দিন

Android App
Android App
Android App
© Natun Feni. All rights reserved. Design by: GS Tech Ltd.