কানে না শুনা এক রোগীর চিকিৎসা কথা • নতুন ফেনীনতুন ফেনী কানে না শুনা এক রোগীর চিকিৎসা কথা • নতুন ফেনী
 ফেনী |
২০ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৭ বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কানে না শুনা এক রোগীর চিকিৎসা কথা

নতুন ফেনীনতুন ফেনী
  প্রকাশিত হয়েছেঃ  ১১:০৬ অপরাহ্ণ, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯
ডা. ছরওয়ার আলম।

সাত বছরের এক শিশু সন্তানকে নিয়ে তার পিতা আরো কয়েকজন আত্মীয়-স্বজন সহ আমাদের চেম্বারে আসলেন। তাদের সবার চেহারায় হতাশার ছাপ। তাদেরকে বললাম, কি সেবা দিতে পারি। তারা বললেন, আমাদের প্রিয় এই শিশুকে নিয়ে আমরা সবাই হতাশার মধ্যে আছি। দীর্ঘদিন ধরে সে কানে শুনে না। এর জন্য স্থানীয় চিকিৎসা শেষ করে ঢাকায় নাক কান গলার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে দেখিয়েছি। সবার একই কথা এই শিশুর কানের ভিতরে পানি জমেছে। অপারেশন করে এই পানি বের করতে হবে। কিছুদিন আগে তার প্রবাসী পিতা একমাত্র ছেলের কানের চিকিৎসার জন্য দেশে এসেছেন, উনি নিজে ছেলেকে নিয়ে অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের নিকট গিয়েছেন। সবার পরামর্শ ছেলের উভয় কান অপারেশন করে পানি বের করতে হবে। বাবা জানতে চাইলেন অপারেশন স্থায়ী সমাধান কি না? তারা কেউ তাকে এই ব্যাপারে আশ্বস্ত করতে পারলেন না। এতে তার পিতা অপারেশন হতে পিছপা হলেন। কিন্তু তার দুশ্চিন্তার শেষ নাই, ছেলের বয়স ৭ বছর পেরিয়ে ৮ বছরে পড়েছে। কিন্তু লিখাপড়া করাতে পারছেন না, বিদ্যালয়ে দিতে পারছেন না, কানে না শুনায় সে শিক্ষকের কথা বুঝতে পারেনা, জোর করে পাঠিয়ে দেখেছেন, অন্যদের কথা না শুনায় এখন সে বিদ্যালয়ে যেতে চায়না। অনেকে পরামর্শ দিলেন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে দেখার জন্য। সেই হিসাবে খোঁজ খবর নিয়ে ছেলেকে নিয়ে কয়েকজন আত্মীয়-স্বজন সহ আমাদের নিকট এসেছেন হোমিওপ্যাথিতে কানে না শুনার কোন স্থায়ী সমাধান আছে কিনা জানতে এবং থাকলে তার চিকিৎসা গ্রহন করতে।

আমরা রোগীর সকল রিপোর্ট মনোযোগ সহকারে দেখলাম। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তার ক্ষেত্রে যে রোগ চিহ্নিত হয়েছে তা হল অটাইটিস মিডিয়া উইথ ইফিউশন। সাধারণত অডিটরি টিউব বা ইস্টিশিয়ান টিউব (যা  নাক ও গলার সাথে কানের সংযোগ স্থাপন করে) কোনো কারণে বন্ধ হয়ে গেলে মধ্যকর্ণে পানির মত এক ধরণের সিক্রেশন জমতে পারে। এতে মধ্যকর্ণের বাতাসের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে শ্রবণে ব্যাঘাত ঘটে, এতে সাধারণত ব্যথা থাকেনা। শিশু বয়সে এই রোগ বেশি দেখা দেয়। শিশুরা এতে লিখাপড়ায় মনোযোগ হারায়, প্রশ্ন করলে উত্তর দেয়না। কানের পর্দা সাধারণ রং হারিয়ে গোলাপী রং ধারণ করে। নানা কারণে এই রোগ দেখা দিতে পারে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল এডিনয়েড, যা এক ধরনের টনসিল নাকের পেছনে থাকে। এই এডিনয়েড ইনফেকশন বা প্রদাহ জনিত কারণে বড় হয়ে গেলে, অডিটরি টিউব বন্ধ হয়ে যায় এবং মধ্যকর্ণে পানি জমে যায়। এছাড়া কোন কারণে নাক দিয়ে নিশ্বাস নিতে না পারলে, এলার্জী জনিত কারণে, ভাইরাস জনিত কারণে, নাক ও গলার টিউমার জনিত কারণে যদি অডিটরি  টিউব বন্ধ হয়ে যায় তাহলেও মধ্যকর্ণে পানি জমে। সাধারণত ইহা সার্জিক্যাল রোগ। সাধারণ চিকিৎসায় ভালো না হলে, কানের একটা ছোট অপারেশন “মাইরিংগোটমি” এবং পর্দায় একটি টিউব (গ্রুমেট বা ভেন্টিলেশন টিউব) বসানো হয়, এতে করে কানে আর পানি জমা হতে পারে না। ইহা কানের একটি মাইক্রো সার্জারি। কিন্তু রোগীর পিতা এই চিকিৎসা নিতে নারাজ। তিনি জানতে চান হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় ইহার কি সমাধান আছে। আমরা বললাম হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় রোগ ধরে কোন চিকিৎসা নেই। আছে রোগীর চিকিৎসা অর্থাৎ আপনার ছেলের বর্তমান রোগের কষ্টকর লক্ষণ, রোগের কারণ, তার চরিত্রগত অন্যান্য লক্ষণাবলী, মানসিক লক্ষণাবলী, তার সার্বদৈহিক লক্ষণাবলী সহ আনুসঙ্গিক লক্ষণাবলী হোমিওপ্যাথিক পরীক্ষিত যে ঔষধের লক্ষণের সাথে মিলবে একমাত্র সে ঔষধেই আরোগ্য হবে। ইহা অল্প সময়ে, বিনা কষ্টে, স্থায়ীভাবে, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীনভাবে হবে ইনশাআল্লাহ। তবে রোগীর রোগের বিস্তারিত লক্ষনাবলী জানার ক্ষেত্রে আমাদের ১ঘন্টা সময় দিতে হবে। তাহলে আমরা চেষ্টা করে দেখতে পারি। আল্লাহর রহমতে হয়তো আপনার ছেলে বিনা অপারেশনই আরোগ্য লাভ করতে পারে। রোগীর পিতা আমাদের পরামর্শে খুবই সন্তুষ্ট হলেন এবং তার মনে আশার সঞ্চার হল। হয়তো আল্লাহর রহমতে তার ছেলের এই অসুখ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় আরোগ্য লাভ করবে। আমাদেরকে অনুরোধ করলেন আমরা যেন তার ছেলের চিকিৎসার চেষ্টা চালাই।

আমরা আল্লাহর উপর ভরসা করে এই শিশুর রোগীলিপি নিতে রাজী হলাম। জানতে চাইলাম বর্তমান কষ্ট গুলি কি কি? রোগীর পিতা জানালেন ১. কানে কম শুনে, ২. নাকে পলিপাস আছে,  ৩. টনসিলে ব্যথা আছে, ৪. ক্ষুধা কম। বিস্তারিত আলোচনায় জানতে পারলাম কয়েক মাস পূর্বে প্রথমে বৃষ্টিতে ভিজে সর্দ্দি লাগে, এর পর থেকে কানে কম শুনা দেখা দেয়, ইহা দিন দিন বেড়ে চলছে, এখন তার কানের কাছে গিয়ে জোরে বলা ছাড়া সে কোন কথা বা শব্দ শুনতে পায়না। কানে ব্যথা নেই, কানের পুঁজ পানি যায় না, কানে চুলকানি নাই। অনেক আগে থেকেই নাকে পলিপাস আছে, প্রায়শই নাক বন্ধ থাকে, রাত্রে নাক দিয়ে নি:শ্বাস নিতে পারেনা, প্রায় সময় অতি ঠান্ডায় টনসিল বড় হয়ে যায়, ব্যথা করে। সব সমস্যা পানি ধরলে, বৃষ্টিতে,  গোসলে বাড়ে, গরমে কিছুটা কমে। ছোট থেকে ক্ষুধা কম, জোর করে খাওয়াতে হয়। মিষ্টি, ডিম, দুধ এবং বাহিরের খাবার পছন্দ। অতি ঠান্ডা অসহ্য। রোগী প্রচন্ড চঞ্চল এবং অস্থির প্রকৃতির। মিশুক, সবার সাথে মিশে। প্রস্রাব মাঝে মাঝে ঘন ঘন করে।

আমরা তার রোগীলিপি পর্যালোচনা করে ঔষধ নির্ণায়ক লক্ষণ পেলাম মধ্যকর্ণে পানি জমা জনিত কারণে কানে খুব কম শুনা, রোগের কারণ বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডা লাগা, রোগীর ঠান্ডায় কষ্ট বাড়ে, রোগী প্রচন্ড চঞ্চল ও অস্থির প্রকৃতির। আমরা তার ক্ষেত্রে ঔষধ নির্বাচন করলাম “রাসটক্স”। উক্ত ঔষধ সেবনের অল্প দিনের মধ্যে এই শিশুর কানের সমস্যা ধীরে ধীরে আরোগ্যে হতে থাকে। মধ্যকর্ণে জমা পানি অদৃশ্য হয়ে যায়। সে এখন সব কিছু স্বাভাবিক শুনে। ছেলের অপারেশনযোগ্য রোগ বিনা অপারেশনে অল্প সময়ে, বিনা কষ্টে, স্থায়ীভারে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীনভাবে আরোগ্য লাভ করাতে তার পিতা এবং পরিবারে সবাই সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞ। ছেলের কানে না শুনা রোগের আদর্শ আরোগ্য হওয়াতে তিনি খুবই খুশি।
লেখকঃ সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক পরিষদ, ফেনী জেলা।

আপনার মতামত দিন

Android App
Android App
Android App
© Natun Feni. All rights reserved. Design by: GS Tech Ltd.