একজন মোহাম্মদ সফিউল হক, পরিচয় অনেক । ব্যাংক কর্মকর্তা, কবি, প্রাবন্ধিক ও সমাজকর্মী, যে পরিচয়েই ডাকুন দ্যুতি ছড়াবেই । ২০১৯ সালের অমর একুশে বইমেলায় মলাটবদ্ধ হয়েছে মোহাম্মদ সফিউল হক এর একক কাব্যগ্রন্থ “শীতনিদ্রায় বসন্ত” ।
কিছু বই পাঠে পাঠক হৃদয়ের আত্নতৃপ্তির কিয়দাংশও যদি প্রকাশ না করা যায় তবে কেমন যেন অস্বস্তি থেকেই যায় । “শীতনিদ্রায় বসন্ত”তেমন একটি বই । মা-মাটি, মানুষ, প্রেম, প্রকৃতি, সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্হা নিয়ে একের পর এক শব্দ গাঁথুনীতে কবি গড়ে তুলেছেন ৫৮ টি কাব্যিক ইমারত, যার নির্মানশৈলী দ্যুতি ছড়িয়েছে স্বকীয়তায়। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন সফেদ পান্হ। কব্যিক ভাষায় মা-বাবাকে বইটি উৎসর্গ করার ধরণ মুগ্ধতা ছড়িয়েছে । সামনে অগ্রসর হতেই চোখে পড়লো-
‘’অতলান্তের অন্ধকারে পোশাকী মানবতা
ঠুকরে ঠুকরে খায় অন্ধ মাছেরা।
ইনস্টাগ্রামে লীন ধূসর অপরাহ্ন
নক্ষত্র হয়ে খসে পড়ে জেরুজালেমে।
… তোমরা তো ডুবে আছ ভদকায় ! ‘’
আমাদের নির্লিপ্ততা আর অসাধানতায় কিভাবে বিভীষিকাময় সময় আমাদের গ্রাস করছে তা দারুণভাবে ফুটে উঠেছে ‘ধূসর অপরাহ্ন’ নামের এই কবিতায় ।রুপসী বাংলার রুপ সুধা পান করে কবি বাঁচতে চাওয়ার আকুলতা ফুটে উঠেছে ঠিক এভাবে-
”মর্মের নদীতে সবুজ স্রোত
জোৎস্নায় পাগল করা অপরূপ রাত
আমি এসব দেখি আর দেখে দেখে
আঁকি দারুণ ছবি, প্রসন্ন হই
প্রতিটি ফাগুনে, প্রতিটি সুন্দর দেখে
এই সুন্দর, এই প্রসন্নতা নিয়ে
বাঁচতে চাই আমি এখানে
এই রুপসী বাংলায়।”
কষ্টের বোঝায় ন্যুজ হয়ে চোখের সামনেই তিলে তিলে নিস্তব্ধ হয়ে যায় কত উচ্ছ্বোসিত প্রাণ, এসব খবর আড়ালেই থেকে যায় অনেকটা, কবি তার কাব্যিক তুলিতে এই বাস্তবতা দারুণভাবে চিত্রিত করেছেন বিদায় হে শূন্যতা কবিতায় ।
‘’কষ্টের ভার বইতে না পেরে
চারপাশের মানুষগুলো
যখন নুয়ে পড়ে হতাশায়।
ব্যথা করে , প্রচন্ড ব্যথা করে বুক
যখন বিষাদের আচ্ছাদনে ঢাকা পড়ে
একের পর এক মুখ।‘’
বসন্ত মানেই বাক্সবন্দি শীতের তীব্রতা, বসন্ত মানেই শীতের শেষে প্রাণোচ্ছ্বাস । কিন্তু যদি বলা হয়
শীত নিদ্রায় বসন্ত, শুনতে কেমন লাগে! বহু দিন ধরে আগলে রাখা ধারনার বিপরীতে দাঁড়িয়ে কি বলতে চেয়েছেন কবি, জানতে হলে চোখ বুলাতে হবে ‘শীত নিদ্রায় বসন্ত’ কবিতায় । কবির ভাষায়-
‘’ফাগুনে নেই আগুন রঙা কৃষ্ণচূড়া
গন্তব্যে ফেরা অবিশ্বাসী চোখ
দেখছে আবছা কুয়াশার রাজত্ব
বসন্তের আগমন প্রলম্বিত হচ্ছে বারবার
শীত নিদ্রায় গেছে বসন্ত’’।
কবিতা দিয়ে কি হবে! এমন প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হয়নি এমন কোন কবিকে হয়তো খুঁজে পাওয়া মুসকিল এই সময়ে, অথচ দেশে দেশে শান্তিতে –সংগ্রামে, বিপ্লবে কিংবা মানবিক মুল্যবোধ জাগিয়ে তোলার কোন ক্ষেত্রে কবিতার দরকার হয়নি এমন পরিসংখ্যানের পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিলে প্রশ্নকর্তা চুপসে যান । যাই হোক, পৃথিবীটা যখন কবিদের হবে তখন কি হতে পারে তার একটা নান্দনিক প্রকাশ ঘটেছে এভাবে
-‘’তারপর একদিন পৃথিবীটা যখন কবিদের হবে,
পথশিশুদের তরে প্রেমের হাত বাড়াবে;
কলা পাতার বুননের মত বিছিয়ে দিয়ে সমতার হাত
মুগ্ধতার আবেশে সবাই এসে দাঁড়াবে’’।
স্বপ্ন দেখতে সবাই জানে, তবে স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন দৃঢ় সংকল্প আর একতা, সে কথাই কবি বলেছেন এসো স্বপ্ন বুনি কবিতায় ।
‘’এসো স্বপ্ন বুনি
আবদ্ধ হই দৃঢ় সংকল্পে,
এসো হাতে হাত ধরি
জীবনকে রচি এক
অনিন্দ্য সুন্দর গল্পে”।
সংকীর্ণ ঈর্ষার আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার মানুষের অভাব নেই আজকাল, অথচ আমাদের খুব বেশী প্রয়োজন এমন একজন আলোর দিশারী যে থামিয়ে দিবে এসব নারকীয় জিঘাংসা । এই সুরই উঠেছে
থামো শিরোনামে –
‘’মিথ্যাবাদী নেতা হতে আসিনি
আসিনি এই শীতে আগুন পোহাতে
কিংবা ছড়াতে উত্তাপ,
বলতে এসেছি থামো
পুড়িও না আর সংকীর্ণ ঈর্ষার আগুনে
ইহা যে পাপ, মহাপাপ’’।
তরুণরা স্বপ্ন দেখায়, স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে শেখায় । তরুণের প্রাণ শক্তিতে বলিয়ান হয়ে একটি জাতি নিজকে চিনিয়ে দেয়, সফলতা ছিনিয়ে নেয় । আর সেই তরুণরাই যখন ব্যর্থ হয় তখন মুখ থুবড়ে পড়ে সমাজ, মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না স্বদেশ । এই বাস্তবতার করুণ চিত্রই উঠে এসেছে ‘তরুণরা ব্যর্থ হলে’ কবিতায় ।এমন উচ্চারণ মুগ্ধতার চাদর জড়িয়ে কবির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বাড়ায় ।
‘’তরুণরা ব্যর্থ হলে…
রাষ্ট্রে পচন ধরে
দীর্ঘ হয়ে আসে রাত
দীর্ঘজীবন পায় শহুরে কাকেরা
পুলিশ দৈনিক হাজার বার স্যালুট জানায় সিঁধেল চোরকে’’।
চায়ের কাপে সকাল শুরু হয় না আজকাল,চুমুকের পূর্বেই এক এক করে গিলতে থাকি সুউচ্চ অট্টালিকা হতে নবজাতক ছুঁড়ে ফেলার নির্মমতা, মস্তক বিহীন টুকরো টুকরো লাশের ভাগ্যলিপি কিংবা নারিত্বের চরম অবমাননার সচিত্র প্রতিবেদন । মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়াই, নৃশংসতার অতীত পরিসংখ্যান মাড়িয়ে রচিত হয় নতুন ইতিহাস । অসহ্য এ পরিস্হিতিতে সীমাহীন লজ্জায় কবি বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাইলেন এমন আকুলতায় –
‘’জরায়ু ছিড়ে জন্ম নেয়া
নোংরা ডাস্টবিনে অবৈধ নবজাতকে
তোমাকে খুঁজতে চাইনি,বাংলাদেশ।
পিস্তলের ট্রিগারে বারুদের গন্ধে
পেট্রোল বোমায়, অগ্নি সন্ত্রাসে
তোমাকে খুঁজতে চাইনি,বাংলাদেশ”।
শীতনিদ্রায় বসন্ত’র ৫৮ টি কবিতাই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে উজ্বল, আলাদাভাবে সে প্রসঙ্গ টানলে লেখার কলেবর অনেকাংশ বেড়ে যাবে বলে সে পথে হাঁটছি না, তবে এটুকু বলতে পারি কাব্যগ্রন্হটির ভাঁজে ভাঁজে ছড়িয়ে আছে পাঠকের তৃষ্ণা নিবারণ করে পুন:পাঠের আবেদন তৈরীর অজস্র উপাদান, বইটি প্রকৃত পাঠকের তৃষ্ণা মেটাবে বলেই আমার বিশ্বাস । তবে ছাপানোর ক্ষেত্রে আরেকটু যত্নশীল হলে আরো ভাল হতো, ছোট পরিসরের কবিতার ক্ষেত্রে উপরের দিকে বেশী ফাঁকা না রেখে নিচের দিকে ফাঁকা রাখা যেত অথবা উপরে নিচে সমান রাখা যেত, তাইলে অন্তত আমার কাছে আরো ভাল লাগতো ।
দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদে ৬৪ পৃষ্ঠার বইটি প্রকাশ করেছে নোলক প্রকাশনী ।