সত্য ও শান্তির জন্য সাংবাদিকতা • নতুন ফেনীনতুন ফেনী সত্য ও শান্তির জন্য সাংবাদিকতা • নতুন ফেনী
 ফেনী |
২৯ মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

সত্য ও শান্তির জন্য সাংবাদিকতা

রাশেদুল হাসানরাশেদুল হাসান
  প্রকাশিত হয়েছেঃ  ০৪:০৭ অপরাহ্ণ, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪

সোলায়মান হাজারী ডালিম:
আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতিতে সাংবাদিকতার ব্যাপ্তি আজ  রাষ্ট্রের সীমানাই কেবল ছাড়েনি, সম্প্রসারিত হয়েছে অভূতপূর্ব গতিতে। ছড়িয়েছে যুগের গতির সাথে পাল্লা দিয়ে পৃথীবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য  প্রান্তের। দৈনিক ও সাপ্তাহিক’র ‘অন-লাইন এডিশন’ সাংবাদিকতায় এমন আরো নতুন সংযোজন যা সংবাদপত্রের পাঠক সংখ্যা বিস্মকরভাবে বাড়িয়েছে।
এ ছাড়াও স্যাটেলাইট টিভি, অনলাইন টিভি, এফএম রেডিও, কমিউনিটি ও সিটিজেন রেডিও এবং ব্লগ, ফেইসবুক, টুইটার যা সামাজিক গণযোগযোগের ক্ষেত্রে  বিপ্লব এনেছে। একই সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের পূর্বেকার নিয়ন্ত্রন ও কণ্ঠরোধের পূরনো দৃষ্টান্ত গুলোকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অসাড় প্রমাণিত  করেছে।
সংবাদমাধ্যম আজ সার্বিকভাবে স্বাধীন, পূর্বেকার যে কোনো সময়ের চাইতে  স্বাধীনতামুখি এবং সার্বভৌমত্ব প্রত্যাশিত যা  তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি। সংকট, সীমাবদ্ধতা শেষ হয়েছে, নিগ্রহ-নিপীড়ন মুক্ত হয়ে সাংবাদিকতার পেশা রাহুমুক্ত হয়েছে এমনটি বলার অবকাশ অবশ্য নেই। তবে পরিস্থিতির তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি স্বীকার করাই সঙ্গত হবে বলে আমি মনে করি।
এত সব সাফল্য বা অগ্রগতি তুলে ধরেও বর্তমান যুগের সাংবাদিকতার কিছু সবল প্রতিপক্ষকে আমি আমার এ লেখায় তুলে ধরতে চাই। আমার বিশ্বাস এসবের আলোচনা বস্তুনিষ্ঠ এবং এবং শান্তি প্রত্যাশী সাংবাদিকতার স্বার্থে প্রাসঙ্গিক হবে।
আমরা সকলেই জানি স্বাধীন সাংবাদিকতার মূল প্রতিপক্ষ এক কালে ছিল রাষ্ট্র। (১) রাষ্ট্রশক্তি বা শাসকগোষ্ঠী তাদের সমালোচনা, অপকর্ম, দুর্নীতি বা অপশাসন উদ্ঘাটন কিংবা অগণতান্ত্রিক বা অমানবিক কর্মকান্ড গুলির প্রচার সইবার মানসিকতা রাখে না। কাজেই স্বাধীন সাংবাদিকতা তাদের  প্র®িক্ষ হিসেবে পরিগণিত হবে এটিই স্বাভাবিক ।
আমরা যদি কেবল দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্র গুলির সাংবাদিকতার পরিস্থিতি বিবেচনা করি, দেখতে পাই, অনেক রাষ্ট্রই বিবর্তনমূলক আইন প্রবর্তন করেছে, নির্যাতনমূলক মানসিকতা থেকেও কেউ কেউ বেরিয়ে আসতে পারেনি।
সুখের বিষয় গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও সিভিল সোসাইটির ক্রমবর্ধমান বিকাশ, তথ্য প্রযুক্তির দ্রুত এবং প্রায় অপ্রতিরুদ্ধ অগ্রযাত্রা, এবং প্রতিটি জনগোষ্ঠীর মুক্ত বুদ্ধি বৃত্তি ও তার মনোজাগতিক বিকাশ এ প্রবণতার বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ নিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। স্বাধীন সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধ বা মুক্ত তথ্য প্রবাহ থেকে মানুষকে বঞ্চিত রাখা এখন আর সম্ভব হচ্ছে না। তথ্য লাভের অধিকার আজ স্বীকৃত গণতান্ত্রি অধিকার, যুগের দাবি।
এরপরও বলতে হবে যে, রাষ্ট্রশক্তিই স্বাধীন সাংবাদিকতার একমাত্র প্রতিপক্ষ থাকেনি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বহুবিধ নতুন প্রতিপক্ষ যারা শক্তিধর এবং কার্যকরভাবে মুক্ত, স্বাধীন সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধ করার ক্ষমতা  রাখে, নিয়ন্ত্রন বা বিধি নিষেধ আবদ্ধ রাখে। এসব প্রতিপক্ষ কখনো (২) অগণতান্ত্রিক  মানসিকতার শাসক, (৩) কখনো ক্ষমতার অবৈধ দখলদার, (৪) কখনো প্রতাবশালী কর্পোরেট  পুঁজি বা বিগ বিসনেস , (৫) কখনো সুসংঘবদ্ধ চোরাচালানি চক্র, (৬) কখনো উগ্রধর্ম বা অসহিষ্ণু আদর্শবাদী (৭) কখনো আবার উগ্রবাণিজ্যবাদী (৮) সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানের অবমূল্যায়ন বা মালিকের সম্পাদকরূপে অধিষ্ঠানও মুক্ত স্বাধীন সাংবাদিকতার নতুন এক প্রতিপক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আজও নিগৃহীত হচ্ছেন বাংলাদেশের বহু সাহসী সম্পাদক ও সংবাদকর্মি এক  বেদনাদায়ক  অধ্যায়।
এসবই একমাত্র নয়, মুক্ত ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার আরও একটি  প্রতিপক্ষ আছে  যা পাঠককে সত্য জানা থেকে বঞ্ছিত করে। (৯) সংবাদমাধ্যমের সাথে জড়িতদের গোষ্ঠীস্বার্থ, ভিন্নধর্মী রাজনৈতিক  দৃষ্টিভঙ্গি ও বিভেদ আমাদের দেশীয় প্রেক্ষাপটে স্বাধীন ও বস্তুনিষ্ট সাংবাদিকতার খুব ছোট প্রতিপক্ষ বিবেচনা করা সঠিক হবেনা।
সংবাদমাধ্যম আজ বড় পুঁজির বড় শিল্প। রাশি রাশি টাকা ছাড়া  কোনো মিড়িয়া বা সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তবে পুঁজির পুজাতেই  যদি সাংবাদিকতা নিয়ন্ত্রিত হয় তাহলে তা হয়  দূর্ভাগ্যজনক। ব্যবসা বা তেজারতি সংবাদমাধ্যমের মূল্য হলে সাংবাদিকতা বৃত্তচ্যুত, লক্ষ্যচ্যুত হয়। এ প্রবণতা সৎ সাংবাদিকতার আরও এক প্রতিপক্ষ। সংবাদপত্র বা সংবাদমাধ্যম তথ্য সরবরাহে মানুষকে ঘটনা ‘এন্টারটেইন’ করে, ‘ইনফর্ম’ করে, ‘এডুকেট’ করে, কিন্তু ব্যবসার স্বার্থে ‘এন্টারটেইনমেন্ট’-এর লক্ষ্য নির্দিষ্ট হলে তা হয় দূর্ভাগ্যজনক।
সাংবাদিকতা সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে, সামাজিক দায়বদ্ধতা, মানবাধিকার সংরক্ষণ, অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধাচারণ, দুর্বল জনগোষ্ঠির পধারণসহ নৈতিকতার ভিত্তি আছে বলে এ পেশা  সমাজকে এগিয়ে নেয়, অনুপ্রাণিত করে। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় দেশগুলোতে মানুষে মানুষে, গোত্রে-গোত্রে, বর্ণে-বর্ণে, ধর্মে-ধর্মে বিভেদকারীর সংখ্যা নগন্য নয়। কারও কারও কাছে এ বিভেদ তেজারতি বা রাজনীতি। এ বিভেদ কখনো ইতিহাস আশ্রিত, কখনো ভূ-খন্ডগত, ধর্মগত কখনো আবার লিঙ্গ ও ভাষাগত। ‘আমরা’ এবং ‘ওরা’ দূর্ভাগ্যক্রমে এটিই কারও কারও দৃষ্টিভঙ্গি! অথচ কে না জানে, এ বিভেদ যত বাড়ে ততই ব্যক্তিত্ব, সামাজিক, রাষ্ট্রিক প্রগতি বিনষ্ট হয়, মানবতা ততই প্রার্থীত প্রগতি থেকে পিছিয়ে পড়ে।
আমার বিশ্বাস, বস্তুনিষ্ঠ শান্তিবাদী সাংবাদিকতা এ প্রেক্ষাপটে যোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ নৈতিকতা সম্পন্ন বলিষ্ঠ  সাংবাদিকতা একদিকে যেমন বিশ্বাসযোগ্য তথ্য সরবরাহ করে, অন্যদিকে তা কেবল নেতিবাচক বিষয়েই সীমাবদ্ধ থাকেনা, থাকতে হয় তাকে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন এবং নিরপেক্ষ পর্যালোচনায় সমাজকে শিক্ষিত ও দায়িত্ববান করার দায়িত্বেও।  অন্যসব পেশা থেকে সাংবাদিকতার  পার্থক্য  এখানেই।
বস্তুনিষ্ঠতা, যা সত্য তাই সুন্দর। সৎ সাংবাদিকতা এ সত্যেরই আরাধনা করে। সত্যবিরোধী অবস্থান নিলে পুঁজি, রাজনীতি, নিচক ব্যবসা বা যে কোনো কোটারি স্বার্থের নামেই অবস্থান হোকনা কেন যথার্থই তা সত্য, সুন্দর ও মঙ্গলের বিপরীতে দাঁড়ায়। এতে সমাজ প্রতারিত হয়, বিভাজিত হয়, সংকট দীর্ঘায়িত হয় এবং উন্নয়ন ও অগ্রগতি ব্যহত হয়।
সমাজ ও রাষ্ট্র পদ্ধতিতে উদার গণতান্ত্রিক, সাংবিধানিক ও অসাম্প্রদায়িক ব্যবস্থা সর্বজন স্বীকৃত। সৎ স্বাধীন সাংবাদিকতা কেবল এসবের পরিপূর্বক নয়, পৃষ্টপোষকও। রাষ্ট্রশক্তি বা রাষ্ট্রমতা প্রত্যাশী রাজনৈতিক শক্তির সমালোচনা, সামাজিক অপশক্তিগুলোর  অবিচার, দুস্কর্ম, দুর্নীতিসহ নানাবিধ অনিয়ম তান্ত্রিকতা জনসম্মুখে প্রকাশ বা প্রচার করা সাংবাদিকতার আরাধ্য দায়িত্ব। কিন্তু এসব করতে গিয়ে অনৈতিকতার অভিযোগ বর্তমানে তা পেশার মহত্ব ও গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
পাশ্চাত্যে ‘পিস জার্নালিজম’ বা শান্তিবাদী সাংবাদিকতার বিষয়টি বেশ আলোচিত। যুদ্ধ, সংঘাত, দ্বন্ধে সাংবাদিকতা সত্য ও শান্তির পক্ষে কতটা ভূমিকা রাখতে পারে সে নিয়েই এ আলোচনা। পক্ষে বিপক্ষে নানা মত সত্বেও, আমি লক্ষ্য করেছি, শান্তি প্রতিষ্ঠা ও সংঘাত নিরসনে সাংবাদিকতার প্রার্থীত ভূমিকার পক্ষে মতবাদ ক্রমশই জোরদার হচ্ছে। যুদ্ধবাজ বা সংঘাতবাজ নয়, মানুষ শান্তি ও সৌহার্দ্যবাদী হবে- মানব সভ্যতার এটিই স্বাভাবিক প্রত্যাশা। কাজেই যে সাংবাদিকতা সমাজে প্রভূত প্রভাব বিস্তার করে, যা  মানুষকে নানা তথ্যে সমৃদ্ধ করে, শিক্ষিত করে, তার শান্তিবাদী ভূমিকা গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করাই সঙ্গত কাজ।
আরও একটি প্রসঙ্গ ন্যায্য কারণেই আসে। দেশপ্রেম, জাতিপ্রেম মানুষের অধিকার এবং গর্ব। রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে, গোত্রে-গোত্রে সংঘাত-সংঘর্ষ বা যুদ্ধে নাগরিক দেশ বা গোত্রভূক্ত হবেন- এটিই স্বাভাবিক প্রবণতা। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে যে সাংবাদিকতা মানুষকে সু-বুদ্ধি সম্পন্ন করে, যা বিবেক জাগ্রত করে, সঠিক সত্য উপস্থাপিত করে সে সাংবাদিকতা নিছক ‘দেশ ও জাতিপ্রেমিকতার আবেগ’ আবদ্ধ হলে, পভূক্ত হলে সত্যানুসন্ধান ও শান্তির স্বার্থে তা কতটা ভূমিকা রাখতে সক্ষম।
কাজেই সাংবাদিকতার দায়বদ্ধতা এবং পরিধি, দেশ-কাল-পাত্র নির্বিশেষে, নিরূপনের সুযোগ আছে। সৌহার্দ্য ও মানবাধিকারের স্বার্থে সাংবাদিকতার যোগ্য ভূমিকা নিরূপনের যে সুযোগ বিদ্যমান তার উপযুক্ত ব্যবহার প্রয়োজন। এ সত্য কখনোই অনস্বীকার্য নয়  যে, সাংবাদিকতা সত্য ও শান্তির স্বার্থে ভূমিকা রাখার উপযুক্ত বাহন।
লেখক: সংবাদকর্মী।

আপনার মতামত দিন

Android App
Android App
Android App
© Natun Feni. All rights reserved. Design by: GS Tech Ltd.