রিন্টু আনোয়ার |
প্রতিবছর ফ্লাইট বিপর্যয়সহ নানা ভোগান্তি সহ্য করা বাংলাদেশের হজ্বযাত্রীদের পেয়ে বসেছে মৌসুমী নাহালতের মতো। তা আমাদের গা সহাও হয়ে যাচ্ছে। যে কারণে এখন আর এ নিয়ে আগের মতো শোরগোলও হয় না। যেন বিধিলিপি। এমনটা হয়ে আসছে, হবেই। এছাড়া জঙ্গি, আইএস, জেএমবি, দুর্নীতিসহ বিভিন্ন ইস্যুর তোড়ে হজ্ব নিয়ে কী হলো ভাবনার রশ্মি এবার সেদিকে যাওয়ার ফুসরতও কম। মিডিয়ারও বোধ এ নিয়ে সংবাদ পরিবেশনের গরজ কম। ৪ আগস্ট হজ ফ্লাইট শুরু হওয়ার পর থেকে হজ্বযাত্রী সঙ্কটের কারণে একের পর এক বিমানের হজ ফ্লাইট বাতিলের খবরগুলো গণমাধ্যমে সেভাবে আসেনি। প্রতিদিন কিছু সীট খালি নিয়েই যাচ্ছে ফ্লাইটগুলো।
বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর লক্ষাধিক ধর্মপ্রাণ মুসলিম হজ্ব পালনে সৌদি আরব যায়। তাদের কিছু অংশ সরকারি ব্যবস্থাপনায় হজ্বে গেলেও বেশির ভাগই যায় বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো ধর্মীয় এ ব্যাপারটিও মুক্ত নেই অব্যবস্থাপনা, প্রতারণা আর দুর্নীতির অভিযোগ থেকে। পৃথিবীর অন্য যে কোনো দেশের হাজ্বীদের তুলনায় সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয় বাংলাদেশের হাজ্বীদের। হজ্বের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বেরোনোর পর থেকে হজ্ব সম্পাদন করে বাড়িতে ফেরা পর্যন্ত পদে পদে হয়রানি আর কষ্টের শিকার হতে হয় তাদের। মুখের হাসিতে শুরু হয়ে হজ্ব শেষ হয় চোখের পানিতে। এবার চোখের পানি ঝরা শুরু হয়েছে হজ্বের আগেই। পরে আরো কী দুর্ভোগ সইতে হবে সে দুশ্চিন্তায় হজ্ব যাত্রীরা ছাড়াও তাদের স্বজনরা।
এমনিতেই বাংলাদেশ বিমানের ইমেজ কোন পর্যায়ে তা অল্প-বিস্তর সবারই জানা। হজ্ব ফ্লাইট বাতিলের জেরে এবার বিমান হারিয়েছে হাজার হাজার যাত্রী বহনের ক্যাপাসিটি। হজ্ব যাত্রীদের পরিবহন নিয়ে অনিশ্চিয়তার সাথে আরেক দফায় লোকসানে পড়েছে বিমান। এ নিয়ে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ হজ্ব এজেন্সিজ এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-হাব ও সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। হাবের অভিযোগ, রিপ্লেসমেন্ট জটিলতার কারণে হজ্ব যাত্রীদের ফ্লাইট নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। হাব নেতারা বলেছেন, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিবের নির্দেশে হজ্ব পরিচালক রিপ্লেসমেন্ট দিতে গড়িমসি করছেন। রিপ্লেসমেন্ট দিয়ে ডিও লেটার দিতে দেরী হওয়ায় বিমানের ফ্লাইট দেয়া যাচ্ছে না। এসব কারণেই ফ্লাইট বাতিল হচ্ছে। পাল্টা অভিযোগ আছে সরকারের পক্ষ থেকেও। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা গণমাধ্যমকে বলেছেন, শতকরা তিন-চার ভাগ রিপ্লেসমেন্টের দোহাই দিয়ে টিকিট নিয়ে কারসাজি ও সংকটটি তৈরি করেছেন হাবের কিছু নেতা ও এজেন্সি। অন্যদিকে, হজ্ব ব্যবসায়ীরা সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, হজ্ব ক্যাম্পের পরিচালক কাজে খুব ধীর। কাজ ঝুলিয়ে রাখেন তিনি। তার অফিসের মূল কাজ শুরু হয় রাতে। রিপ্লেসমেন্টের ক্ষেত্রে মেডিক্যাল অফিসারের সার্টিফিকেট দেয়া হচ্ছেন না, অধ্যাপকের সার্টিফিকেট ছাড়া দেয়া হচ্ছে না রিপ্লেসমেন্ট। ফলে এজেন্সিগুলো ফ্লাইট নিশ্চিত করছে না। এতে ফ্লাইট খালি যাচ্ছে, বাতিল হচ্ছে। এসব হজ্ব যাত্রীকে পরে পাঠানো নিয়েও অনিশ্চতয়তা তৈরি হয়েছে। এছাড়া এবার সৌদিয়া এয়ারলাইন্স সিটি চেক ইন করবে না। আর বিমান গত বছর ১০ ডলারে সিটি চেক ইন করেছে। এবার অন্যায়ভাবে ৫০ ডলার নেয়ার বিষয়টি বাতিল করার দাবি জানিয়েছেন হাব নেতারা।
ধর্মমন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের কাছে হাবের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তারা বলেন, রিপ্লেসমেন্টের ক্ষেত্রে সত্যতা অবশ্যই যাচাই করতে হবে। হজ্ব নীতিমালা অনুযায়ী ৫ শতাংশের বেশী কেউ রিপ্লেসমেন্ট করতে পারবে না। কিন্তু একেকটি এজেন্সি ৪০ থেকে ৫০ জনের রিপ্লেসমেন্ট নিয়ে আসছে। আবার রিপ্লেসমেন্টের মাধ্যমে নতুন হজ্বযাত্রী পাঠাতে চায়। এজেন্সিগুলোর অনেকের ভিসা হওয়ার পরও তারা হজ্ব যাত্রীদের ফ্লাইট দিচ্ছে না। যার কারনে ফ্লাইট বাতিল হচ্ছে এবং সিট খালি যাচ্ছে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস এবার হজ্ব যাত্রী বহনে নিজস্ব বোয়িং ট্রিপল সেভেন উড়োজাহাজ ব্যবহার করছে। তাদের ১১২টি প্লাইটে ৫০ হাজার হজ্ব যাত্রী বহনের কথা। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ৫৮৬ আসনের বড় উড়োজাহাজ দিয়ে হজ্ব ফ্লাইট পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আগেই। সে অনুযায়ী লিজিং প্রতিষ্ঠান ঈগল এক্সপ্রেসের সঙ্গে উড়োজাহাজ ভাড়া করতে চুক্তি করা হয়। সৌদি আরব থেকে ১১২টি প্লাইটও (বিমান অবতরণের সংখ্যা) অনুমোদন নেয় বিমান। কিন্তু লিজিং কোম্পানির দুর্নীতি আর বিমানের পরিকল্পনা বিভাগের অজ্ঞতার কারণে সেই ভাড়ার এয়ারক্রাফট আসেনি। তড়িঘড়ি রিসিডিউল করে ৪ আগস্ট থেকে ৪১৯ আসনের উড়োজাহাজ দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করতে বাধ্য হয় বিমান। এতে প্রতি ফ্লাইটেই ১৬৭ হজ্ব যাত্রী সৌদি আরব যেতে পারছেন না। এ ছাড়া হজ্বের বিমান টিকিট নিয়ে ঘুষ বাণিজ্যের কারণে গড়ে প্রতি ফ্লাইটে ২৫ থেকে ৩০ সিট খালি যাচ্ছে। সব মিলিয়ে প্রতি প্লাইটে প্রায় ২০০ আসন খালি যাচ্ছে বিমানের। যাত্রীর অভাবে ইতিমধ্যে প্রায় ২০টি ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে কিভাবে সম্ভব হবে আগামী ৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে নির্দিষ্ট সংখ্যক প্লাইট দিয়ে ৫৫ হাজার হজ্ব যাত্রী পরিবহন? আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে বিমান যদি বড় উড়োজাহাজ ভাড়া করতে না পারে তাহলে নির্ধারিত সময়ে ৫ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার হজ্ব যাত্রী পরিবহন সম্ভব হবে না। এ জন্য বাড়তি প্লাইট নিতে হবে। শেষদিকে প্রতিদিন তিনটির পরিবর্তে ৪টি ফ্লাইট চালাতে হবে। কিন্তু হজ্বের সময় সব দেশ থেকে জেদ্দা বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ অবতরণ ও উড্ডয়ন করে। এ কারণে ইচ্ছা থাকলেও ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত ফ্লাইট বরাদ্দ দিতে পারবে না সৌদি সিভিল এভিয়েশন। ফলে হজ্ব যাত্রী পরিবহনে বড় ধরনের বিপর্যয় অপেক্ষা করছে বিমানের জন্য। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম মোসাদ্দিক আহমেদ এক পত্রিকাকে বলেন, সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় এ পর্যন্ত বিমান ৩৬টি ফ্লাইট পরিচালনা করেছে। তিনি বলেন, প্রথম দফায় লিজিং কোম্পানি ঈগল এক্সপ্রেসের মিথ্যা তথ্য দেওয়ার কারণে হজ্বের জন্য বড় উড়োজাহাজ সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। এসব কারণে দ্বিতীয় দফায় এয়ারক্রাফটের জন্য বিশ্বের সব উড়োজাহাজ কোম্পানি, লিজিং প্রতিষ্ঠানের কাছে সরাসরি চিঠি দেওয়া হয়েছে। বেশকিছু প্রতিষ্ঠান দর প্রস্তাব জমাও দিয়েছে।
পাল্টাপাল্টি অভিযোগ ও আত্মপক্ষ সমর্থন করে নিজেদের সাফাই গাওয়ার মধ্য দিয়ে দু’পক্ষই নিজেদের নির্দোষ প্রমানের চেষ্টা করছে। দু’পক্ষেরই বাড়তি সুবিধা হচ্ছে, এবার মিডিয়ার এদিকের খবরাখবর নিয়ে গরজ কম। মাঝে দিয়ে দুর্ভোগ যা হবার সেটা হচ্ছে হজ্ব যাত্রীদের। আমাদের পবিত্র ধর্মে ব্যবসাকে হালাল করা হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) ছাড়াও খলিফা ও সাহাবাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের কথা উল্লেখ করা হয়ে থাকে। বিশ্বের অন্যান্য ধর্মেও ব্যবসার অনুমোদন এমনকি উৎসাহিত করা হয়। কিন্তু ধর্মীয় বিষয় বিশেষ করে হজ্বের মতো একটি ইবাদত নিয়ে এমন নোংরা ব্যবসা অত্যন্ত মর্মপীড়াদায়ক। জাহেলি যুগ থেকে আজ পর্যন্ত একক বৈশ্বিক মহাসমাবেশ হিসেবে হজে¦র অবস্থান সবার শীর্ষে। পৃথিবীর ইতিহাসে হজ্বের মতো এত বড় জনসমাগমের নজির নেই কোথাও। হজ্বকে কেন্দ্র করে একটি শ্রেণি থাকে আল্লাহর এই মেহমানদের খেদমত করে পুণ্য অর্জন করার আশায়। আরেকদিকে এই পুণ্যযাত্রীদের সরলতাকে কাজে লাগিয়ে অল্প সময়েই বিপুল অর্থ উপার্জনের নেশায়ও থাকে অনেকে। এমন সংবাদও বেরিয়েছে, কেউ কেউ ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে ছুটে যায় মক্কা-মদিনায়। পবিত্র এই দুই নগরীতে চালায় ভিক্ষা বাণিজ্য। আবার কেউ কেউ মানবপাচারের মচ্ছবে মেতে ওঠে। প্রতিবেশি হিন্দুপ্রধান রাষ্ট্র ভারতে সরকার হজ্বে প্রচুর পরিমাণ ভর্তুকি দেয়। বাংলাদেশ সরকারের কোনো ভর্তুকি দিতে হয় না। শুধুই লাভ। বলার অপেক্ষা রাখে না, ধর্ম মন্ত্রণালয় ও ‘হাব’ কেন্দ্রিকই এই সিন্ডিকেটটি। কোটি টাকা কামিয়ে ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ হওয়ার রঙিন স্বপ্নে বিভোর থাকে এরা। একটি সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ে হজ¦যাত্রীরা। ভিসা প্রক্রিয়া, বিমানের টিকিট, বারকোড (হাজি¦দের থাকার ব্যবস্থা) সবই এই সিন্ডিকেটের হাতে। প্রতিবছরই গণমাধ্যমে ভেসে আসে হজ¦যাত্রীদের কান্নার আওয়াজ। দিন দিন এ কান্না বাড়ছেই। হজ্ব যাত্রীদের এই কান্নার পেছনে মূল কারণ, একদিকে সরকারের দায়সারা ভাব, অন্যদিকে এজেন্সিগুলোর প্রতারণা। এবার যা হওয়ার হয়ে গেছে, আগামীতে আর হবে না-এমন একটি বুঝ প্রতিবারই আমাদের দেয়া হচ্ছে। আমরা মেনে নিই, আবার ভুলেও যাই। বছর কেটে যায়। পরেরবার আবার একই কান্ড। এবারও সবে শুরু।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট