মোহাম্মদ সফিউল হক।
স্বাধীনতা! আমাদের প্রাণের স্বাধীনতা। স্বাধীনতা শব্দটি প্রত্যেকের প্রাণের চেয়েও প্রিয়। পাখি তার ভূবনে স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায়। স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায় প্রত্যেকটি পশুও। এমনকি নদীর মাছও চায় স্বাধীনভাবে জীবন চাকা ঘুরাতে। আর মানুষ! মানুষ তো আশরাফুল মাখলুকাত। সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে স্বাধীন সত্ত্বা দিয়েই সৃষ্টি করা হয়েছে। যে কারণে আমাদের শরীরের শিরা-উপশিরায়, রক্তের কণায় কণায়, চিন্তার প্রত্যেকটি গলিপথে স্বাধীনতার চেতনা আন্দোলিত হয়।
১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে ষড়যন্ত্রে পরাজিত হয়ে আমাদের স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হলেও সেই স্বাধীনতা ফিরে পেতে আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘ ২২৪ বছর। অনেক সংগ্রাম, লাখো মানুষের রক্ত, নানা বঞ্চনা আর শোষণের ইতিহাস পেছনে ফেলে বিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষ প্রান্তে এসে আমরা দেখা পাই স্বাধীনতার। এর মধ্যে আমাদেরকে পার করতে হয় দু’টি দেশের শাসন ও শোষণের দীর্ঘ প্রক্রিয়া। ইংরেজদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পরই আমাদের ঘাড়ে চেপে বসে পাকিস্তানি শাসনের ভূত। তাদের তাড়াতে, কাঁধ থেকে নামাতে আমাদের অপেক্ষা করতে হয় প্রায় ২৫ বছর। এর মাঝের ইতিহাস শুধুই অপ্রাপ্তি, হতাশা আর শোষণের। এর বিরুদ্ধে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্ব শুরু হয় ১৯৭১-এ।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১৯৭১-এর ৭ মার্চ উত্তাল জনস্রোতে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন “… ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে … আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না। … রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো, ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” তাঁর এ বক্তব্যে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠে মুক্তিপাগল বাঙালি।
২৫ মার্চের কালরাত্রিতে বর্বর পাকিস্তানী পাক হানাদার বাহিনী নিরীহ বাঙালীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লে পরাধীনতার গ্লানি মুছে ফেলতে বাঙালী অবতীর্ণ হয় মুক্তির সংগ্রামে। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, লাখ লাখ প্রাণ আর মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা।১৬ ডিসেম্বরে আসে আমাদের কাঙ্ক্ষিত বিজয়। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বরের আগেই ৬ ডিসেম্বর ফেনী হানাদার মুক্ত হয়।
সময়ের ভেলায় চড়ে আবারও এলো ৬ ডিসেম্বর। ফেনীবাসীর জন্য গৌরব, অহঙ্কার, সবচেয়ে আনন্দ ও পরম প্রাপ্তির দিন। যেদিন বাংলার বীরমুক্তি সেনানীদের দীপ্ত পদভারে প্রকম্পিত হয়েছিলো ফেনীর আকাশ বাতাস। ৭১’র এই দিনে মুক্তিযোদ্ধারা সম্মুখ সমরে পাক বাহিনী পরাজিত করে ফেনীর পূর্বাঞ্চল দিয়ে প্রবেশ করে ফেনীর মাটিতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিল। নভেম্বরের শেষ দিকে ফেনী জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধা আর মিত্রবাহিনীর প্রবল আক্রমণে দিশেহারা পাক বাহিনী আর তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আল শামস্ বাহিনী সহ মিলিশিয়া বাহিনী ফেনী জেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পালিয়ে এসে ফেনী শহরে জড়ো হয়।
ফেনী অঞ্চলের মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক হিসাবে কর্মরত তৎকালীন ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের নেতৃত্বে (পরবর্তীতে লেঃ কর্ণেল হিসেবে অবঃ) ভারতের বিলোনীয়া ও তৎসংলগ্ন অঞ্চল থেকে ১০ ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের অভিযান চালিয়ে বিলোনিয়া, পরশুরাম, মুন্সীরহাট, ফুলগাজী হয়ে যুদ্ধ করতে করতে এগোতে থাকলে পর্যুদস্ত হয়ে ফেনীর পাক হানাদার বাহিনীর একটি অংশ নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী হয়ে কুমিল্লা সেনানিবাসের রাস্তায় এবং অন্য অংশ শুভপুর ব্রিজের ওপর দিয়ে চট্টগ্রামের দিকে পালিয়ে যায়।
অপরদিকে মুজিব বাহিনীর (বিএলএফ) ফেনী মহোকুমা কমান্ডার বর্তমান ফেনী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক জয়নাল আবদীনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা দাগনভুইয়া, রাজাপুর, সিন্দুরপুর হয়ে শহরের দিকে এগোতে থাকে।ফেনী হানাদারমুক্ত হওয়ার কারণে ঢাকা-চট্টগ্রামের সাথে সড়ক ও রেল পথে হানাদার বাহিনীর যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ রূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এতে করে বাংলাদেশ স্বাধীনতার সূর্য উদিত হওয়ার বিষয়টি সময়ের ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে ফেনীর অনেকগুলো রণাঙ্গনের মধ্যে মুন্সীর হাটের মুক্তারবাড়ী ও বন্ধুয়ার প্রতিরোধের যুদ্ধ ইতিহাস খ্যাত হয়ে আছে। এ রণাঙ্গনে সম্মুখ সমরের যুদ্ধ কৌশল বাংলাদেশ, ভারত, ও পাকিস্তানী মিলিটারী একাডেমী গুলোতে পাঠসূচীর অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যা এ রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের অংহকার আর গর্বের বিষয়।মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের জন্য ফেনীর ৩১ জন মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় খেতাবে দেওয়া হয়। খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ৪ জন বীর উত্তম, ৭ জন বীর বিক্রম এবং ২০ জন বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত হন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা ফেনী সরকারি কলেজ, তৎকালীন সিও অফিসসহ কয়েককটি স্থানে স্বাধীনতাকামী নিরীহ মানুষকে নির্মমভাবে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করেছিল। স্বাধীনতার পর জেলার বিভিন্ন স্থানে আটটি বধ্যভূমিতে শহীদদের লাশ শনাক্ত করতে ছুটে বেড়িয়েছিল স্বজনহারা মানুষ। ফেনীর বধ্যভূমিগুলোর মধ্যে ফেনী সরকারী কলেজ এলাকার বধ্যভূমি, দাগনভূঁঞার রাজাপুর স্কুল এন্ড কলেজ সংলগ্ন চৌধুরী বাড়ির পার্শ্বে অরক্ষিত বধ্যভূমি, ফুলগাজীর জামুড়া গ্রামের বধ্যভূমি, পরশুরামের মালিপাথর বধ্যভূমি ও একই উপজেলার সলিয়া বধ্যভূমি উল্লেখযোগ্য। পরিতাপের সাথে বলতে হচ্ছে স্বাধীনতার ৪৬ বছর পেরুলেও ফেনীতে চিহ্নিত হয়নি অধিকাংশ বধ্যভূমি। অমর শহীদদের স্মৃতির ভাস্কর হিসেবে শহরের জেল রোডের পাশে বীর শহীদদের নামের তালিকা সম্বলিত মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয় যাতে বীর শহীদগণের নাম অস্পষ্ট , নামগুলো পড়া যায় না।
ফেনী মুক্ত দিবসে আমারা আশা করি কতৃপক্ষ ফেনীর আটটি বধ্যভুমি যথাযথভাবে চিহ্নিত করে করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করবেন, শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে বীর শহীদদের নামগুলো যাতে স্পষ্টভাবে লেখার ব্যবস্থা করবেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে ফেনীর যে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে এ ইতিহাস স্মরণ করতে ও নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানাতে ৬ ডিসেম্বর ফেনী জেলায় সরকারিভাবে ছুটি ঘোষণার আহ্বান জানাচ্ছি।একই সাথে আহবান জানাচ্ছি যে তারিখে যে জেলা হানাদার মুক্ত হয়েছে ওই তারিখে সংশ্লিষ্ট জেলায়ও সরকারিভাবে ছুটি ঘোষণা করার।
লেখক: ব্যাংকার, কবি ও প্রাবন্ধিক