পরদেশে প্রবাসীদের সংগ্রাম কেউ দেখেনা • নতুন ফেনীনতুন ফেনী পরদেশে প্রবাসীদের সংগ্রাম কেউ দেখেনা • নতুন ফেনী
 ফেনী |
১০ ডিসেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ | ২৫ অগ্রহায়ণ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

পরদেশে প্রবাসীদের সংগ্রাম কেউ দেখেনা

রাজিব বণিকরাজিব বণিক
  প্রকাশিত হয়েছেঃ  ০৭:৫৪ অপরাহ্ণ, ২২ জানুয়ারি ২০২১

আমরা যারা প্রবাসে আসি বুক ভরা অনেক স্বপ্ন নিয়ে আসি, পরিবারের মুখে হাসি ফুটাতে। নিজের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ভালো রাখতে, নিজের জন্য একটা সুন্দর ভবিষ্যত গড়তে। যেন পরিবার নিয়ে বাকি জীবন ভালোভাবে কাটাতে পারি। আশা করি আমার সকল প্রবাসী ভাইয়েরা আমার কথার সাথে একমত হবেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের সবার স্বপ্ন পূরন হয়না। তাই আমরা অনেক প্রবাসী স্বপ্নের পিছনে দৌড়াতে দৌড়াতে সারাটা জীবন প্রবাসে কাটিয়ে দিই। জীবন জীবিকার তাগিদে ২০১৬ সালে আমি প্রথম প্রবাসে পাড়ি দিই। প্রবাসে আসার পর সবকিছু কেমন নতুন লাগছে। মনে হলো অন্য এক পৃথিবীতে আসলাম। যার মাধ্যমে পরিবার পরিজন ছেড়ে প্রবাসে আসলাম সে তার রুমে আমাকে এক সাপ্তাহ রাখার পর অন্য জায়গায় আরেক জনের রুমে দিয়ে চলে যায়। কাজের কোন খবর নাই, কাজের কথা বললে সে বলে কয়েকদিন অপেক্ষা করেন তারপর কাজ হবে।

আমি কিন্তু ফ্রী ভিসায় আসছিলাম তাই ভাবছিলাম মনে হয় একটু সময় লাগবে। কিন্তু ২ থেকে ৩ সপ্তাহ যাওয়ার পর আমার কাছে আর ভালো লাগছেনা কাজের কোন সন্ধান নেই। তার উপর লোকটা ও কিছু বলছেনা আমিতো এই অচিন দেশে কাউকে চিনিনা কি করবো, কোথায় যাবো?  চিন্তায় পড়ে গেলাম। বাড়িতে ফোন করে বললাম আমি বাড়ি চলে আসবো এখানে কোন কাজ নেই। বাড়ি থেকে বলে এতগুলো টাকা খরচ করে গেলে মানুষের টাকা গুলো দিতে হবেনা, কোথায় পাবে? কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। তখন মনে হলো কেন এলাম প্রবাসে? দালাল কে কাজের কথা বললে সে বলে হবে হবে একটু সময় লাগবে । এখন কাজের বাজার একটু খারাপ। এভাবে প্রায় ১ মাস চলে যায়। ঐ দালাল মাঝে মাঝে এসে ৪ থেকে ৫ শ টাকা দিয়ে যায়। এরমধ্যে আমি ও বিভিন্ন জায়গায় কাজের খোঁজ করি কোথাও কাজ পাইনা। যা পাই বিল্ডিং কনস্ট্রাকশনের, কাজ সেটা আমি পারিনা। কখনো ভাবিনি কি দুঃসময় আমার জন্য অপেক্ষা করছে। দেশে থাকতে শুনতাম প্রবাসীরা ভালো চাকরি করে ভালো সেলারি পায়, কিন্তু আমার বেলায় তো কিছুই হচ্ছেনা। খেয়ে না খেয়ে দিন যাচ্ছে কোথাও কাজ পাচ্ছি না। এভাবে চলে গেলো বেশ কিছুদিন। পরে কি আর করবো শেষে একটা জায়গার সন্ধান পাই, যেখানে বাংলাদেশের শ্রমিকরা একসাথে দৈনিক কাজের জন্য জড়ো হয়। ওখান থেকে যাদের ভাগ্য ভালো তারা কাজে যেতে পারে। আমিও ওখানে গিয়ে অপেক্ষা করতাম কেউ কাজে নেয় কিনা। মাসে ৪ থেকে ৫ টা ডিউটি করতে পারতাম। তা দিয়ে কিছু হতোনা। রুম ভাড়া, খাবার খরচ, মোবাইল বিল সবকিছু মিলিয়ে মাসে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা আসতো। কোন মাসে হতো কোন মাসে বাড়ি থেকে টাকা এনে চলতে হতো।

এভাবেই ৮ থেকে ৯ মাস যখন যে কাজ পেতাম তাই করতাম। আমার মনে আছে এমনও দিন গেছে দৈনিক ২০০ টাকার জন্য ফুটপাতে কাপড় বিক্রি করেছি। খাওয়ার জন্য টাকা নেই দুই দিনের বাসি পচা ভাত খেয়ে চলতে হয়েছে।

কতো রাত কেঁদে কেঁদে বালিশ ভিজিয়েছি তার কোন হিসেব নেই, শুধু আমি জানি। দেনার জন্য হাত পা বাঁধা না হলে দেশে চলে যেতাম, কখনো কল্পনা করিনি এত কষ্ট করতে হবে প্রবাসে এসে। বাড়িতে ফোন দিলে শুধু বলতো চেষ্টা কর ধৈর্য ধরো, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি চলে আসার পর আমার স্ত্রী দুটো মেয়ে নিয়ে একা বাসায় কিভাবে চলছে তা একমাত্র সে জানে। কখনো টাকার জন্য চাপ দিতোনা আমাকে, ওর বিউটি পার্লার দিয়ে যা ইনকাম হতো তা দিয়ে কোন রকম চলতো এবং মাঝে মাঝে আমাকেও হেল্প করতো। নিজেকে তখন খুব অপরাধী মনে হতো, ১টি বছর চলে গেল কিছুই করতে পারলাম না। এত জায়গায় ঘুরেও একটা স্থায়ী চাকরি ঠিক করতে পারলাম না।

প্রথম চাকরির অফারঃ ৩ থেকে ৪ দিন কোন কাজ না-পেয়ে খুব হতাশা লাগছিল বাড়িতে ও যোগাযোগ করতে পারছি না, হাতেও কোন টাকা নেই। কি করবো এই ভেবে কোন কূল পাচ্ছিলাম না, আমার হাতে একটা রুপার বেসলেট ছিলো এক দেড় ভরি হবে ওটা বিক্রির জন্য একটা জুয়েলার্সের দোকানে যাই। ঐ বেসলেট বিক্রি করতে গিয়ে দোকানের মালিকের সাথে কাজের কথা বলি যেহেতু আমি সোনা রুপার কাজ যানতাম। মালিক ছিলো পাকিস্তানি, অনেক কথা বলার পর সে বলে আমার কাজ দেখবে এবং প্রথম মাসে ১০ হাজার টাকা দিবে। কি আর করবো রাজি হয়ে গেলাম। এবং কাজ করতে লাগলাম। আমার কাজ দেখে দ্বিতীয় মাস থেকে ২০ হাজার টাকা বেতন নির্ধারন করলো। এভাবে আরো ৩ থেকে ৪ মাস চলার পর আমার ভিসা কেনসেল হয়ে যায়। ৪ থেকে ৫ মাস চেষ্টা করার পরও ওই দোকানে ভিসা লাগাতে পারিনি। দোকান মালিক বলে দিলো তুমি অন্য জায়গায় চেষ্টা কর, ভিসা ছাড়া তোমাকে রাখা যাবেনা। কি আর করবো কাজের ফাঁকে ফাঁকে অন্য জায়গায় চাকরি খুঁজেছি, পরে এক লোকের মাধ্যমে একটা ফাইভ স্টার হোটেলের ক্লিনার হিসেবে চাকরি নিলাম, তাও ১০ হাজার টাকা ঘুস দিয়ে। সেই টাকাও আমার স্ত্রী বাড়ি থেকে পাঠিয়েছে। হোটেলে ৫ মাস কাজ করার পর আমার ভিসা লাগে। তারপর ওখানে কিচেনে ক্লিনারের কাজের ফাঁকে সেপদের কাজে হেল্প করতাম।

প্রবাসে ২ বছর হয়ে গেলো বাড়ির জন্য মন খুব ছটফট করছে। অনেক কষ্টে ১ মাসের ছুটি নিয়ে দেশে আসলাম। সবার সাথে ১ মাস সময় কাটিয়ে আবারও চলে আসলাম। নতুন করে শুরু হলো প্রবাসের জীবন সংগ্রাম। হোটেল এক দেড় বছর কাজ করার পর আরেক টু ভালো সেলারির আশায় অন্য জায়গায় চেষ্টা করছি। এখন বর্তমানে একটি ইতালিয়ান রেস্টুরেন্টে (কমি৩) পজিশন নিয়ে সেফের কাজ করছি। সবার দোয়ায় নিজের চেষ্টায় এখন পর্যন্ত ভলো আছি। আজ বলতে দ্বিধা নেই যে প্রবাসে এসে নিজেকে একজন ভালো মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে পেরেছি এবং এই প্লাটফর্মে এসে অনেক ভালো বন্ধু পেয়েছি। যাঁরা প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের জন্য সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। প্রবাস জীবন কষ্টের হলেও আমাকে সেই শিক্ষা দিয়েছে যেটা আমি দেশে পাইনি। জীবনে একটু ভালো থাকার জন্য প্রবাসীরা কত কষ্ট করে জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যায় তা একমাত্র প্রবাসীরাই ভালো জানে। আজ আমার এই জায়গায় আসার পিছনে শুধু একজনের অবদান আছে, আর সে হলো আমার স্ত্রী নারী উদ্যোক্তা সঞ্চিতা বনিক। আমার জন্য সে অনেক ত্যাগ শিকার করেছে। তবুও হাল ছাড়েনি। প্রতিনিয়ত পিছনে থেকে সাপোর্ট করে গেছে। প্রত্যেক অসফল মানুষের পিছনে যদি একজন ভালো মানুষের সাপোর্ট থাকে তাহলে তার সফলতা আসবেই।

লেখকঃ বাহরাইন প্রবাসী

সম্পাদনা:আরএইচ/এইচআর

আপনার মতামত দিন

Android App
Android App
Android App
© Natun Feni. All rights reserved. Design by: GS Tech Ltd.