আমাদের এক অভিভাবককে হারালাম • নতুন ফেনীনতুন ফেনী আমাদের এক অভিভাবককে হারালাম • নতুন ফেনী
 ফেনী |
১৮ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৫ বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আমাদের এক অভিভাবককে হারালাম

নাজমুল হক শামীমনাজমুল হক শামীম
  প্রকাশিত হয়েছেঃ  ০৭:৪০ অপরাহ্ণ, ০৬ জুলাই ২০২০

২০০৪ সাল। তখন আমি ম্যাস লাইন মিডিয়া সেন্টার এমএমসি’র তৃণমুল সংবাদকর্মী ও ফেনী থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ফেনী খবর পত্রিকার বার্তা সম্পাদক। তখনকার সময়ে ফেনী প্রেসক্লাবের নেতৃবৃন্দরা দুটি রাজনৈতিক দলের নেতা হওয়ায় জেলার কর্মরত সাংবাদিকরা প্রেসক্লাব বিমুখ ছিলো।

ওই বছরের ২৭ জুন খুলনার সাংবাদিক হুমায়ূন কবির বালু বোমা হামলায় খুন হন। প্রতিবাদ স্বরুপ ফেনীতে কর্মরত সাংবাদিকরা মানববন্ধন কর্মসূচী ও বিক্ষোভ করে। ফেনী সাংবাদিক ইউনিয়নের ব্যনারে হওয়া সেই মানববন্ধনে আমিও অংশগ্রহণ করি। সংগঠনের আহ্ববায়ক ছিলেন ফেনীর প্রাচীনতম পত্রিকা সাপ্তাহিক হর্কাস সম্পাদক নুরুল করিম মজুমাদর। শহরের ট্রাংক রোডের পেট্রল পাম্পের সামনে মানববন্ধনে জড়ো হলাম আমারা সংবাদকর্মীরা। নুরুল করিম কাকা আমার সামনে এসে একজনকে বললো একটা ফেস্টুন শামীমের হাতে দাও। পরে সেই ফেস্টুনটি কাকা আমার গলায় ঝুলিয়ে দিল। আমরা মানববন্ধন শেষে জেলা প্রশাসক বরাবরে স্মারকলিপিও দিয়েছিলাম।

শেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ফেনী প্রেসক্লাবের পূনর্গঠন হয়। রাজনৈতিক নেতাদের হটিয়ে সুষ্ঠ নির্বাচনের মাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকরা দায়িত্ব গ্রহণ করে। ফেনী প্রেসক্লাবের যে কমিটি হয় তাতে করিম কাকা সভাপতি ও মুন্না ভাই সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়। ওই সময়ে আমি সাপ্তাহিক জহুর পত্রিকার বিভাগীয় সম্পাদক ও মোহনা টিভির ফেনী প্রতিনিধি। সেই বছর প্রেসক্লাবের প্রথম সহযোগী সদস্য হিসেবে আমি বিবেচিত হই। করিম কাকা ও মুন্না ভাইয়ের স্নেহে ক্লাবের সকল কর্মকাণ্ডে অগ্রণী সৈনিক হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেতাম। সব কাজেই প্রথমে করিম কাকা আমাকে স্মরণ করতো। প্রেসক্লাবের কম্পিউটারে বসে আমি তখন নিউজ পাঠাতাম। করিম কাকা প্রতি মঙ্গলবার বিকেল হলেই আমাকে ফোন দিত। বলতো হর্কাস বের হবে। তোমার সব নিউজ আমাকে পেনড্রাইভে পাঠিয়ে দাও।

সাংবাদিকতার পাশাপাশি আমি অনেকগুলো সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলাম। ফেনীর প্রথম আবৃত্তি সংগঠন ‘আবৃত্তি সংসদ ফেনী’। ২০০৫ বা ২০০৬ সালে সংগঠনের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে গুণীজন সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। ওই আয়োজনে সংবাদপত্র ক্যটাগরিতে সাংবাদিক হিসেবে সম্মাননা অর্জন করে করিম কাকা।

মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘অধিকার’ গত দেড় দশকে ফেনীতে যত কর্মসূচী পালন করেছে তার প্রায় সবগুলোতে সরব উপস্থিতি ছিলো করিম কাকার। গত এক দশকে আমি ফোকাল পার্সন হিসেবে কাজ করার সময় যে কোন অনুষ্ঠানে করিম কাকাকে আমন্ত্রণ করলে তিনি সাদরে গ্রহণ করে রোদ-ঝড় মাথায় নিয়ে ঠিক সময়ে উপস্থিত হতেন।

আমি বিডিনিউজে কাজ করা অবস্থায় ২০১৪ সালে শিশুদের লিখার প্রথম ‘হ্যালো সাইট’র ফেনীর প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষক হিসেবে একটি সেশনে দায়িত্ব পালন করেছিলেন করিম কাকা। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালে ‘হ্যালো সাইট’র ফেনীর প্রশিক্ষণের উদ্বোধন ও সনদ বিতরণ অনুষ্ঠানে সভাপতির আসনও অলংকিত করেন করিম কাকা।

গত এক দশকে ফেনী প্রেসক্লাবের সকল পিকনিকের আয়োজন হয়েছে তার সবগুলোতেই তিনি ছিলেন সবার মধ্যমনি। চলতি বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি প্রেসক্লাবের পিকনিকে তিনি অসুস্থতার অজুহাতে না যেতে চাইলেও অনেকটা মনের জোরে সারাদিন কাটিয়েছিলেন সাংবাদিকদের সাথে।

প্রেস ক্লাব সিলগালার পূর্বে প্রতি মাসেই কোন না কোন সাংবাদিকের মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে স্মরণ সভার আয়োজন করা হতে। প্রতিটি স্মরণ সভায় করিম কাকা তার তরুণ বয়সের সাংবাদিকার ম্মৃতি তুলে ধরতেন। আন্দোলন, সংগ্রাম, ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে তথ্যের পেছনে ছুটে চলতেন করিম কাকা। গত কয়েক বছর ধরে কাকা আমাকে ফেনী প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিতে অনেকবার অনুরোধ করেন। তবে অনেকটা অভিমান করেই সেই দায়িত্ব গ্রহণ করা থেকে আমি বিরত থাকি।

এইতো অসুস্থ্য হওয়ার কয়েকদিন আগে সন্ধ্যায় আমাকে ফোন করে কুশলাদি জেনে নেন কাকা। করোনার এই মুহুর্তে তখন আমাকে সাবধানে চলার পরামর্শও দেন করিম কাকা। আজ সেই কাকাই করোনার উপসর্গ নিয়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে।

বরেণ্য সাংবাদিক নুরুল করিম মজুমদার কেবল এ জনপদের প্রাচীণতম সাপ্তাহিক হকার্স সম্পাদকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন সাংবাদিকদের একজন অভিভাবকও। হাতে-কলমে শিখিয়েছেন অনেককে। তাঁকে বলা যায় মফস্বলে সাংবাদিকতার শিক্ষকও। তাঁর হাত ধরে আজ কেবল জেলা শহরে নয়, জাতীয় পর্যায়েও গণমাধ্যমে অবদান রাখছেন। বর্তমানে প্রথম আলো’র চিফ রিপোটার টিপু সুলতান, সিনিয়র রিপোর্টার সেলিম জাহিদ, ডিবিসি নিউজের সিনিয়র রিপোর্টার আদিত্য আরাফাত এর মতো অনেক রিপোর্টারকে হাতে কলমে তৈরী করেছিলেন করিম কাকা। এমন একজন বটবৃক্ষকে হারিয়েছে ফেনীর সাংবাদিকরা। মফস্বল সাংবাদিকতায় অনুকরণীয় আদর্শ হয়ে থাকবেন নুরুল করিম মজুমদার।

ফেনীর সাংবাদিকতায় আলোকবর্তিকা নুরুল করিম মজুমদারের কর্মজীবনের বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ টেলিভিশন, ইউনাইটেড নিউজ অব বাংলাদেশের (ইউএনবি), দৈনিক দি ডেইলি স্টার, ডেইলি নিউ এইজ, দৈনিক দেশ বাংলার ফেনী প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন। এছাড়া তৎকালীন ইস্টার্ণ নিউজ এজেন্সির (এনা) সাবেক নোয়াখালী প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছিলেন। মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৯ বছর ধরে ফেনীর প্রাচীনতম পত্রিকা সাপ্তাহিক হকার্সের সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন।

বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী নুরুল করিম মজুমদার ছিলেন তিনি ফেনী প্রেসক্লাবের একাধিকবার সভাপতি। তিনি বাংলাদেশ ফটো জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন ফেনী জেলা শাখার প্রতিষ্ঠাতা উপদেষ্টা, ফেনী ডায়াবেটিক হাসপাতালের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তা ও আজীবন সদস্য, ফেনী সেন্ট্রাল হাই স্কুল গভর্নিং কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন।
লেখক : জেলা প্রতিনিধি, বিডি নিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম ও দৈনিক মানবজমিন। ফোকাল পার্সন, অধিকার।

আপনার মতামত দিন

Android App
Android App
Android App
© Natun Feni. All rights reserved. Design by: GS Tech Ltd.