একটি নক্ষত্রের পতন এবং তাঁর উত্তরাধিকার • নতুন ফেনীনতুন ফেনী একটি নক্ষত্রের পতন এবং তাঁর উত্তরাধিকার • নতুন ফেনী
 ফেনী |
১৬ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৩ বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

একটি নক্ষত্রের পতন এবং তাঁর উত্তরাধিকার

শাবিহ মাহমুদশাবিহ মাহমুদ
  প্রকাশিত হয়েছেঃ  ১২:৫৩ পূর্বাহ্ণ, ০৭ জুলাই ২০২০

আশৈশব ‘পরবাসে’ বেড়ে ওঠা এই আমি জন্মভূমি ফেনীতে ফিরেছি ২০০৬ সালের মাঝামাঝিতে। একটা পৌরাণিক মায়াচ্ছাদিত উজ্জ্বল প্রাচীন শহর ময়মনসিংহ ক্রমশ ধূসর হয়ে উঠছে আমার কাছে। যদিও ব্রহ্মপুত্রের জন্য প্রবল ক্রন্দনে বুকটা ভারী হয়ে ওঠে মাঝে মাঝে। এমনতর নিঃসঙ্গ ও অসহ্য নীলযন্ত্রণায় আমার নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে ওঠে রাজাঝি দিঘি, ফেনী জংশন ও শহরের পথঘাট। এরপর একদিন এ যন্ত্রণাকে অনেকটাই লাঘব করে বৃষ্টির ঝাপটা নিয়ে এলো কয়েকজন সৃষ্টিমুখর তরুণ। তানিম কবির-রুদ্র হক-আদিত্য আরাফাত-উৎপল সুজন-মারজুক রবীন। কবিতাই ছিল আমাদের ধ্যান-জ্ঞান। তাদের সঙ্গে আমার বয়সের ফারাক দশ থেকে বারো বছর তো হবেই। তবু, বন্ধু হতে কোনো বাধ সাধেনি ওদের বয়স। মাঝে-সাঝে আসে রাশেদুল হাসান-অনার্য মুর্শিদ। প্রতিদিন সন্ধ্যায় রাজাঝি দিঘির পাড়ে বসে অনিকেত ম্যারাথন আড্ডা। পরম কৌতুহলে জানতে থাকি এ শহরকে। চিনতে থাকি এ শহরের ভালো-মন্দ মানুষদের।

পত্রিকার শহর এই ফেনীতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সংবাদপত্র প্রকাশের হিড়িক দেখে প্রথমত কিছুটা বিচলিত হলেও ‘ভালো পত্রিকা’ চিনে নিতে দেরি হয়নি খুব। পথ-হকার্স-ফেনীবার্তা-জহুর-আলোকিত ফেনী তখন সমান তালে বেরুচ্ছে। সেসব আড্ডাতেই শুনেছিলাম নুরুল করিম মজুমদার-আবু তাহের-মীর হোসেন মীরু-সামছুল হক প্রমুখের নাম। তবে যাঁকে নিয়ে এই লেখা-সেই নুরুল করিম মজুমদার সম্পর্কে প্রথমত আদিত্য আরাফাতের উচ্ছ্বাস আমার মনোযোগ আকর্ষণ করে। আদিত্য, করিম ভাই সম্পাদিত সাপ্তাহিক হকার্সে কাজ করে। আদিত্য আমাদের সান্ধ্য আড্ডায়, তা যত সিরিয়াসই হোক, নিয়মিত ছেদ দিয়ে সে হঠাৎ-ছুটি নেয় এই বলে যে, পত্রিকা বের হবে, দেরি হলে করিম ভাই রাগ করবেন। এ বিষয়ে আমি আদিত্যকে সমর্থন জানালেও রুদ্র-তানিম ওকে টিপ্পনি কাটত। আমি বলতাম, কবিতার বাইরে সংবাদপত্রও একটি বড় সৃষ্টিশীল প্লাটফর্ম। তানিম-রুদ্র, আমার ও আদিত্যের দিকে চেয়ে ‘হে হে’ করে হেসে বলত-পত্রিকা আবার কিভাবে সৃষ্টিশীল প্লাটফর্ম! পরে অবশ্য ওরা তা স্বীকার করেছে এবং পেশাসূত্রে দুজনই সংবাদপত্রেই বিসর্জিত হয়েছে।

২০০৭ সালে ওদেরকে সঙ্গে নিয়ে ফেনীতে প্রতিষ্ঠা করি ফেনী সাহিত্য সংসদ। যা ছিল, আধুনিক ধারার সাহিত্যচর্চায় একটি মাইলস্টোন। এই ছোট্ট শহর ফেনীতে, সে সংগঠনের পথচলাটি আমরা একটু বড় করেই আয়োজন করেছিলাম। ঢাকা থেকে এসেছিলেন বরেণ্য তিন কবি- সমুদ্র গুপ্ত-আমিনুর রহমান সুলতান-চঞ্চল আশরাফ। আজ এই ভেবে ভালো লাগছে যে, শহিদ জহির রায়হান হলে আমাদের সেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অতিথি হিসাবে পেয়েছিলাম সদ্যপ্রয়াত অগ্রজ সাংবাদিক নুরুল করিম মজুমদারকে। আরো পরে-২০০৯ সালে আমি যখন সাপ্তাহিক ‘ফেনীবার্তা’য় সবেতনে কাজ শুরু করি, তখন জানতে পারি, আমার সম্পাদক মীর হোসেন মীরু ভাইয়ের সাংবাদিকতার হাতেখড়ি হয়েছিল এই নুরুল করিম মজুমদারের হাতেই। এই অর্থে করিম ভাই ছিলেন আমার গুরুর গুরু। ফলে সঙ্গত কারণেই তাঁর প্রতি আলাদা সমীহ কাজ করত। পরে জেনেছি এবং বুঝেছি নুরুল করিম মজুমদার সম্পাদিত হকার্স ছিল প্রকৃতই বহু সাংবাদিকের আঁতুরঘর। করিম ভাই সম্পর্কে মীরু ভাইয়ের শ্রদ্ধা ও উচ্ছ্বাস ছিল দেখার মত। কয়েক বছর আগে আমি দৈনিক সংবাদের ফেনী জেলা প্রতিনিধি হিসাবে নিয়োগ পেলে, তিনি একদিন আমাকে ডেকে বললেন, শাবিহ, আমার অফিসে তোমার পত্রিকা পাঠানোর ব্যবস্থা কর, মাস শেষে বিল দেব। এটি আমার একটি আনন্দস্মৃতি।

নুরুল করিম মজুমদার প্রসঙ্গে ‘গুরুর বিদায়: একটি ইতিহাসের সমাপ্তি’ শীর্ষক লেখায় ফেনী প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি আসাদুজ্জামান দারা যথার্থই বলেছেন, ‘‘তিনি শুধু একজন আপাদমস্তক সাংবাদিকই ছিলেন না। তিনি ছিলেন সাংবাদিকতার শিক্ষক। নিজে সাংবাদিকতায় পড়াশোনা করেন নি। কিন্তু সাংবাদিকতার ছাত্রদের পড়াতে পারতেন অনায়াসে। সেই জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, বিচক্ষণতা ও গভীর পান্ডিত্য তাঁর মাঝে ছিল। আমার মতো এমন বহু পেশাদার সাংবাদিকের গুরু ছিলেন নুরুল করিম মজুমদার। একটি ছোট মফস্বল শহর থেকে একটি সাপ্তাহিক কাগজ ৩৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে নিয়মিতভাবে প্রকাশ করে তিনি সাংবাদিকতায় এক অনন্য নজীর স্থাপন করে গেছেন। করিম ভাই ছিলেন যেন এক জীবন্ত ইতিহাস। ফেনীর অর্ধশত বছরের সাংবাদিকতা, রাজনীতি, সামাজিক-সাংস্কৃতিক তৎপরতা, প্রশাসনের খবরাখবরসহ নানা বিষয় ছিল তাঁর মুখস্ত। সংবাদ নির্মাণ, সংবাদ সম্পাদনায় ছিলেন অতীব দক্ষ।’’

আরো পরে একটু একটু করে মিশেছি তাঁর সঙ্গে। সবিনয়ে সালাম দিয়ে সামনে দাঁড়ালে, তিনি স্নেহভরে কাছে টানতেন। জিজ্ঞেস করতেন কুশলাদি। তাঁর কণ্ঠে আন্তরিকতা ঝরে পড়ত যথারীতি। ততদিনে কিছুটা সাহস সঞ্চয় করেছি। একদিন কথাপ্রসঙ্গে তিনি বললেন, পত্রিকা বের করা তো এখন কঠিন হয়ে পড়েছে, চৌদ্দ নম্বর পত্রিকার কি দৌড়াত্ম-দেখছো নি? আমি সায় দিয়ে বলেছিলাম, ভাইয়া হকার্স যেন বন্ধ না হয়। কারণ আপনার হকার্স তো ফেনীর ইত্তেফাক। একথা শুনে তিনি হো হো করে হেসে উঠলেন। এর মাঝে মাসিক সরাসরিতে যুক্ত থাকার ধারাবাহিকতায় পত্রিকার সম্পাদক মুহাম্মদ আবু তাহের ভূঁইয়া ভাই, আমার আলস্য মেনে নেওয়ার পরও আমাকে একদিন পাঠালেন করিম ভাইয়ের কাছে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নিতে। সে কাজটি কিছুটা করার পর, ‘আরেকদিন এসো’ বললেন তিনি। আমি বললাম, ভাইয়া, দুতিনদিন পর আসব? তিনি বললেন, না ব্যস্ত আছি, দশ-পনেরদিন পরে এসো। পরে আমি বেমালুম ভুলে গেলে তা আর চূড়ান্ত করতে পারিনি! তাঁর সান্নিধ্যে আসার আরেকটি স্মৃতি মনে পড়ছে। গত বছর ফেনী সেন্ট্রাল হাই স্কুলের পুনর্মিলনী চলছে জোরালোভাবে। এ উপলক্ষে একটি স্যুভেনির বের করবে বিদ্যালয়। তিনি এ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি। একদিন আমাকে ফোন করে ডেকে নিয়ে স্যুভেনিরের শিল্প নির্দেশক হিসাবে দায়িত্ব দিলেন। এ সময় প্রায় মাসখানেক প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা তাঁর সঙ্গ পেয়েছি। দেখেছি, তিনি তাঁর দায়িত্বের ব্যাপারে কতটা সচেতন ও আন্তরিক।

করিম ভাইয়ের ব্যক্তিত্বের যে বিষয়টি আমাকে বেশি আকর্ষণ করেছে তা হল, বিভিন্ন সভাসমাবেশে বক্তব্যকালে তিনি ‘টু দ্য পয়েন্ট’ কথা বলতেন। তিনি বিষয়ের মধ্যে থাকতেন এবং সে সংক্রান্ত ইতিহাস ও পরিসংখ্যান তুলে ধরে কথা বলতেন। তাঁর বক্তব্য মানেই নতুন কোনো ইনফরমেশন, নতুন কোনো দৃষ্টিভঙ্গি। আর তা ফুটে উঠত সংক্ষিপ্তভাবে। বিষয়ের মৌল চুম্বকঅংশ তিনি সহজেই চিহ্নিত করতেন। ফেনী প্রেস ক্লাবের বিভিন্ন সভায়ও তাঁর বক্তব্য দেখে বারবার মুগ্ধ হয়েছি। তিনি যা বিশ্বাস করতেন, জোরালোভাবেই তা উপস্থাপন করতেন। মনে এক, আর মুখে আরেক-এমন মানসিকতা তিনি ঘৃণা করতেন প্রবলভাবে। একজন সাংবাদিক হিসাবে নিজ পেশার সম্মান ও পেশাদারী মনোভাবের বিষয়ে তিনি বরাবরই কঠোর ছিলেন। সাংবাদিকদের প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়াকে তিনি সর্বাগ্রে গণ্য করতেন। এ ব্যাপারে তিনি বিন্দুমাত্র ছাড় দিতেন না।এ নিয়ে এক সময়ের ‘আমরা’ আজ দ্বিধাবিভক্ত। তবু সত্যের-মানবিকতার যে মশাল তিনি বয়ে এনেছেন, তাকে বয়ে নিতে হবে আমাদেরই, পরবর্তী প্রজন্মকে। আজ তিনি শারীরিকভাবে আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু রয়ে গেছে তাঁর সেই তেজদীপ্ত বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। নুরুল করিম মজুমদার- নামটি ফেনীর সাংবাদিকতার আকাশে এক নক্ষত্র হয়ে ফুটে থাকবে। এই নক্ষত্রের বিদায়কে আমরা ‘আপাত পতন’ বলে মনে করি। তিনি আবার উদিত হবেন তাঁর সন্তান ও সাগরেদদের মাঝে, আদর্শ সাংবাদিকতার আলো নিয়ে।

করিম ভাই, আপনি আমাদের পাশেই থাকবেন, আমরা যেন পথ না-হারাই। আমাদের চারপাশে এখন খুব ঘুটঘুটে অন্ধকার। দশদিকে নাগিনীর বিষাক্ত নিঃশ্বাস। আপনি নক্ষত্রের আলো হয়ে আমাদের পথ দেখান। আমরা, আপনার অধম অনুজেরা আপনাকে যেন ভুলে গিয়ে কখনও ভুল পথে পা না-বাড়াই। এই দেখুন, আমরা আছি আপনার আদর্শের পথে, আমাদের সীমিত সামর্থ নিয়ে। আপনি আমাদের উপর বিশ্বাস রাখুন, আমরা শত প্রতিকূলতা মাথায় নিয়ে শেষ অব্ধি লড়ে যাব। কারণ আমরা বিশ্বাস করি, আপনি আমাদের মাঝেই আছেন, আমাদের অগ্রভাগে, বলিষ্ঠ ও ঋজুতার প্রতীক হয়ে।চিরসবুজ ও চিরদিনের সাহস হয়ে..।
লেখক: কবি; ফেনী প্রতিনিধি, দৈনিক সংবাদ

আপনার মতামত দিন

Android App
Android App
Android App
© Natun Feni. All rights reserved. Design by: GS Tech Ltd.