ড. মো. মেহেদী হাসান।
মুদ্রণ শিল্পের কথা; অতীত ও বর্তমান আরিফুল আমিন রিজভীর একটি গবেষণামূলক গ্রন্থ। এ গবেষণা আসলে মুদ্রণ শিল্পের ইতিহাসের অনুসন্ধান। প্রথমেই বলে রাখি, এ গ্রন্থ নামকরণে একটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। খুব সংক্ষিপ্ত আকারে বৈশ্বিক ও দেশীয় প্রেক্ষাপটে মুদ্রণ শিল্পের কিছু কথা থাকলেও এ গ্রন্থ প্রধানত ফেনীর মুদ্রণ শিল্পের ইতিহাস রচনার চেষ্টা। তাই নামকরণে বিষয়টি স্পষ্ট করা হলে আরও ভালো হতো। তবে আরিফুল আমিন রিজভী শেষোক্ত কাজটি নিষ্ঠার সঙ্গে করেছেন। শুরুতেই তিনি বলে নিয়েছেন কাজটি তিনি কীভাবে করেছেন তা। তিনি পাঠককে জানাচ্ছেন, ‘ঘটনার বর্ণনা ও পর্যবেক্ষণ রিসার্চ টুল্স হিসেবে বেশী প্রাধান্য পেয়েছে’। এ ছাড়া তাঁর উপায়ও ছিলো না। আমাদের এ অঞ্চলে ডকুমেন্টেশন অত্যন্ত দুর্বল। তাই লিখিত উপকরণ ব্যবহার করে ইতিহাসচর্চা প্রায় অসম্ভবের পায়ে শিকল পরানোর চেষ্টা মাত্র। আরিফুল আমিন রিজভীর ইতিহাসচর্চা নিকট অতীতকে নিয়ে ফলে মৌখিক সাক্ষাৎকার তাঁর প্রধান অবলম্বন ছিলো। আরিফুল চেষ্টা করেছেন। একটা তথ্য যাচাইয়ে তিনি ৩মাস সময় নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন। এটা তাঁর নিষ্ঠার পরিচয় বহন করে। এর বিকল্পও ছিলো না তাঁর কাছে। মৌখিক তথ্য প্রামাণ্যীকরণের প্রয়োজন হয়। ্একাধিক সূত্র থেকে যাচাই না হলে ভুল ভ্রান্তি হতে পারে। সে দিকটা তিনি সযতেœ খেয়াল রেখেছেন। এ কৃতিত্ব তাঁকে দিতে হয়।
এক.
আমাদের প্রচলিত ধারণা, বই প্রকাশের প্রয়োজনে মুদ্রণযন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয়ে থাকে। কিন্তু আরিফুল আমিন রিজভীর গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বিগত শতকের চল্লিশের দশকে ফেনীর মুদ্রণ শিল্পের বিকাশে বড় ভূমিকা রেখেছে দেশভাগের পর টেন্ডু পাতা আমদানি কমে যাওয়া। বিড়ির লেবেল ছাপানোর প্রয়োজনে উদ্যোক্তারা ‘মুদ্রণেও এগিয়ে আসে’। সে সময়ে তামাকসেবীদের আধিক্যের সামাজিক বাস্তবতাটাও আমরা পাচ্ছি। এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলে রাখি, লেখক চল্লিশের-পঞ্চাশের দশক যখন বলছেন তখন পাঠককে মনে রাখতে হবে এটা বিংশ শতাব্দীর চল্লিশ পঞ্চাশ হবে। কারণ আমরা ইতোমধ্যে একবিংশ শতাব্দীর ১৭ বছর পেরিয়ে এসেছি। ভবিষ্যৎ সংস্করণে বিষয়টি পরিষ্কার করে দেওয়া হবে আশা করি।
গবেষককে খুব বেশি উচ্ছ্বসিত হতে দেখা যায়, ফেনীর প্রথম ছাপা খানা আবিষ্কারের আনন্দে। এর জন্যে তাঁকে খাটতে হয়েছে অনেক। আমরাও মনে করি এটা একটা মূল্যবান আবিষ্কার। গবেষক বলছেন, “ আবিষ্কার ছোট হোক কিংবা বড়, এর একটি এ্যাডভেঞ্চার রয়েছে। ফেনীর প্রথম ছাপাখানা আবিষ্কারের বিষয় খুব কঠিন কিছু ছিলনা। তবে অনেকগুলো ঘাট পেরিয়ে এ তথ্য উদ্ধার করতে হয়েছে। এ শিল্পের উল্লেখযোগ্য দিক ছিল বিভ্রান্ত হওয়া। একেক সময় একেক স্তর ছাপাখানাকে প্রথম প্রতিষ্ঠান মনে হচ্ছিল। … … ফলে লোকমুখে যা রচিত হয়েছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেসব তথ্যকে সামনে রেখে অগ্রসর হতে হয়েছে। যদিও পরবর্তীতে বিভিন্ন সূত্র পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে বইয়ের এ অংশটি তথ্যপূর্ণ করতে প্রায় তিনমাস সময় ব্যয় করতে হয়েছিল।” আরিফুল আমিন রিজভীকে ধন্যবাদ তিন মাস সময় ব্যয় করেছেন বলে আমরা তথ্যটা পাচ্ছি।
অধ্যায় কথাটা উল্লেখ না থাকলেও অধ্যায়-ভিত্তিক দশক-ওয়ারি বিভাজনের মধ্য দিয়ে এ গ্রন্থে ফেনীর মুদ্রণ শিল্পের বিকাশটা পাচ্ছি স্বল্প পরিসরে। এটা কম মূল্যবান নয়। খুব প্রত্যাশিত ছিলো শুরু থেকে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত অন্তত প্রতিনিধিত্বশীলদের সম্পর্কে কিছু তথ্য জানা। সেটা পরিপূর্ণভাবে না পেলেও পঞ্চাননকে পাচ্ছি একটা অধ্যায়ে। আমরা বাংলা মুদ্রণশিল্পের আদি-পুরুষ পঞ্চানন কর্মকারকে জানি। ফেনীর পঞ্চানন দাসকে নিয়ে একটা অধ্যায় করেছেন গবেষক। তাঁর ছবি ও কাঠের ব্লকের কিছু নমুনাও দিয়েছেন। নমুনাগুলো দেখলেই বোঝা যায় কতোগুণী শিল্পী এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন সেকালে। গবেষক বলছেন, “পঞ্চানন দাসের উদ্ভাবনী মেধা, সৃষ্টিশীলতা এবং খ্যাতি সম্পূর্ণরূপে লেটার প্রেস প্রযুক্তি কেন্দ্রিক। সাড়ে পাঁচশত বছরের মুদ্রণযন্ত্র ও পদ্ধতির আমুল পরিবর্তন আসে বিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে এসে। সাড়ে পাঁচশত বছরের ব্যাপ্তিকালে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে জন্মেছে বিরল মেধাবীরা, পঞ্চানন দাস তাদের একজন।” ফেনী জেলা মুদ্রণশিল্প মালিক সমিতির সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত পাচ্ছি পরবর্তী অধ্যায়ে। সে সঙ্গে শ্রমিক আন্দোলনের একটা রূপরেখাও। প্রযুক্তির বিবর্তনে শ্রমিকদের অবস্থা তুলে ধরতে গিয়ে লেখক বলছেন: “ অফসেট মুদ্রণ প্রযুক্তি সংযুক্তির ফলে মুদ্রণ শিল্পে অনেক মেধাবী শ্রমিক কর্মহীন হয়ে যান। কম্পোজ, ডিজাইন সবই এখন কম্পিউটারে হচ্ছে। হাতের অক্ষর সংযোজনের বিষয়টি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অভিজ্ঞ ও দক্ষ জনশক্তি হয়ে যায় অপ্রয়োজনীয়। বয়সের ভারে এবং প্রযুক্তির বিমুখতার ফলে অনেকে স্বেচ্ছায় ছাপাখানার কাজ ছেড়ে দেন, কেউ কেউ চাকরিচ্যুত হন; এ অধ্যায়টুকু হৃদয়বিদারক। যাদের নিপুণ ছোঁয়ায় নির্ভুল ছাপার কাজ করে ছাপখানাগুলো সুনাম অর্জন করেছে তারা একই প্রতিষ্ঠানে বোঝা হিসেবে মূল্যায়িত হয়েছেন। চাকরীর শেষে দিনগুলোতে নিজেকে এভাবেই আবিষ্কার করেছেন সুকুমার চন্দ্র দাস। ১৯৮৬ সালে চাকরী ছাড়ার পর আর কখনো ছাপাখানার দিকে পা বাড়াননি।”
দুই.
গ্রন্থের শেষ দিকে ১৯৭০ সালে প্রকাশিত পূর্ব-পাকিস্তান মুদ্রণ শিল্প সমিতি, নোয়াখালী জেলা শাখার সম্মেলনের স্মরণিকা ‘শৈল্পিক’ মুদ্রিত হয়েছে। এটা পরিশিষ্ট আকারে দেওয়া যেতো। তাতে গ্রন্থটির প্রকাশনা সৌষ্ঠব বৃদ্ধি পেত। ভেতরের লেখার দুএকটি ছবি দেওয়া হলেও ‘শৈল্পিক’-এর প্রচ্ছদ ও বিজ্ঞাপনগুলোর নমুনা ছবি আকারে ছাপা হলে ভালো হতো। এ কালের পাঠক কিছু লেটার প্রেসের নমুনাগুলো দেখতে পেতো। ‘শৈল্পিক’এ যাঁরা লিখেছেন তাঁরা মুদ্রণ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। তাই এসব লেখা মূল্যবান। অনেক সামাজিক উপাদান এতে পাওয়া যায়। তবে বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে জালাল উদ্দিন আহমদের লেখাটা। “অভিজ্ঞতা” শিরোনামে জালাল উদ্দিন আহমদের ক্ষুদ্র লেখাটি সাবজেকটিভ ভঙ্গিতে রচিত হলেও এতে এ শিল্পের সে সময়কার সমস্যাগুলো চমৎকারভাবে চিহ্নিত হয়েছে। উন্নত প্রযুক্তির একালেও সমস্যাগুলো বর্তমান সময়ে সমান প্রাসঙ্গিক। জালাল উদ্দিন আহমদ জানাচ্ছেন: আমি জানি সাধারণত অন্যান্য কলকারখানার শ্রমিকদের মতো উচ্চ মজুরীর জন্য মুদ্রণ শিল্পের শ্রমিকরাও দাবী উঠায়। কিন্তু মুদ্রণ শিল্পের স্বল্প আয়ের জন্য সব সময় শ্রমিকদের দাবী পূরণ করা সম্ভব হয় না বলে শ্রমিক অসন্তোষ প্রায় লেগেই থাকে। এতে করে কাজের (যা থাকে) ব্যাঘাত ঘটে বেশী এবং উৎপাদনও কমে যায় বহু পরিমাণে।”
তিন.
মুদ্রণ শিল্পের কথা: অতীত ও বর্তমান আরিফুল আমিন রিজভীর একটি মান সম্মত প্রকাশনা। সাধারণভাবে মনে করা হয় মফস্বল শহর থেকে বই প্রকাশিত হলে কিছু দুর্বলতা থেকেই যায়। মুদ্রণ শিল্পের কথা: অতীত ও বর্তমান গ্রন্থটি এহেন দুর্বলতা মুক্ত। এতে উচ্চমানের কাগজ ব্যবহার করা হয়েছে। ছাপায়ও রয়েছে যতেœর ছাপ। পারমিতা প্রিসলির প্রচ্ছদটি অত্যন্ত প্রসঙ্গিক ও দৃষ্টিনন্দন। তবে কিছু কিছু বানান ভুল দৃষ্টিকটু। এগুলো পরিহার করা সম্ভব হলে গ্রন্থটির মান আরও বৃদ্ধি পেত।
সব শেষে এ গ্রন্থের সাফল্য কামনা করি। আঞ্চলিক ইতিহাস রচনায় আমরা যদি এভাবে এগিয়ে না আসি তাহলে জাতীয় ইতিহাসে পূর্ণতা আসবে না। মুদ্রণ শিল্পের কথা: অতীত ও বর্তমান এ ক্ষেত্রে এ গ্রন্থটি একটি প্রচেষ্টা মাত্র। ভবিষ্যতে আরও কাজ হবে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে শেষ করছি।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ।