আধুনিকতার অবক্ষয়ী চেতনার বিপরীতে নৈঃসঙ্গ ও আত্মমগ্নতাই আল মাহমুদের কবিতার উপজীব্য। নৈরাশ্য কিংবা অচরিতার্থ জীবনের হাহাকার নয়, স্বগৃহে প্রত্যাবর্তনের কাঙ্ক্ষা-ই তার মূল অনুষঙ্গ। ছন্দ-নির্বাচন, আঙ্গিক ও অলঙ্কারের পাশাপাশি বিষয় নির্বাচনে আল মাহমুদ ঐতিহ্যিক-মিথাশ্রয়ী। সে সঙ্গে স্বকালচেতনায়ও প্রোজ্জ্বল। আল মাহমুদ জীবন ও কবিতাকে দেখেছেন অভিন্ন দৃষ্টিতে। ফলে তার একাধিক কবিতায় এ দুটি বিষয় একীভূত হয়েছে।ইতিহাস ও জাতিগত চেতনার সঙ্গে সমন্বয় করে লোকজ উপাদানকে করে তুলেছেন কবিতার অন্তর্গত। কেবল গ্রামীণ-জীবন যাত্রা-ই নয়, নাগরিক বোধ, প্রকৃতি, নারী, মানবপ্রেম, যৌনচেতনা, অধ্যাত্ম্য-সংকট ও মৃত্যুচেতনা কবিতার বিপুল অংশে প্রচ্ছন্ন। প্রাচীন কবিতা, বাউল-সম্প্রদায়, কৃষকসহ নিম্নবর্গের শ্রমিক সম্প্রদায়, লোকধর্ম ও ঐশীধর্ম, সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের রূপান্তর ঘটিয়েছেন তিনি।আত্মপরিচয় জানার স্পৃহার সঙ্গে-সঙ্গে আত্ম-উন্মোচনেও কবি উন্মুখ। একদিকে সারল্য ও বিস্ময়, অন্যদিকে বর্বরতা—এই দুই বিপরীত স্বভাবের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে আধুনিক মানুষের চারিত্র্য। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সঙ্গত উচ্চারণ—‘সে অলীক মুহূর্তের ক্রোধ/ জয় করে দেখি আমি, কেবলই আমার মধ্যে যেন এক/ শিশু আর পশুর বিরোধ’ (বিষয়ী দর্পণে আমি)। কালজ্ঞান ও ইতিহাসচেতনা সময়ের প্রধান কবিকে করে তোলে কালের সাক্ষী, অতীতের ভাষ্যকার এবং ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। তিনি সভ্যতার পর্যবেক্ষক, সংস্কৃতির বিশ্লেষক—এক কথায় নির্মোহ বিচারক।আধ্যাত্মিকতা, প্রেম, প্রার্থনা আর কামনা-বাসনার সম্মিলনে এক অপূর্ব আশ্চর্য রসায়নের কবি!
০২.
নারীই শিল্পের মহাশক্তি। পৃথিবীতে যত কবিতা মহাকাব্য লিখা হয়েছে তার অধিকাংশই নারী বিষয়ক। পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ মহাযুদ্ধ হয়েছে নারীকে কেন্দ্র করেই। আল মাহমুদের কবিতায় নারী তার সমস্ত সৌন্দর্য আর উচ্ছ্বলতা নিয়ে হাজির হয়। কবি তার নারীকে রূপ আর জৈব তৃষ্ণার আঁধার করে খোলা তরবারির মত হাজির করেন। নদীর ঢেউ আর ভাংগা গড়ার চলার ছন্দের সাথে নারীর শরীরের ভাঁজ, শিহরণ আর গতিময়তার চমৎকার সাদৃশ্য ভিন্নতর ব্যঞ্জনা দান করে।
“ক্ষুধার্ত নদীর মতো তীব্র দুটি জলের আওয়াজ তুলে
মিশে যাই চলো অকর্ষিত উপত্যকায়
চরের মাটির মতো খুলে দাও শরীরের ভাঁজ’’ (সোনালী কাবিন)
কবি আল মাহমুদ তিরিশোত্তর কবিদের চাইতে ভিন্ন তাঁর শব্দ ব্যবহারের চমকপ্রদ ব্যবহারে । গ্রামীন শব্দ তিনি অবলীলায় ব্যবহার করেন কবিতার শরীরে এবং একটা ভিন্ন মাত্রা দেন। যেমন –
‘বুবুর স্নেহের মত ডুবে যায় ফুলতোলা পুরনো বালিশ’ স্নেহের সাথে বুবুর ফুলতোলা বালিশের অনুষঙ্গ চমৎকার – কারণ বুবু যখন ভাইয়ের জন্য বালিশের কভারে ফুল তুলেন তখন ভাইয়ের প্রতি বোনের স্নেহের আতিশয্যের কারণেই সেই বালিশ ভিন্ন এক ব্যঞ্জনার আবেশে ভরপুর হয়।
“ কবিতা কি?
কবিতা তো শৈশবের স্মৃতি
কবিতা চরের পাখী, কুড়ানো হাসের ডিম, গন্ধভরা ঘাস
স্নান মুখ বউটির দড়িছেড়া হারানো বাছুর
কবিতা তো মক্তব্যের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার।’’
একে তো মক্তবের মেয়ে আবার সে চুলখোলা এবং একটা সাধারণ নাম যে নাম গ্রাম্য মেয়েদের সাথে মানিয়ে যায় । একটা গ্রামীন নিষ্পাপ মেয়ের ছবি চোখে আসে যেখানে একই সাথে কাব্য বোধের সাথে একাকার আয়েশা আকতার।
তাঁর বিচরণ যে- শুধু রমনীর কাছে- পাখির কাছে ফুলের কাছে নয়! তিনি যে- পৃথিবীর সর্বশেষ ধর্মগ্রন্থটি বুকের উপর রেখে ঘুমিয়ে পড়া(১) ঈমানদার কবি! তাঁর কাছে আল্লাহর অশ্বের সোয়ারীর শেষতম বাণী-
‘পৃথিবীর আগের
পৃথিবীর পরের। আর পৃথিবীতে
বসবাস করার।
(ইহুদীরা/অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না)
০৩.
আল মাহমুদের কথা উঠলেই ছোটে বীরপুরুষ বখতিয়ারের ঘোড়া।
‘আল্লাহর সেপাই তিনি দু:খীদের রাজা।
যেখানে আযান দিতে ভয় পায় মোমিনেরা,
আর মানুষ করে মানুষের পূজা,
সেখানেই আসেন তিনি।’
(বখতিয়ারের ঘোড়া)
তারপর তাবৎ শৃঙ্খল হতে মুক্তির স্বপ্ন।
‘আজ আবার হৃদয়ে কেবল যুদ্ধের দামামা…
আর
স্বপ্নের ভেতর জিহাদ জিহাদ বলে জেগে ওঠা’(২)। সেই সাথে ‘ভোরের মসজিদ থেকে বেরিয়ে আসা কর্মনিপুণ কিষানের/ মেহেদী রাঙা দাঁড়ির মতো ভেজা বাতাস(৩)।
আল মাহমুদ মানেই- বৃষ্টি থেকে বের করে আনা বাংলাদেশ শব্দের বঙ্কিম অনুস্বার, রৌদ্র থেকে শাহাদাতের রক্ত। আর তাঁর হৃদপিন্ড চাবি না খোলা আস্ত গ্রেনেড(৪)। পিঠার পেটের ভাগে ফুলে ওঠা তিলের সৌরভের মতো তুকতাকের পরিবর্তে তাঁর আকাঙ্ক্ষা আজ সেই ‘স্থির সুন্দর হাসি’-
‘যেন নাজ্জাসীর দরবারে দন্ডায়মান জাফর
কিংবা রেহেলের উপর বিশ্বসীর কোরআন মেলে ধরা।’
(অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না)
০৪.
আল মাহমুদ মানেই এ মাটির গভীরতম প্রদেশে প্রোথিত জাতিসত্ত্বার পরিচয়। আমাদের সুমহান অস্তিত্বের জয়গান-
‘এই তো আমরা। আমাদের অস্তিত্বের ভেতর থেকে লক্ষ লক্ষ মসজিদের মিনার
কলরবমুখর হয়ে উঠছে এই নিলীমা, চন্দ্র সূর্য তারকারাজি
আমাদের আযানই তো আমাদের স্বাধীনতা
আমাদের সিজদাই তো প্রকৃতপক্ষে মনুষত্বের জয়গান।
… …
এসো সিজদায় লুটিয়ে পড়ি।
তারপর শুরু হোক আমাদের অফুরন্ত গতি
আমাদের কি কোনো শেষ আছে?’
(দিগ্বিজয়ের ধ্বনি/ না কোন শূন্যতা মানিনা)
কিংবা
‘‘আমরা তো বলেছি আমাদের যাত্রা অনন্ত কালের।
উদয় ও অস্তের ক্লান্তি আমাদের কোনো দিনই বিহবল করতে পারেনি।
আমাদের দেহ ক্ষত-বিক্ষত,
আমাদের রক্তে সবুজ হয়ে উঠেছিল মূতার প্রান্তর।
পৃথিবীতে যত গোলাপ ফুল ফোটে তার লাল বর্ণ আমাদের রক্ত!’’[আমাদের মিছিল]
আল মাহমুদ মানেই আদি অন্তহীন আজন্ম মিছিলের অনিবার্যতা(৫)।
০৫.
হ্যাঁ, তা’ই তো! একদা যার সমস্ত গন্তব্যে একটি একটি তালা ঝুলছিল। মানবিক নির্মানের প্রতি আস্থা হারানো সেই যুবক- পৃথিবী যার কাছে বেদুইনের হাসির মতো ঠা ঠা লাগতো(৬)। আজ তিনি বেকারার হয়ে জিজ্ঞেস করছেন- ‘প্রভূ আমার গতি কোন দিকে?/ আমি এখন কোথায় যাবো?'(৭)
সেই মহান সত্তার অফুরন্ত মেহেরবানি… তিনি আজ অকৃত্রিম এক অনন্য গন্তব্যের সিন্দাবাদ-
‘আমাদের গন্তব্য তো এক সোনার তোরণের দিকে, যা এই ভূ-পৃষ্ঠে নেই’(৮)। নিরাশ না হওয়ার প্রান্তর পেরিয়ে(০৯) তাই তিনি পৌঁছুতে চান… কোথায় পৌঁছুতে চান তিনি?…
‘পৌঁছুতে চাই প্রভূ তোমার সান্নিধ্যে
তোমার সিংহাসনের নীচে একটি ফুরফুরে
প্রজাপতি হয়ে।
যার পাখায় আঁকা অনাদিকালের অনন্ত রহস্য।’
(প্রার্থনার ভাষা/ দ্বিতীয় ভাঙন)
শুধু তাই নয়, বিশ্বাসী এ কবি পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবারসময় তার কিছু একান্ত চাওয়ার কথা প্রকাশ করেছেন বিদগ্ধ শব্দচয়নে।
“স্মৃতির মেঘলাভোরে শেষ ডাক ডাকছে ডাহুক
অদৃশ্য আত্মার তরী কোন ঘাটে ভিড়ল কোথায়?
কেন দোলে হৃদপি-, আমার কি ভয়ের অসুখ?
নাকি সেই শিহরণ পুলকিত মাস্তুল দোলায়!
আমার যাওয়ার কালে খোলা থাক জানালা দুয়ার
যদি হয় ভোরবেলা স্বপ্নাচ্ছন্ন শুভ শুক্রবার।”
আল মাহমুদ যিনি শুধু একটি টিনের সুটকেস নিয়ে শুধু কবিতাকে অবলম্বন করে ঢাকায় এসেছিলেন তিনি আজ বয়সের ভারে ন্যুব্জ জ্ঞান বৃদ্ধ। বাংলা সাহিত্যে তাঁর অকিঞ্চিৎকর দান বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। লোকজ উপাদান, নারী, রাজনীতি সচেতনতা, আশাবাদ, ছন্দ, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, শব্দ বয়ন কৌশল তাঁর কবিতার অনন্য সম্পদ। তিনি কবিতায় গভীরভাবে খোঁজেন জীবনকে, মানুষকে, প্রেম ও প্রকৃতিকে। কবি আল মাহমুদের মতন কবি প্রতিদিন বাংলা সাহিত্যে আসেন না । শতাব্দীতে একজনই আসেন
জানতে চাইলে-
০১.মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো
০২.বখতিয়ারের ঘোড়া
০৩.অস্পষ্ট স্টেশন/আরব্য রজনীর রাজহাঁস
০৪.কাকস্য পরিবেদনা/ বিরামপুরের যাত্র
০৫,০৮.আমাদের মিছিল/ প্রেম পত্র-পল্লবে
০৬. আমার সমস্ত গন্তব্যে/ কালের কলস
০৭.এমন একটা সময়/ অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না
০৯.নিরাশ না হওয়ার প্রান্তরে পৌঁছেছি/ বারুদগন্ধী মানুষের দেশে
লেখকঃ ব্যাংকার, কবি ও প্রাবন্ধিক