মেয়েটির নাম চাঁদনি। চাঁদের মতো সুন্দর বলে তার বাবা তাকে এ নাম দিয়েছিলেন। চাঁদনি ছিল তার বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। তাই আদরে-আদরে বড় হচ্ছিল সে। তার বাবা শরিফুল ইসলাম একজন সরকারি কর্মকর্তা এবং মা নাসরিন সুলতানা একজন নার্স। শরিফুল ইসলাম ও নাসরিন সুলতানা ভালোবেসে বিয়ে করেন। কয়েক বছর পর তাদের ঘর আলোকিত করে আসে চাঁদনি।
২০১৬ সাল থেকে শরিফুলের পরিবার চাঁদপুর শহরে বসবাস শুরু করে। চাঁদনি তখন ক্লাস ফাইভ থেকে সিক্সে উঠতে চলেছে। একদিন নাসরিন তাকে বললেন, ‘মা, তুমি এখন বড় হচ্ছো, তাই ভালো-মন্দ সবকিছু বুঝতে হবে। কেউ কিছু বললে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জানাবে।’
চাঁদনি কোমল গলায় উত্তর দিল, ‘ঠিক আছে মা। তুমি চিন্তা করো না। আমি তোমাদের মেয়ে, ন্যায়-অন্যায় বুঝতে পারি।’
পাশ থেকে বাবা বলে উঠলেন, ‘দেখেছ চাঁদনির মা, মেয়ের কেমন পাকা পাকা কথা!’
সেদিন সকালে চাঁদনি বাবার সঙ্গে স্কুলের পথে রওনা দিল। এবারই প্রথম সে হাইস্কুলে পা রাখল। চারদিকে নতুন চেহারা, ছেলেমেয়েদের আনাগোনা। ক্লাসে ঢুকে সহপাঠীদের সঙ্গে আলাপ জমে উঠল।
কয়েকদিন ধরে চাঁদনি খেয়াল করছিল, তার মামা নাহিদ সাহেবের আচরণ একটু অস্বাভাবিক। নাহিদ একজন ব্যাংক কর্মকর্তা এবং প্রায়ই তাদের বাসায় আসতেন। চাঁদনি বুঝতে পারে, মামা তাকে অযথা স্পর্শ করার চেষ্টা করেন। তার মধ্যে সংকোচ তৈরি হয়, কিন্তু সে কাউকে কিছু বলে না। এরপর থেকে নাহিদ এলেই চাঁদনি নিজেকে গুটিয়ে নিত, নিজের ঘরেই সময় কাটাত।
তার পরিবর্তন দেখে মা একদিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোর কি হয়েছে? কারও সঙ্গে কথা বলিস না, ক্লাসেও মন নেই?’ চাঁদনি মায়ের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে শুরু করল। অনেক চাপের পর সে মামার বিষয়টি জানাল।
এ কথা জানার পর শরিফুল বললেন, ‘এ বিষয়টা যেন কেউ না জানে। জানাজানি হলে আমাদের মান-সম্মান যাবে। চাঁদনিকে কোথাও বিয়ে দিতে পারব না।’
এভাবেই তিন বছর কেটে গেল। চাঁদনি এখন নবম শ্রেণিতে পড়ে। তার রূপ-সৌন্দর্য দিন দিন বেড়ে চলেছে। তার জন্য কিছু প্রস্তাবও আসছিল, কিন্তু শরিফুল ও নাসরিন চাইতেন মেয়ে পড়ালেখা শেষ করে প্রতিষ্ঠিত হোক।
তবে চাঁদনি এখনও তার মামার আচরণ নিয়ে গভীরভাবে ভাবত এবং তার মধ্যে এক ধরনের হিংস্রতা জন্ম নিচ্ছিল। কিন্তু সে কাউকে কিছু বলত না। এসএসসি পরীক্ষার পর চাঁদনি তার বাবা-মাকে জানায় যে সে প্রাইভেট কলেজে পড়তে চায়। বাবা-মা এতে রাজি হন এবং তার জন্য যা যা দরকার সবকিছু করেন।
চাঁদনি নিয়মিত কলেজে যাতায়াত করত। কিন্তু কলেজের বড় ভাই শিহাবকে নিয়ে সবার মধ্যে ভয় ছিল। শিহাব বিত্তশালী পরিবারের ছেলে হওয়ায় কাউকে সম্মান দিত না এবং মেয়েদের খেলনা হিসেবে ব্যবহার করত।
একদিন বিকেলে কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার সময় চাঁদনি দেখে শিহাব তার পথ আটকে দাঁড়িয়েছে। শিহাব তাকে বাজে প্রস্তাব দেয়। চাঁদনি প্রতিবাদ করলে শিহাব তাকে গায়ে পড়ে হাতাহাতি শুরু করে। রাগের বশে চাঁদনি তাকে ধাক্কা দেয়। হঠাৎ একটি ট্রাক এসে শিহাবকে পিষে ফেলে। ঘটনাস্থলে থাকা লোকজন পুলিশে খবর দেয়। পুলিশ আসে এবং চাঁদনিকে থানায় নিয়ে যায়।
ঘড়ির কাঁটা তখন রাত সাড়ে ১০টা। শরিফুল ও নাসরিন দুশ্চিন্তায় কাতর। থানার ফোন পেয়ে তারা দ্রুত সেখানে যান। চাঁদনিকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে, কিন্তু তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোচ্ছে না। মেয়ের অবস্থা দেখে মা জ্ঞান হারান।
চাঁদনিকে রিমান্ডে নেওয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তার ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়। ১২ জুলাই তাকে আদালতে তোলা হয়। শিহাবের প্রভাবশালী বাবা এবং তার অর্থবল কাজে লাগিয়ে চাঁদনির বিপক্ষে সবাইকে দাঁড় করান।
চাঁদনিকে কাঠগড়ায় উঠানো হয়। বিচারক তাকে নিজেকে প্রকাশ করার সুযোগ দেন। চারপাশে তাকিয়ে চাঁদনি নিঃশ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করে, ‘আমরা নারী। আমাদের সবকিছুতেই ভুল। গরিব হলে দোষ, সুন্দর হলে দোষ। ১৪ বছর বয়সে যখন নিজের মামার অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করেছিলাম, তখন আমি খুনি। যদি খারাপ দৃষ্টিতে কেউ তাকায় আর প্রতিবাদ করি, তবুও আমি খুনি। যদি বাবার টাকা-পয়সা না থাকে, তবে অপরাধীর বিচার হয় না। নিজেকে রক্ষার জন্য যদি কোনো পদক্ষেপ নিই, তবে আমি খুনি। হ্যাঁ, আমি খুনি।’
চাঁদনিকে পাঁ বছরের কারাদণ্ড এবং মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। একসময়ের সুন্দর একটি পরিবার ধ্বংস হয়ে যায়।