নতুন ফেনী রিপোর্ট>>
অস্ত্র মামলায় জামিন পাওয়া ফেনী- ২ আসনের সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারীর দুই জামিনদারকে হাজির করতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে তৎকালীন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম মহিউদ্দিন চৌধুরীকেও হাজির করার নির্দেশ দিয়েছেন। বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি মো. আতাউর রহমান খানের হাইকোর্ট বেঞ্চ সোমবার এ আদেশ দেন। আগামী ৫ নভেম্বর দুই জামিনদারকে হাইকোর্টে হাজির করতে চট্টগ্রাম জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে জামিন পাওয়া মামলার নথি দাখিল করতে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার ও চট্টগ্রাম কারাগারের কয়েদিদের তালিকা দুই সপ্তাহের মধ্যে দাখিল করতে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এদিকে নিজাম হাজারীর তৎকালীন আইনজীবী এম এ বাশারকে জবাব দেওয়ার জন্য দুই সপ্তাহ সময় মঞ্জুর করেছেন।
আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। নিজাম হাজারীর পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট নূরুল ইসলাম সুজন। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মাসুদ হাসান রুমি। গত ৮ জুন ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারীর আসন কেন শূন্য ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট।
অস্ত্র মামলায় সাজা কম খাটার অভিযোগ এনে স্থানীয় যুবলীগ নেতা শাখাওয়াত হোসেন ভূঁইয়ার রিটআবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ওবিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকারের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রুল জারি করেন।
এরপর ১৬ জুলাই সংসদ সদস্য পদ নিয়ে হাইকোর্টের রুলে দেওয়া নির্দেশ অনুসারে নিজাম হাজারীরসাজা কম খাটার অভিযোগের বিষয়ে প্রায়োজনীয় নথিপত্র দাখিল করেছে চট্টগ্রাম কারা কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রাম কারা কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, ২০০৬ সালের ২৭ মে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ নিজাম হাজারীকে জামিন দিলে ১ জুন তিনি জামিনে মুক্তি পান। তার কাছে একটি চাকু পাওয়া যাওয়ার গ্রাউন্ডে জামিন পান তিনি। তবে আবেদনের পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদের দাবি, তার কাছে একটি রাইফেল পাওয়া যায়।
ওই দিন মনজিল মোরসেদ জানান, সম্প্রতি পত্রিকায় এসেছে, নিজাম উদ্দিন হাজারী একটিঅস্ত্র মামলায় সাজা কম খেটেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি হলফনামায় তথ্য গোপন করেছেন।
এছাড়াও সংবিধানের ৬৬ (২) অনুচ্ছেদে রয়েছে, ‘কোন ব্যক্তি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হইবার এবং সংসদসদস্য থাকিবার যোগ্য হইবেন না, তিনি যদি নৈতিক স্খলনজনিত কোন ফৌজদারী অপরাধে দোষী সাব্যস্তহইয়া অন্যূন দুই বৎসরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তাঁহার মুক্তিলাভের পর পাঁচ বৎসরকাল অতিবাহিত না হইয়া থাকে’।
আর নিজাম হাজারীর ২০০০ সালের ১৬ আগস্ট অস্ত্র আইনের ১৯ (ক) ধারায় ১০ বছর এবং ১৯ (চ) ধারায় সাত বছরের কারাদণ্ড হয়। চট্টগ্রাম নগরের ডবলমুরিং থানায় হওয়া মামলায় চট্টগ্রামের চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত ও বিশেষ ট্রাইব্যুনাল তাকে এ সাজা দিয়েছিলেন। উভয় দণ্ড একসঙ্গে চলবে বলে রায়ে বলা হয়। অর্থা ৎ ১০ বছর সাজা ভোগ করবেন নিজাম হাজারী।
সে হিসেবে তিনি ২০১৫ সালের আগে সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্য নন। অথচ তিনি সাজাও কম খাটেন আবার সংবিধানও মানেননি। তাই তার এমপি পদ অবৈধ।
ওই পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘দুই বছর ১০ মাস কম সাজা খেটেই কারাগার থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন ফেনী-২ আসনের আওয়ামী লীগের সাংসদ নিজাম উদ্দিন হাজারী। অস্ত্র আইনের একটি মামলায় তার ১০ বছর সাজা হয়েছিল’।
‘২০০০ সালের ১৬ আগস্ট অস্ত্র আইনের ১৯(ক) ধারায় ১০ বছর এবং ১৯(চ) ধারায় সাত বছরের কারাদণ্ড হয় নিজাম হাজারীর। চট্টগ্রাম নগরের ডবলমুরিং থানায় হওয়া মামলায়চট্টগ্রামের চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত ও বিশেষ ট্রাইব্যুনাল তাকে এই সাজা দিয়েছিলেন। উভয় দণ্ড একসঙ্গে চলবে বলে রায়ে বলা হয়। অর্থা ৎ ১০ বছর সাজা ভোগ করবেন নিজাম হাজারী’
এ আদেশের বিরুদ্ধে নিজাম হাজারী হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন। উচ্চআদালত তার সাজা বহাল রাখেন। সর্বশেষ তিনি রিভিউ আবেদন করলে আদালত তা খারিজ করে দেন।
চট্টগ্রাম কারাগার সূত্র জানায়, নিজাম হাজারী ১৯৯২ সালের ২২ মার্চ কারাগারে যান। কারাগারে যাওয়ার দুই দিন পর (২৪ মার্চ ১৯৯২) তাকে আটকাদেশ (ডিটেনশন) দেওয়া হয়। ওই বছরের ২৮ জুলাই তিনি জামিন পান। কিন্তু তার আটকাদেশ বাতিল হয় ওই বছরের ১৫ আগস্ট এবং ওই দিনই তিনি কারাগার থেকে ছাড়া পান। এ হিসাবে, নিজাম হাজারী কারাগারে ছিলেন ১৯৯২ সালের ২২ মার্চ থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত মোট চার মাস ২৪ দিন।
কোনো মামলায় সাজার আদেশ হওয়ার আগে কারাগারে থাকা সময়কে হাজতবাস এবং সাজা ঘোষণার পরের সময়কে কয়েদ খাটা বলা হয়।
নথিপত্রে দেখা গেছে, পলাতক থাকা অবস্থায়ই ২০০০ সালের ১৬ আগস্ট ওই মামলায় নিজাম হাজারীকে সাজা দেন ট্রাইব্যুনাল। ২০০০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর তিনি আদালতে আত্মসমর্পণ করেন এবং তাকে ওইদিনই কারাগারে পাঠানো হয়। তার কয়েদি নম্বর ছিল ৪১১৪/এ। ২০০৫ সালের ১ ডিসেম্বর তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান। অর্থা ৎ কয়েদি হিসেবে তিনি কারাভোগ করেন পাঁচ বছর দুই মাস ১৭ দিন।
এ হিসাবে হাজতবাস ও কয়েদ খাটা—দু’য়ে মিলে নিজাম হাজারী সাজা ভোগ করেছেন পাঁচ বছর সাত মাস ২১ দিন। তাকে সাজা রেয়াত (মাফ) দেওয়া হয়েছে এক বছর ছয় মাস ১৭ দিন। কারাগারে সর্বনিম্ন নয় মাসে বছর ধরা হয়। তবে কতো মাসে বছর হবে, তা নির্ধারিত হয় কয়েদির আচরণের ওপর ভিত্তি করে।
কারাগারে ঢোকা ও মুক্তি পাওয়ার সময় ধরে নিজাম হাজারী চার মাস ২৪ দিন কারাবাস করেছেন। কিন্তু তার কয়েদি রেজিস্ট্রারের তথ্য হলো, তিনি তিন বছর দুই মাস ২৫ দিন হাজত খেটেছেন।
সূত্র জানায়, নিজাম হাজারীর হাজতি রেজিস্ট্রারের তথ্য কয়েদি রেজিস্ট্রারে স্থানান্তরের সময় তার হাজতবাসের সময় বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। তবে চট্টগ্রাম কারাগারের হিসাব বলছে, নিজাম হাজারী দুই বছর ১০ মাস এক দিন কম কারাভোগ করে বেরিয়ে গেছেন।
আদালত সূত্র জানায়, মামলাটি বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন অবস্থায় আসামি নিজাম হাজারী নানাভাবে কালক্ষেপণের চেষ্টা চালিয়েছিলেন। বিষয়টি আদালতের নজরে আসে। হাইকোর্টের আপিল আদেশেও বিচারপতি এ কে বদরুল হক ও বিচারপতি এ এফ এম মেছবাউদ্দিন বিষয়টি তুলে ধরেন। ২০০১ সালের ১৮ এপ্রিল এ দুই বিচারপতির বেঞ্চে নিজাম হাজারীর আপিল শুনানি শুরু হয় (ফৌজদারি আপিল ২৩৬৯/২০০০)। একই বছরের ২ মে তারা ট্রাইব্যুনালের দেওয়া সাজা বহাল রেখে রায় দেন।
হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে নিজাম হাজারী সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন (নম্বর ১০৭/২০০১)। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমীন চৌধুরীর নেতৃত্বে বিচারপতি মো. রুহুল আমিন ও বিচারপতি এফ এম হাসান আপিল নাকচ করে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন। পরে নিজাম হাজারী সুপ্রিম কোর্টে রায় বিবেচনার জন্য রিভিউ আবেদন করেন (নম্বর ১৮/২০০২)।
তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ জে আর মোদাচ্ছের হোসেনের নেতৃত্বে বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম ও বিচারপতি আমীরুল কবির চৌধুরী আবেদন খারিজ করে দেন। ফলে নিজাম হাজারীর ১০ বছরের দণ্ড বহাল থেকে যায়।
সম্পাদনা: আরএইচ