ফেনীবাসী এক শ্রেষ্ঠ সন্তানকে হারালো • নতুন ফেনীনতুন ফেনী ফেনীবাসী এক শ্রেষ্ঠ সন্তানকে হারালো • নতুন ফেনী
 ফেনী |
২০ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৭ বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ফেনীবাসী এক শ্রেষ্ঠ সন্তানকে হারালো

শাহজালাল ভূঞাশাহজালাল ভূঞা
  প্রকাশিত হয়েছেঃ  ০৮:৫১ অপরাহ্ণ, ০৬ জুলাই ২০২০

আমার অত্যন্ত প্রিয় ও শ্রদ্ধাভাজন ফেনীর প্রবীণ সাংবাদিক নুরুল করিম মজুমদার এ পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেলেন। বৈশ্বিক চলমান মহামারির এ সময়ে তাঁর বিদায় মেনে নেওয়া খুবই বেদনার, খুবই কষ্টের।

বিগত কিছুদিন ধরে তিনি অসুস্থ ছিলেন। করোনোভাইরাসের কারণে শত ব্যস্ততা থেকে এক রকম গুছিয়ে নিয়েছিলেন নিজেকে। কিন্তু গত সপ্তাহে অসুস্থতা বোধ করলে সাপ্তাহিক হকার্স এর নির্বাহী সম্পাদক ও সময় টিভি রিপোর্টার আতিয়ার সজলসহ বাড়ি থেকে অনেকটা নিজে পায়ে হেঁটে গিয়েই ডাক্তারের পরামর্শে ফেনী মেডিনোভা হাসপাতালে ভর্তি হলেন তিনি। খবর পেয়ে দ্রুত ছুটে গেলাম হাসপাতালে। তাঁর সাথে কথা বলে মনে হলো ভালোই আছেন। শীঘ্রই সুস্থ্য হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন। প্রিয় করিম ভাইকে দেখতে পরের দিন আবার হাসপাতালে গেলাম হকার্সে আমার এক সময়ের সহকর্মী বর্তমানে ইউএনবি’র জেলা প্রতিনিধি ও দেশ রূপান্তরের সোনাগাজী প্রতিনিধি শফি উল্যাহসহ। গিয়ে দেখলাম করিম ভাই হাসপাতালে বেডে ঘুমিয়ে রয়েছেন। তাই উনার ঘুম না ভেঙ্গে তাঁর একমাত্র ছেলে তারেক মজুমদারকে হাসপাতালের কোরিডোরে ডেকে এনে করিম ভাইয়ের শারীরিক অবস্থার খোঁজ-খবর নিলাম। এক পর্যায়ে তারেককে খুবই ক্লান্ত মনে হল। তাই হাসপাতালে আমি অথবা শফি সময় দেখার আগ্রহ প্রকাশ করলাম। তারেক আমাকে বলল, কাকা আপনিতো গ্রামে থাকেন এবং পরিবারে ছোট বাচ্চারা আছে, আপনি বাড়ি চলে যান। শফি কাকা যেহেতু শহরে এবং হাসপাতালের পাশেই আছে সেহেতু তিনি আমাকে কিছুটা সময় দিলেই চলবে। সময়মত আমি বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসবো এবং আব্বুর জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে আসতে পারবো। তারেকের কথা অনুযায়ী শফির সাথে কথা বললে সেও হাসপাতালে সময় দিতে রাজি হলো এবং যথারীতি হাসপাতালে সময়ও দিলো শফি। আমার আর হাসপাতালে যাওয়া হয়নি। এরই মধ্যে আমি প্রায় ফোনে তারেক ও শফি’র সাথে যোগাযোগ করে করিম ভাইয়ের শারীরিক অবস্থায় খোঁজ-খবর নিতাম।

৩ জুলাই শুক্রবার শফি আমাকে ফোনে জানালো শাহজালাল ভাই কই আছেন? করিম ভাইয়ের শারীরিক অবস্থা বেশি ভালো নয়, ওনাকে ঢাকায় নিতে যেতে হবে। দ্রুত মুননা ভাই ও সজলের সাথে পরামর্শ করেন। তারেক মুননা ভাই ও সজলের সাথে কথা বললো এবং সজল দ্রুত মেডিনোভা হাসপাতালে গিয়ে করিম ভাইকে ঢাকা নেয়ার যাবতীয় ব্যবস্থা করলো। যথারীতি ওই দিনই ঢাকা নেয়া হলো এবং একটি বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউতে দুই দিন ভর্তি রাখা হলো। ৫ জুলাই ডাক্তাররা করিম ভাইয়ের স্বজনদের সাথে পরামর্শ করে আইসিইউ’র সিট কেটে ফেনী পাঠিয়ে দিলেন এবং ফেনীতে এনে জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করার পর একইদিন রাত ৮টা ৪০ মিনিটে আমাদের সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন প্রিয় করিম ভাই।

সাপ্তাহিক হকার্স পত্রিকায় কাজ করার সুবাধে সর্বজন শ্রদ্ধেয় নুরুল করিম মজুমদারের সাথে আমার প্রায় ১৮ বছর ধরে সম্পর্ক। এক সময়ে হকার্স এ আমি স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কাজ করি। পরবর্তীতে বার্তা সম্পাদক ও নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে কাজ করার সুযোগ হয়েছে আমার। আমার দেখা শ্রদ্ধেয় করিম ভাই অসামান্য ভালো মনের অধিকারী, সাংবাদিক গড়ার কারিগর, নম্র, ভদ্র, সৎ ও নিষ্ঠ এবং নীতিবান মানুষ ছিলেন। অন্যায়ের কাছে আপোষহীনতায় অনমনীয় ছিলেন আজীবন। এজন্য ফেনীর সাংবাদিকদের নিকট তিনি স্মরণীয় ও নতুন প্রজন্মের কাছে উদাহরণ হয়ে থাকবেন যুগের পর যুগ।

নুরুল করিম মজুমদার ছিলেন ফেনীর সাংবাদিকদের বাতিঘর। তিনি ফেনী প্রেস ক্লাবসহ সাংবাদিকদের যে কোন সংকটে সিনিয়র-জুনিয়র সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাঁর পরামর্শেই সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করতো। তিনি দীর্ঘ সময় ফেনী প্রেসক্লাব ও সাংবাদিক সমিতির নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন। ফেনী প্রেসক্লাবের সভাপতি পদে বার বার সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর সময়কালেই ফেনী প্রেসক্লাবে সাংবাদিক কল্যাণ তহবিল গঠিত হয়েছিল। ব্যক্তি জীবনে তিনি কখনো অন্যায়ের সাথে আপোষ করেননি। পেশাগত ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন একজন সৎ ও নীতিবান মানুষ।

আজীবন মওলানা ভাসানীর আদর্শের অনুসারী হিসেবে গরীব, দুঃখী ও মেহনতি মানুষের পাশে দাঁড়াতেন। বিগত সময়ে ভাসানী স্মৃতি সংসদ ফেনীর সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করে শ্রমিকদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।

নুরুল করিম মজুমদার দীর্ঘ কর্মজীবনে ধারাবাহিকভাবে ৩৯ বছর ফেনীর প্রাচীনতম পত্রিকা সাপ্তাহিক হকার্সের সম্পাদক ও প্রকাশক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, ফেনী জেলা আন্দোলনসহ গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। এছাড়াও ফেনী ডায়াবেটিক হাসপাতালের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তা ও আজীবন সদস্য, ফেনী সেন্ট্রাল হাই স্কুল গভর্নিং কমিটির একাধিক বারের সভাপতি, ইষ্টার্ণ নিউজ এজেন্সির (এনা) সাবেক বৃহত্তর নোয়াখালী জেলা প্রতিনিধি, বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাবেক ফেনী জেলা প্রতিনিধি, ইউনাইটেড নিউজ অব বাংলাদেশের (ইউএনবি) সাবেক ফেনী জেলা প্রতিনিধি, জাতীয় দৈনিক দি ডেইলি স্টারের সাবেক ফেনী জেলা প্রতিনিধি ও দৈনিক দেশ বাংলা ফেনী ব্যুরো অফিসের প্রধান ছিলেন। সামাজিক কর্মকাণ্ডেও ছিলো তাঁর সক্রিয় অবস্থান। তিনি পশ্চিম উকিল পাড়া পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতিসহ ফেনী পৌরসভার একাধিক উন্নয়ন কমিটিতে যুক্ত ছিলেন।

ফেনীকে আলোকিত ও সমৃদ্ধ জেলা হিসেবে গড়তে তাঁর সম্পাদিত পত্রিকায় সাহসী ভূমিকা ও অসমান্য অবদান রেখেছেন। তাঁর মৃত্যুতে ফেনীবাসী এক শ্রেষ্ঠ সন্তানকে হারালো এবং সাংবাদিক সমাজ হারালো একটি নক্ষত্রকে। এতে কোন সন্দেহ নেই।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক অজেয় বাংলা ও সাপ্তাহিক নবকিরণ

আপনার মতামত দিন

Android App
Android App
Android App
© Natun Feni. All rights reserved. Design by: GS Tech Ltd.