সোনাগাজীতে আগুন দিয়ে মাদ্রাসা ছাত্রীকে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করেছে তার সহপাঠিরাই। অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্তার অভিযোগকারী নুসরাত জাহান রাফিকে (১৮) দাহ্য পদার্থ দিয়ে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করেছে তারা। আহত ছাত্রী নিজেই এ অভিযোগ করে।
শনিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে আলিম পরীক্ষা দিতে গেলে ছাদে তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
এ ঘটনায় পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য একই মাদ্রাসার ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক আবছার উদ্দিন ও আহতের সহপাঠী আরিফুল ইসলামকে আটক করেছে পুলিশ।
আহত ওই ছাত্রীর একটি অডিও রেকর্ড নতুন ফেনীসহ গণমাধ্যমে কাছে আসে।
সে রেকর্ডে ওই ছাত্রী জানান, ‘সকালে আলিমে আরবি প্রথমপত্র পরীক্ষায় অংশ নিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে যায় সে। মাদ্রাসায় পৌঁছালে এক ছাত্রী তার বান্ধবী নিশাতকে ছাদের ওপর কেউ মারছে বলে ডেকে নেয়। সেখানে আরো চার-পাঁচজন মুখোশপরা ছাত্রী প্রিন্সিপালের ওপর যে অভিযোগ করেছিস তা মিথ্যা বল। আমি বলি না, আমি যা বলেছি সব সত্যি। তারা বলে, তোকে এখনই মেরে ফেলব। আমরা তোর সব খবর নিছি। তোর প্রেম সম্পর্কিত সব তথ্য আমাদের কাছে আছে। আমি বলি- আমি সব সত্য বলেছি। আমি শিক্ষকদের সম্মান করি, কিন্তু যে শিক্ষক আমার গায়ে হাত দিছে আমি তার প্রতিবাদ করেছি। সঙ্গে সঙ্গে আমার হাত-পা ধরে গায়ে আগুন দেয়’।
পরে তার চিৎকারে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে প্রথমে সোনাগাজী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পরবর্তীতে ফেনী সদর হাসপাতালে প্রেরণ করেন। কর্তব্যরত চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে প্রেরণ করেন।
আহত নুসরাত জাহান রাফি সোনাগাজী পৌরসভার চরচান্দিয়া গ্রামের একেএম মুসার মেয়ে। সে এবার সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসা থেকে আলিম পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন।
খবর পেয়ে ফেনী জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুজজমান ও পুলিশ সুপার এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার, সোনাগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সোহেল পারভেজ ও সোনাগাজী সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার (সার্কেল) সাইফুল আহমেদ ভূঞাসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নুসরাতের চিকিৎসার খবর নেন।
ছাত্রীর বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান জানান, অধ্যক্ষ মাওলানা এএসএম সিরাজ উদ্দৌলা তাকে (নুসরাত জাহান রাফি) যৌন হেনস্তা করে। পরে থানায় আমরা মামলা দিলে অধ্যক্ষ আটক হলেও তার লোকজন তা তুলে নিতে চাপ দেয়। এর আগেও অধ্যক্ষ একাধিকবার তাকে যৌন হেনস্তার চেষ্টা করে বলেও তিনি অভিযোগ করেন।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নুরুল আমিন বলেন, ঘটনার সময় তিনি মাদ্রাসায় অফিস কক্ষে হলে প্রশ্নপত্র পাঠানোর কাজ করছিলেন। চিৎকার শুনে বেরিয়ে এসে দগ্ধ অবস্থায় এক পরীক্ষার্থী ছাত্রীকে দেখতে পেয়ে বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানান।
এ ব্যাপারে মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটির সদস্য, শিক্ষক ও কর্মচারী কেউ কথা বলতে রাজি হননি। তবে শিক্ষার্থী হত্যা চেষ্টায় দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেছেন স্থানীয়রা।
তাদের দাবি, অপরাধী যেই হোক না কেন তাকে দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে।
সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. নুরুল আলম জানান, ওই ছাত্রীর অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়া উন্নত চিকিৎসার জন্য জেলা সদর হাসপাতালের প্রেরণ করা হয়।
ফেনী সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. আবু তাহের জানান, ছাত্রীর শরীরের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ পুড়ে গেছে। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছে।
সোনাগাজী মডেল থানার পরিদর্শক (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, পুলিশ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছে। ঘটনায় কারা জড়িত তা চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। এর আগে যৌন হেনস্তার ঘটনায় ওই ছাত্রীর মা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা দায়ের করেছে বলে তিনি জানান।
এর আগে ২৭ মার্চ ওই ছাত্রীকে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার নিজ কক্ষে ডেকে নিয়ে যৌন হয়রানির অভিযোগে অধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজ উদ্দৌলাকে আটক করে পুলিশ। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত কয়েক দিন যাবৎ সোনাগাজী মাদ্রাসাসহ আশপাশের এলাকায় দুই পক্ষে চরম উত্তেজনা চলে আসছে।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সহসভাপতি ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ সভাপতি রুহুল আমিন ও পৌর কাউন্সিলর মাকসুদুর রহমান মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজ উদ্দৌলার পক্ষে অবস্থান নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে মানববন্ধন করেন। অপর দিকে স্থানীয় কাউন্সিলর শেখ আবদুল হালিম মামুন ও মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকেরা মিলে সিরাজ উদ্দোলার শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন করেন।
এর আগেও উক্ত অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎসহ একাধিক অভিযোগে ওঠে তার বিরুদ্ধে।
সম্পাদনাঃ আরএইচ/ এনজেটি







