এম মাঈন উদ্দিন, মিরসরাই থেকে>>
দেশের সবচেয়ে বড় মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলের উদ্বোধন করা হয়েছে। রবিবার সকাল সাড়ে দশটায় ঢাকা বঙ্গবন্ধু আর্ন্তজাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে থেকে মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল সহ সারা দেশের দশটি অর্থনৈতিক অঞ্চল ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল উদ্বোধন উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপি। সকালে উপজেলার ১৬টি ইউনিয়ন ও ২টি পৌরসভার প্রায় অর্ধ লাখ মানুষ সভাস্থলে যোগ দেন।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) সূত্রে জানা গেছে, মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে প্রাথমিক পর্যাযে ১৫ হাজার একর খাস জমিতে ৫০টি উপ-অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ৬ হাজার ৩৯০ একর বেজার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি নয় হাজার একর জমি আগামী ২ বছরের মধ্যে জেলা প্রশাসকের মাধ্যেমে তাদের কাছে হস্তান্তর করা হবে। হস্তান্তর করা ৬ হাজার ৩৯০ একর জমির মধ্যে পীরের চরের ১৩৯০ দশমিক ৩১৬ একর, সাধুর চরের ১৬৪৪ দশমিক ১০৩ একর, শিল্প চরের ১৮৫২ দশমিক ৫৩৮ একর এবং চর মোশারফের ১৫০৪ দশমিক ২৯৩ একর জমি সর্বমোট ছয় হাজার ৩৯০ একর জমি প্রথম ধাপের কর্মপরিকল্পনায় রাখা হয়েছে। ইছাখালীর চরে মোট এক হাজার ২’শ ২২টি কারখানা স্থাপন করা হবে। এছাড়াও পুরো শিল্পজনে আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দর, মেডিক্যাল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, পূর্ণাঙ্গ আবাসিক এলাকা, সমুদ্রবন্দর, কম্পোজিট প্ল্যান্ট, আইটি পার্ক, ট্যুরিজম পার্ক, বিকল্প পোর্ট কানেকটিং সড়ক, রেল লাইন নির্মাণ, ১০০ মেগাওয়াট সোলার পাওয়ার প্ল্যান্ট, ৬৬০ মেগাওয়াটের দুটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনে চীনের জিজিয়ান জিনডোন হোল্ডিং গ্রুপের সঙ্গে বেজার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এখানে কয়েকটি ধাপে প্রতিষ্ঠা পাবে ৫০টি বিশেষায়িত উপ-অর্থনৈতিক অঞ্চল।
জানা গেছে, ২০১০ সালে মহামায়া সেচ প্রকল্প উদ্বোধন করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মিরসরাইয়ে আসলে মিরসরাইয়ের সাংসদ এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশারফ হোসেন ইছাখালী চরে অর্থনৈতিক জোন গড়ে তোলার পরিকল্পনার কথা জানান। পরবর্তীতে ঢাকা যাওয়ার পথে হেলিকাপ্টারে করে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রধানমন্ত্রীকে ঘুরে দেখানো হয়। ইছাখালীর চর দেখে প্রধানমন্ত্রী গণপূর্তমন্ত্রীকে একটি পরিকল্পনা দেওয়ার জন্য বলেন। আর গনপূর্তমন্ত্রী বিশেষজ্ঞ টিম দিয়ে ইছাখালী চরের একটি পরিকল্পনা প্রধানমন্ত্রীকে দিলে তিনি ২০১২ সালে ইছাখালীতে দেশের সর্ববৃহৎ শিল্পনগরী গড়ে তোলার ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেন। ইতোমধ্যে সেখানে প্রাথমিক পর্যায়ের বিভিন্ন ধরনের কাজ চলছে। সরকারের ভরাটকৃত জমিতে প্লট নির্মাণ, সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণ, বিদ্যুৎ গ্যাস ও বর্জ্য নিরসনের ব্যবস্থা করবে ডেভেলপার। ৫০ বছরের জন্য সরকারের কাছ থেকে জমি লিজ নেবে ডেভেলপার। জমি লিজ নেওয়ার পর ওই অর্থনৈতিক অঞ্চলের উন্নয়নের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি শিল্পোদ্যোক্তা আনবে নির্বাচিত ডেভেলপার। প্রাথমিকভাবে ৫৫০ একর জমির ওপর অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়েছে। এ ছাড়া অর্থনৈতিক জোনের অধিভুক্ত জায়গায় মাটি ভরাটের কাজ শুরু হয়েছে। ২২ কোটি ৫ লাখ ৪৯ হাজার টাকা ব্যয়ে ওই মাটি ফেলা হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক, ডিএফআইডি ও সরকারী অর্থায়নে এসব কাজ করছে মেসার্স আতাউর রহমান খান নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে মঘাদিয়া থেকে ইছাখালী সিডিএসপি বাঁধ পর্যন্ত সাড়ে ৪ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১২ কোটি টাকা। সড়ক নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে।
উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি শেখ আতাউর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরীর যৌথ উপস্থাপনায় এবং চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক (অতিরিক্ত) আবদুল জলিলের সভাপতিত্বে অন্যান্যের মাঝে উপস্থিত ছিলেন, গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রীর একান্ত সচিব ফয়েজ আহমদ, চট্টগ্রাম পুলিশ কমিশনার (অতিরিক্ত) হাফিজ আক্তার, বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন (বেজা) সচিব আইয়ুবুর রহমান, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবদুস সালাম, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জিয়া আহমেদ সুমন, উপজেলা চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) ইয়াছমিন আক্তার কাকলী, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি জিতেন্দ্র প্রসাদ নাথ মন্টু, যুগ্ম সম্পাদক জসিম উদ্দিন, মহিউদ্দিন রাশেদ, সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ফেরদৌস হোসেন আরিফ, মিরসরাই পৌরসভার সাবেক মেয়র এম শাহজাহান, বর্তমান মেয়র গিয়াস উদ্দিন, বারইয়ারহাট পৌরসভার মেয়র নিজাম উদ্দিন (ভিপি নিজাম), উপজেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সম্পাদক নুরুল মোস্তফা, অর্থ সম্পাদক মো. এমরান উদ্দিন, ত্রাণ ও সমাজ কল্যাণ সম্পাদক সাইফুল্লাহ দিদার, ছাত্রলীগ নেতা মাইনুর ইসলাম রানা, মেজবাউদ্দিন বাবু, এমরান হোসেন সোহেল সহ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি, সম্পাদক, শিক্ষক, সরকারী কর্মকর্তাগণ।
এসময় শিল্প উদ্যোক্তাদের পরিবেশবান্ধব বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, শিল্প কারখানা গড়ার ক্ষেত্রে পরিবেশকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। শিল্পায়নের নামে যেন পরিবেশ নষ্ট না হয় সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো গড়ে তুলতে সবার সহযোগিতা কামনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এসব অঞ্চল গড়ে তুলতে যারা বেসরকরিভাবে এগিয়ে এসেছেন তাদের ধন্যবাদ। যারা জায়গা-জমি দিয়েছেন তাদেরও ধন্যবাদ। যত ধরনের সুযোগ আছে আমরা সব ধরনের সুযোগ কাজে লাগাতে চাই দেশের উন্নয়নের জন্য। অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে এলাকাভিত্তিক খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থা রাখার পরামর্শ দেন শেখ হাসিনা। অঞ্চলগুলোতে বিনিয়োগে নারী উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নারী উদ্যোক্তারা এগিয়ে এলে আমরা অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে তাদের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা রাখার ব্যবস্থা করবো। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আধুনিক শিল্পের বিকাশ ঘটানোর জন্য দেশের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়াতে হবে। যত বেশি ক্রয় ক্ষমতা বাড়তে তত বেশি শিল্পের বিকাশ ঘটবে। বর্তমান সরকারকে ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইতোমধ্যে আমরা বিনিয়োগবান্ধব নানা পদক্ষেপ নিয়েছি। নীতিমালা করেছি। আমরা ব্যবসা করতে নয়, ব্যবসায়ের পরিবেশ তৈরি করতে চাই।
প্রধানমন্ত্রীর সাথে ভিডিও কনফারেন্সে মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্বপ্নদ্রষ্টা গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপি বলেন, ‘মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল উদ্বোধনে আমি আবেগে আপ্লুত। আপনি যে উদ্যোগ নিয়েছেন তার জন্য আমার এবং মিরসরাইবাসীর পক্ষ থেকে আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। এজন্য যে আপনি অবহেলিত একটি চরাঞ্চলকে শিল্প এলাকা হিসেবে উন্নত করছেন। এসময় তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করেন।’
প্রধানমন্ত্রী একই সময় মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় ২১৬ একর জমির ওপর আব্দুল মোনেম অর্থনৈতিক অঞ্চল, নরসিংদীর পলাশে ২০০ একর জমির ওপর এ কে খান অর্থনৈতিক অঞ্চল, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের বদ্দার বাজার এলাকায় ১৫০ একর জমির ওপর আমান অর্থনৈতিক অঞ্চল, গাজীপুর সদর উপজেলার কোনাবাড়িতে ৪০ একর জমিতে বে অর্থনৈতিক অঞ্চল, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও এর মেঘনাঘাট এ ২৪৫ একর জমিতে মেঘনা অর্থনৈতিক অঞ্চল, একই উপজেলার ছোট শিলমান্ডিতে ৮০ একর জমিতে মেঘনা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অর্থনৈতিক অঞ্চল, বাগেরহাটের মংলায় ২০৫ একর জমিতে মংলা অর্থনৈতিক অঞ্চল (এটি ডেভেলপ ও অপারেট করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে পাওয়ারপ্যাক অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রাইভেট লিমিটেডকে), কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলায় ৮৮২.২৬ একর জমিতে সাবরাং টুরিজম পার্ক এবং মৌলভীবাজার জেলার সদর উপজেলায় ৩৫২ একর জমিতে শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চল উদ্বোধন করেন।
সম্পাদনা: আরএইচ/এমইউ