আজ ১১ জুলাই। শোকাবহ মিরসরাই ট্র্যাজেডির ৭ম বর্ষপূর্তি দিবস। ১১ জুলাই মিরসরাইবাসী ভুলবেনা কখনো। মিরসরাই ট্র্যাজেডিতে নিহত সন্তানের ছবি বুকে নিয়ে এখনো কাঁদেন স্বজনরা। সন্তানের জন্মদিন অনেক হয়তো ব্যস্ততার কারণে ভুলে যান কিন্তু মৃত্যুদিন কেউ ভুলে না। সেই মৃত্যু যদি ইতিহাসের পাতায় লেখা হয় সেটাতো আরো বেদনাদায়ক। আজ থেকে সাত বছর আগে এক মর্মান্তিক সড়ক দূর্ঘটনায় প্রাণ কেড়ে নেয় এক অভিভাবক সহ ৪৫ জন শিক্ষার্থীর। ২০১১ সালের ১১ জুলাই মিরসরাই স্টেডিয়াম থেকে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্টের খেলা দেখে আবুতোরাবে ফেরার পথে সৈদালীতে একটি ডোবায় পড়ে মারা যায় ৪৫ জন স্কুল শিক্ষার্থী।
মিরসরাই ট্র্যাজিডিতে নিহতদের স্মরণে আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রবেশ মুখে স্থাপন করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ ‘আবেগ’ আর দুর্ঘটনাস্থলে নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ ‘অন্তিম’। মিরসরাই ট্র্যাজিডি এক বিভীষিকার গল্পের নাম। এটি ৪৫টি জীবনের কঠিন নিয়তির গল্প। ৪৫টি পরিবারের সারাজীবনের অশ্রুপাতের গল্প। মুহূর্তেই হইচই পড়ে যায় ঘটনাস্থলে। আশপাশের সবাই ছুটে এলো ঠিকই, বাঁচানো গেল না পিকআপের তলানিতে আটকে পড়া কোনো খুদে ছাত্রকে। একে একে নিষ্প্রাণ হলো ৪৫টি তাজা জীবন। বিশ্বের আলোচিত মিরসরাই ট্র্যাজেডির ৭ম বর্ষপূর্তি আজ ১১ জুলাই। গভীর রাতে ঘুম থেকে জেগে আদরের সন্তানকে খুঁজে এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করতে থাকেন অভাগীনি মা। ১১ জুলাই আসলে শোকে বিহ্ববল হয়ে পড়েন স্বজনরা। স্মৃতি বলতে শুধুমাত্র ছবির ফ্রেমই রয়েছে। পুত্রহারা পিতা-মাতারা সেই ছবি নিয়ে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে আহজারী করতে থাকেন। আবার কখনো কখনো নীরব নিস্তব্ধ হয়ে একেবারেই নির্বাক। দূর্ঘটনার পর আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়া, ডেনমার্কসহ বিভিন্ন দেশ থেকে মানবাধীকার কর্মী, নাট্যকর্মী এসে সমবেদনাসহ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। ওই সময় নিহতদের স্বজনদের সমবেদনা জানাতে ছুটে আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদ, বিকল্পধারা বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি একিউএম বদরুদৌজা চৌধুরী সহ দেশের বিশিষ্ট জনেরা। থেমে ছিল না দেশের সমাজ সেবকদের সাহায্যের হাত। মিরসরাই ট্র্যাজিডি নিয়ে ওই সময় ধারিবাহিক সংবাদ পরিবেশন করেছিলো দেশের গণমাধ্যমের পাশাপাশি আর্ন্তজাতিক মিডিয়াগুলোও।
নিহত স্কুল শিক্ষার্থী তাকিউল্লাহ মাহমুদ সাকিবের মা পারভীন আক্তার বলেন, সাকিবের পড়ার টেবিল এখনো সেই আগের মতোই আছে। তার স্মৃতিচিহ্ন আগলে রাখবো আজীবন। তিনি বলেন, সাত বছরে একদিনের জন্যও ভুলতে পারিনি প্রিয় সন্তানকে। সাকিবের বোন তাসনিম জাহান তার প্রিয় ভাইটি ছবি এঁকেছে আবুতোরাব স্কুলে নিহত ভাইয়ের স্মৃতি ফলকে দেওয়ার জন্য।
নিহতদের স্মরণে স্থাপন করা হয় স্মৃতিস্তম্ভ ‘আবেগ’ ও ‘অন্তিম’ :
নিহত ছাত্রদের স্মরণে আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রবেশ মুখে স্থাপন করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ ‘আবেগ’ আর দুর্ঘটনাস্থলে নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ ‘অন্তিম’। নিহতদের মধ্যে আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র বেশী হওয়ায় তাদের স্মৃতি রক্ষায় বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ২০১২ সালে নির্মান করা হয় স্মৃতিস্তম্ভ ‘আবেগ’। স্মৃতিস্তম্ভ ‘আবেগ’ এ নিহতদের ছবি সংবলিত বিশেষ টাইলস স্থাপন করা হয়েছে। আর দুর্ঘটনাস্থলে স্মৃতিস্তম্ভ ‘অন্তিম’ নির্মাণ করা হয়েছে। স্মৃতিস্তম্ভ দুইটির নকশা করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ সাইফুল কবীর।
এখনো থমকে দাঁড়ায় পথিক
‘ডোবা’ নামের যে মৃত্যুকূপে নিমেষই ৪৫ টি সপ্নের অপমৃত্যু হয়েছে সেটির সামনে আসলে আজো থমকে দাঁড়ায় পথিক। দীর্ঘশ্বাসের ভেলায় চড়ে সেই ভয়াল ক্ষণটিতে ফিরে যায় চলতি পথের যে কোন পথিক। স্মরণ করে মর্মস্পর্শি সেই সড়ক দুর্ঘটনার মূহুর্তটিকে। মনে করার চেষ্টা করে তার চেনা মুখগুলোকে। আর সেই পথিক যদি হন নিহতের কোন আত্মীয় তাহলে তাদের দীর্ঘশ্বাসের মাত্রাটুকু বেড়ে যায় বহুগুনে। প্রিয়জনকে হারানোর স্থানটুকুর দিকে নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে একটি একটি দীর্ঘশ্বাসই তাদের সম্বল হয়ে উঠে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহসড়কের বড়তাকিয়া বাজার থেকে আবুতোরাব যাওয়ার পথে চোখে পড়বে ডোবাটি। যেখানে নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ ‘অন্তিম’।
মিরসরাই ট্র্যাজেডির সাত বছরের পূর্ণ হওয়ায় স্মৃতিচারন করতে গিয়ে আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মর্জিনা আক্তার বলেন, দুর্ঘটনায় আমাদের স্কুলের ৩৪ জন ছাত্র আজ জীবিত থাকলে দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্ব দিতো। তাদের শূন্যতা কখনো পূরন হবার নয়। এখনো মনে হচ্ছে তারা আমার আশেপাশে ঘুরাফেরা করছে। তিনি আরো বলেন, ট্র্যাজেডির সময় তৎকালীন শিক্ষা-সচিব এসে আবুতোরাব বহুমূখী উচ্চ বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করার ঘোষনা দিলেও অদ্যবদি কিছুই হয়নি। আমরা চাই শিক্ষা মন্ত্রণালয় দ্রুত আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করবে। মিরসরাই স্টেডিয়ামকে মিনি স্টেডিয়াম ও প্রতিটি বিদ্যালয়ে বিআরটিসি বাস দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এছাড়া ১১ জুলাইকে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস ঘোষণা করার দাবী উঠলেও এখনো এটি বাস্তবায়ন হয়নি।
মায়ানী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কবির নিজামী বলেন, ১১ জুলাই আমাদের জীবনে এক শোকাবহ দিন। ৪৫ জন শিক্ষার্থীকে হারানোর শোক আমরা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের উদ্যোগে ১১ জুলাই (বুধবার) নিহত স্কুল শিক্ষার্থীদের স্মরনে সকাল ৮টায় মসজিদ, মন্দির, গীর্জায় বিশেষ প্রার্থনা, সকাল ৯টায় আবুতোরাব স্কুল প্রাঙ্গনে স্থাপিত স্মৃতিস্তম্ভ আবেগ থেকে শোক র্যালী বের হয়ে দুর্ঘটনাস্থল অন্তিমে গিয়ে শেষ হবে। সকাল ১১টায় আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে নিহতদের স্মরণে শোক সভা ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে গৃহায়ণ ও গনপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে। শোক সভায় নিহত শিক্ষার্থীদের স্বজনও রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত থাকবেন।
বিভীষিকাময় সেদিন যা ঘটেছিল
১১ জুলাই ২০১১, সোমবার : মিরসরাই স্টেডিয়াম থেকে ফিরছিল বঙ্গবন্ধু-বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ ফুটবল ফাইনাল খেলা শেষে একটি পিকআপে করে বিজয়ী এবং বিজিত উভয় দলের খেলোয়াড় ও সমর্থকরা আবুতোরাব এলাকায় যাচ্ছিল। বড়তাকিয়া-আবুতোরাব সড়কের সৈদালী এলাকায় ৬০-৭০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে ডোবায় উল্টে যায় মিনিট্রাকটি। পরে সে লাশের রথ গিয়ে থামে পঁয়তাল্লিশে গিয়ে। অপর দিকে ছেলের মৃত্যু হয়েছে ভেবে হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেলেন এক বাবা হরনাথ। সর্বশেষ ২০১১ সালের ২৪ নভেম্বর রাত ৯ টায় নয়নশীলের প্রয়ান পর্যন্ত ৪৫টি মৃত্যু গুনতে হয়। ৪৫ জনের মৃত্যুর ঘটনায় ৮ ডিসেম্বর চালক মো. মফিজুর রহমান ওরফে মফিজ উদ্দিনকে দুটি ধারায় মোট ৫ বছরের সশ্রম কারাদন্ড দেয় আদালত। ২০১৫ সালের ২৮ জুলাই সাজা শেষে জেল থেকে ছাড়া পান চালক মফিজ।
সম্পাদনা: আএইচ/এনজেটি