এম মাঈন উদ্দিন, মিরসরাই থেকে
মিরসরাইয়ে প্রশাসনকে ম্যানেজ করে পাহাড়ের পাদদেশ ঘেঁষে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ইটভাটা। আর এই ইটভাটাগুলো প্রশাসনকে নিয়মিত মাসোহারা দিয়ে পুড়াচ্ছে কাঠ কাটছে পাহাড়। উপজেলায় মোট ১৩টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে ৬টির কোন অনুমোদন নেই। ওই ইটভাটাগুলোতে কয়ালার হাওয়ায় চিমনী না করে চলছে ব্রয়লায় চিমনী। পাহাড়ের পাদদেশ ঘেঁষে গড়ে উঠা অধিকাংশ ফিল্ডে ইটপোড়ানোর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে পাহাড়ের মাটি আর কাঠ। উপজেলাতে কি পরিমাণ ইটভাটা রয়েছে তার সঠিক হিসেব নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছেও।
মিরসরাই উপজেলা ব্রীক ফিল্ড মালিক সমিতি সূত্রে জানা যায় উপজেলার মোট ১৩টি ফিল্ডের মধ্যে ৭টির কাগজ পত্র থাকলেও বাকি ৬টির কোন কাগজপত্র নেই। উপজেলার বড়দারোগারহাটে ১টি, জামালের দোকানে ১টি, মিঠছরার গড়িয়াইশে ২টি, ভাঙ্গাদোকান এলাকায় ২টি, সোনাপাহাড় এলাকায় ১টি, মস্তাননগর বিশ্বরোড়ে ২টি, হিঙ্গুলীতে ১টি, করেরহাটে ৩টি ইটভাটা রয়েছে। কিন্তু চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তরে যোগাযোগ করে জানা যায় মিরসরাইয়ের ৭টি ইটভাটার পরিবেশ ছাড়পত্র রয়েছে। আর একটি অনুমোদন নেই।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায় উপজেলার ভাঙ্গাদোকান এলাকার এসবিকে-১ এর মালিক মাহমুদুল হক একটির অনুমোদন নিয়ে গড়ে তুলেছেন এসবিকে-২, এসবিকে-৩ নামে আরো দুটি ইটভাটা। গড়িয়াইশ এলাকায় পাহাড়ের পাশে ও তিন হাজার কেভি বিদ্যুৎ লাইনের নীচে ঝুঁকিপূর্ণ ভাবে গড়ে তোলা হয়েছে এই ইটভাটাগুলো। এসবিকে-২ তে ব্রয়লায় চিমনী দিয়ে চলছে দেদারছে গাছ পুড়ানো। ফিল্ডের আশেপাশের কয়েকটি জমিতে বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে জ্বালানোর জন্য আনা গাছের গুড়ি। সোনাপাহাড় এলাকায় কেবিআই ফিল্ডের মালিক জসিম উদ্দিনও একই ভাবে পুড়ছেন গাছ। ইটভাটার চারিদিকে গাছের স্তুপ করে রাখা হয়েছে জ্বালানোর জন্য। এছাড়াও করেরহাট ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আবু ছালেক কোম্পানীর ফিল্ড। পাশ্ববর্তী চত্তরুয়া গ্রামের আবছার কোম্পানীর আরবিএম, এনাম কোম্পানীর জেপিইও ফিল্ডেও গাছ পুড়ানো হচ্ছে। নাসির উদ্দিন নামে স্থানীয় এক প্রভাবশালী ভাঙ্গাদোকান এলাকায় দুটি ব্রিক ফিল্ড চালু করলেও অনুমোদন নেই একটিরও।
ইটভাটাগুলোতে বনের কাঠ পোড়ানোর পাশাপাশি ব্যবহার করা হচ্ছে ফসলী জমির টপ সয়েল। কৃষি জমি থেকে টপ সয়েল নিয়ে যাওয়ার ফলে উর্বরতা হারাচ্ছে ফসলী জমিগুলো। অধিকাংশ সময় ইটভাটা মালিকদের প্রলোভনে পড়ে জমির মালিকরা বাধ্য হন মাটি বিক্রি করতে। আর একজন জমির মাটি বিক্রি করলে পাশ্ববর্তি জমির মালিককেও বাধ্য হতে হয়ে মাটি বিক্রির জন্য। কেননা জমি উঁচু নিচু হয়ে গেলে সেচের পানি ঠিকমত থাকে না জমিতে।
উপজেলার প্রায় সবগুলো ইটভাটা পাহাড়ের পাশে স্থাপন করায় ধ্বংশ হচ্ছে সবুজ বনায়ন। ইটভাটার আগুনের উত্তাপ আর কালো ধোয়ায় পশুপাখি শূণ্য হয়ে পড়ছে পাহাড়গুলো। ইটভাটাগুলো পাহাড়ের পাশ্ববর্তী করার প্রধান কারণ হচ্ছে মহাসড়ক থেকে দূরে হলে প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে গাছ পুড়ানো ও পাহাড়ের মাটি ব্যবহার করা যায় সহজে। ইটভাটাগুলো প্রতি মৌসুমে পুড়ছে হাজার হাজার মণ গাছ। অধিকাংশ ইটভাটার প্রবেশমুখে কয়লার স্তুপ রাখলেও ভেতরে গিয়ে দেখা যায় পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। কেবিআই ইটভাটার ব্যবস্থাপক জানান, কয়লা দেখে সবাই ভাববে আমরা কয়লা পুড়িয়ে ইট তৈরী করি। তাই ফিল্ডে প্রবেশমুখে কয়লা রাখা হয়েছে।
কেবিআই ব্রিক ফিল্ডের মালিক জসিম উদ্দিন বলেন, আমার ফিল্ডে কয়লার হাওয়ায় চিমনী করার জন্য হাইকোর্ট থেকে এক বছর সময় নিয়েছি। যা চলতি বছরের অক্টোবর মাস পর্যন্ত সময় রয়েছে। এই এক বছরের মধ্যে ব্রয়লার চিমনীতে কাঠ পুড়ানোর অনুমোদন আছে। কাঠের পাশাপাশি কয়লা পুড়ছেন বলে তিনি দাবী করেন।
এসবিকে-২ এর শাখা ব্যবস্থাপক মো. আলমগীর বলেন, আমরা দুটি ফিল্ডের অনুমোদন পেয়েছি। যেটিতে এখন কাঠ পুড়ানো হচ্ছে তা চলতি বছরের মধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হবে। কয়লার দাম বেশী হওয়ার কারণে কাঠ পুড়াতে হচ্ছে। তাছাড়া সঠিক সময়ে কয়লা পাওয়া যায় না।
উপজেলার একটি ব্রিক ফিল্ডের মালিক নাম প্রকাশের শর্তে বলেন, উপজেলাতে যে ব্রিক ফিল্ডগুলো অনুমোদনহীন রয়েছে তার প্রত্যেকটি ফিল্ড প্রত্যেক মাসে উপজেলা প্রশাসনকে নির্দিষ্ট হারে চাঁদা দিয়ে আসে। ফলে বৎসরের বিভিন্ন সময় গাছ পুড়ানোর জন্য মোবাইল কোট পরিচালনা করা হলেও তা নিচক আইওয়াশ। মোবাইল কোর্টে সামান্য টাকা জরিমানা করে মোটা অঙ্কের টাকা বিনা স্লিপে আদায় করেন কর্তৃপক্ষ। আর মোবাইল কোর্ট পরিচালনার পর দিন থেকে আবার শুরু হয়ে যায় গাছ পোড়ানো।
মিরসরাই উপজেলা ব্রিক ফিল্ড মালিক সমিতির সভাপতি আজহারুল হক চৌধুরী নওশা মিয়া বলেন, উপজেলার ১৩টি ব্রিক ফিল্ডের মধ্যে ৬টি অনুমোদন নেই। অনুমোদনহীন ফিল্ডগুলোর মালিকদেরকে অনেকবার বলা হলেও তারা অনুমোদনের ব্যাপারে আগ্রহী না। ৬টির মধ্যে ৩-৪টি চলছে প্রকাশ্যে গাছ পুড়ানো। অনুমোদনহীন ইটভাটাগুলো কীভাবে চলছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন প্রশাসনকে কমিশন দিয়ে তারা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন ।
চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (কারিগরি) আবদুল্লাহ আল মামুন নতুন ফেনী’কে জানান, মিরসরাইয়ে ৭টি ব্রিক ফিল্ডের লাইসেন্স থাকলেও একটিও লাইসেন্স নবায়ন করেনি। আর একটি রয়েছে লাইসেন্স ছাড়া। মিরসরাইয়ে ৮টির বেশী ব্রিক ফ্লিড রয়েছে বললে তিনি বলেন আমাদের কাছে অন্যগুলোর হিসেব নেই। ইটভাটাগুলোতে গাছ পুড়ানোর বিষয়ে তিনি বলেন, বিভিন্ন উপজেলায় আমাদের মোবইল কোর্ট অব্যাহত রয়েছে। জনবল সংকটের কারণে সবগুলোতে এক সাথে মোবাইল কোর্ট পালন করা সম্ভব হচ্ছে না।
সম্পাদনা: আরএইচ/এমইউ
মিরসরাইয়ে নিষেদাজ্ঞার পরও ইটভাটায় দেদারছে পুড়ছে কাঠ!







