বাঙ্গালি থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত সকল আন্দোলন সংগ্রামে ফেনীর সন্তানেরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ভাষা সংগ্রামেও সক্রিয় ছিল ফেনীর সন্তানেরা। ভাষা শহীদ আবদুস সালামের বাড়ি ফেনীর দাগনভূঞাতে। বাঙ্গালির ভাষা সংগ্রামের প্রতিক শহীদ মিনার। ভাষা শহীদদের স্মরণে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। ফেনীতে প্রথম শহীদ মিনারটি নির্মিত হয় ফেনী সরকারি কলেজে। যদিও এই ইতিহাস অনেকটা অগোচরেই রয়ে গেছে। জনসাধারন নয় কেবল, অত্র কলেজের খুব সংখ্যক শিক্ষার্থী এটি সম্পর্কে জানে। এই ইতিহাসকে সামনে নিয়ে এসে জনসাধারনকে জানানোর জন্য এ যাবতকালে কোন পদক্ষেপ গ্রহন করেনি কলেজ কতৃপক্ষ।
৫২ পরবর্তী ফেনী সরকারি কলেজর ছাত্র ভাষা আন্দোলনকারী অধ্যাপক রফিক রহমান ভূঞাঁ জানান, ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়ে আসলেও শহীদ বেদী নির্মাণে কেউ নজর দেননি। ফেনী সরকারী কলেজ পুকরের পূর্ব পাড়ের খালি জায়গায় সভা-সমাবেশ হওয়ায় এখানেই শহীদ বেদী নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। পরে মূল ভবনের পার্শ্বে শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ শুরু করেন সাধারণ ছাত্ররা। শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে সাধারণ ছাত্ররা দাবি করলে অনীহা প্রকাশ করে। পরবর্তীতে খাজা আহমদ, এবিএম মুসা, কোব্বাদ আহমেদ, জিয়াউদ্দীন আহমেদসহ ছাত্র মজলিশ নেতারা চাঁদা তুলে শহীদ মিনার নির্মাণ কাজ শুরু করেন। তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ফেনী কলেজের ছাত্ররা উদ্যোগ নিয়ে রাতের আঁধারে শহীদ মিনারটি নির্মাণ করে। পুকুরের পাড় ঘেঁষে ইট-বালু দিয়ে পাঁচ ফুট উঁচু প্রথম শহীদ বেদী নির্মাণ করা হয়। প্রশাসনের নজর এড়িয়ে শহীদবেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও প্রভাতফেরি করতো ছাত্ররা। ভাষা শহীদদের স্মরণ করে নির্মিত এ শহীদ বেদিটি ছিলো ফেনীর প্রথম শহীদ মিনার। অল্প সময়ের মধ্যে ছোট পরিসরে শহীদ মিনারটি নির্মাণ করা হয়।
ভাষা আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে ফেনীতেও মিছিল-মিটিং, সভা-সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি পালিত হয়। প্রায় প্রতিদিনই মিছিল-মিটিং হতো। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনে ফেনী সরকারী কলেজ, ট্রাংক রোড় চত্ত¡রে ভাষার দাবীতে সমাবেশ হতো। খাজা আহমদ, কাজী এবাদুল হক, এবিএম মুসা, কোব্বাদ আহমেদ, শামসুল হুদা, শান্তি সুর, সিদ্দিক উল্লাহ, খলিল উল্লাহ, জিয়াউদ্দীন আহমেদ প্রমুখ ছাত্রনেতাদের বক্তৃতা পুরো শহর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ফেনীতেও সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। ঢাকায় মিছিল-সমাবেশের উপর ১৪৪ ধারা জারি করে পাকিস্তান সরকার। বাংলার দামাল ছেলেরা সেটি ভঙ্গ করে। পুলিশ মিছিলে গুলি চালালে ফেনীর আবদুল সালামসহ বেশ কয়েকজন শাহাদাত বরণ করেন। খবরটি ফেনী আসতে বেশি সময় লাগেনি। বিকালে ফেনীতে খবরটি ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষুদ্ধ হয়ে পড়ে ফেনীর ভাষা সৈনিকরা। তাৎক্ষণিক মিছিল বের করেন তাঁরা। পরদিন ট্রাংক রোড়ে সমাবেশ করে ভাষা সংগ্রাম পরিষদ। সেখানে খাজা আহাম্মদ, জিয়াউদ্দীন আহমেদসহ অনেকে বক্তব্য দেন।
ফেনী কলেজের ছাত্র মজলিশের সাধারণ সম্পাদক জিয়া উদ্দীনের নেতৃত্বে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রম পরিষদ গঠিত হয়। ওই সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম সদস্য ছিলেন প্রয়াত ওবায়দুল হক পরের বছর তিনি ছাত্র মজলিশের সাধারণ সম্পাদক হন। প্রয়াত আবুল কাশেম, প্রয়াত ফরমান উল্লাহ খান, প্রয়াত লুৎফর রহমান, প্রয়াত আমীর হোসেন, নূরুল হক, সৈয়দ মাঈনদ্দুীন হোসেন এবং বিচারপতি কাজী এবাদুল হক এ সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন।
কেমন ছিলো ফেনীর প্রথম শহীদ মিনার। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও তৎকালিন সময়ে ফেনী সরকারী কলেজের ছাত্র পরবর্তীতে একই কলেজের অধ্যক্ষর দায়িত্ব পালনকারী প্রফেসর তায়বুল হক জানান, স্বাধীনতার পূর্বে ছোট্ট পরিসরে পাকা শহীদ মিনার ছিল। বেদী থেকে পাঁচ ফুট উঁচু তিনটি মিনার ছিল। মিনারগুলোর মাথার অংশ ছিল সামান্য বাঁকা। পরবর্তীতে ওই শহীদ মিনার ভেঙ্গে নতুন করে নির্মাণ করা হয়।
ফেনী সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী সায়েম বলেন, ফেনী জেলার প্রথম শহীদ মিনার যে আমাদের কলেজের শহীদ মিনারটি এটি জানা ছিলনা। আজকে প্রথম জানতে পেরেছি। আমার মত এমন অনেকেই এই ইতিহাস সম্পর্কে জানেনা।
আরেক শিক্ষার্থী সুলতানা জানান, এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের বিষয় । এটি সবাইকে জানানোর জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষ যদি কোন উদ্যোগ গ্রহন করে তাহলে সকল শিক্ষার্থী এই গৌরবগাথা ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবে।
ফেনী সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর বিমল কান্তি পাল জানান, আমরা এ ইতিহাসটি সবার সামনে নিয়ে আসার জন্য উদ্যোগ গ্রহন করছি। শহীদ মিনারের পাশে সাইন বোর্ড লাগিয়ে ফেনীর প্রথম শহীদ মিনারে ইতিহাস তুলে ধরা হবে। কলেজের বিভিন্ন প্রকাশনা ও আলোচনা অনুষ্ঠানে এটি তুলে ধরা হবে।
সম্পাদনা:আরএইচ/এইচআর







