সেই গ্রিক সভ্যতার সময় থেকেই বিতর্কের শুরু। ক্লিওন, ডায়োডটাস, সিসেরোর মত ব্যক্তিরা সে যুগে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন কার্যক্রমের ভালো-মন্দ বিচার করতেন, সুপারিশ করতেন জনসম্মুখে বিতর্ক করে।
দু’হাজার বছর পরে এসেও, রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা সবাই যুক্ত হয় বিতর্কের সাথে। কেউবা সক্রিয়ভাবে বিতর্ক করে, কেউ বিতর্ক দেখে, আর কেউ দূরে দাঁড়িয়ে বিতার্কিকদের ‘ঝগড়াটে’ উপাধি দিয়ে ব্যঙ্গ করে। তবে স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিতর্কের নাম শোনে নি, এরকম মানুষ মেলা ভার।
বিতর্কের প্রতি আমার ভালোবাসা সেই ছোটকাল থেকেই যখন থেকে বিটিভিতে বিতর্ক দেখতাম। উচ্চ মাধ্যমিকে উঠার পর বিতর্ক করার প্রথম সুযোগ পাই ফেনী ডিবেটিং ক্লাবের মাধ্যমে। স্নাতকে ভর্তি হওয়ার পর সুযোগটা বৃদ্ধি পায়। কয়েকটা কর্মশালায় অংশগ্রহন করি। সংসদীয় বিতর্ক সম্পর্কেও কিছুটা ধারনা লাভ করি। ২০১৭ সালে জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সপ্তাহ উপলক্ষ্যে আয়োজিত বিতর্কে ফেনী কলেজের হয়ে অংশগ্রহন করে চট্রগ্রাম বিভাগে রানার্স-আপ হই আমরা।

২০২৭ সালে জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সপ্তাহ বিতর্কে চট্রগ্রাম বিভাগীয় পর্যায়ের রানার্স-আপের সম্মাননা গ্রহন
আমি দলনেতা ছিলাম, সাথে ফারিয়া, শামামা ছিলো ওরা উচ্চ মাধ্যমিকে পড়তো। পুরো প্রতিযোগিতা সনাতনী পদ্ধতিতে হলেও ফাইনাল সংসদীয় পদ্ধতিতে হয়। আমার কিছুটা ধারনা, অভিজ্ঞতা থাকলেও আমরা দলের অন্যদের সংসদীয় বিতর্কে জ্ঞান শূণ্যর কোঠায়। একরাত সময় পেয়েছিলাম সেই একরাতে তাদেরকে কিছুটা ধারনা দিয়ে পরের দিন বিতর্ক করি। ফাইনালে চট্রগ্রাম সিটি কলেজের সাথে হেরে যাই আমরা। হেরে গেলেও কলেজের বিগত কয়েক বছর ইতিহাসে সেটাই ছিলো সর্বোচ্চ অর্জন। অথচ আমাদের অনেক ভালোমানের বক্তা আছে দরকার শুধু তাদেরকে বিতার্কিক হিসেবে গড়ে তোলা।
সেই দিনই আমি প্রয়োজনবোধ করি আমাদের কলেজে একটি বিতর্ক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করার। তৎকালিন অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ স্যারের কাছে প্রস্তাব করি। সমাজকর্ম বিভাগের প্রভাষক আলাউদ্দিন স্যার আমাদেরকে সদস্য ফরম দেয় পূরণ করে জমা দিই । কিন্তু সেটা সেখানেই সমাপ্তি আর কোন কার্যক্রম হয়নি। তখন থেকেই আমার স্বপ্ন ছিলো আমি এই কলেজ থেকে বিদায় নেয়ার একদিন আগে হলেও ফেনী কলেজে বিতর্ক সংগঠন দেখে যাবো।

আন্তজার্তিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত প্রীতি বিতর্ক শেষে কলেজ মিলনায়তনের সামনে…
আবুল কালাম আজাদ স্যার বিদায় নেয়ার পর বর্তমান অধ্যক্ষ প্রফেসর বিমল কান্তি পাল স্যার দায়িত্ব গ্রহন করেন। ২০১৯ সালে শুরুর দিকে আমি অধ্যক্ষ মহোদয় এবং তৎকালিন শিক্ষক পরিষদ সম্পাদকের নিকট আবার প্রস্তাব নিয়ে যাই। তখন কোন সাড়া পাইনি । বর্তমান শিক্ষক পরিষদ সম্পাদক জহির উদ্দিন স্যার দায়িত্ব গ্রহনের ১ মাস পর তাকে এবং অধ্যক্ষ মহোদয়ের নিকট আবার মৌখিক আবেদন করি ডিবেটিং সোসাইটি প্রতিষ্ঠার করার জন্য । স্যাররা আমাকে আশ্বাস দেয় গঠন করবে বলে।

প্রীতি বিতর্ক…
আরো কয়েকবার অধ্যক্ষ স্যারের সাথে এ বিষয়ে কথা বলার পর তিনি বলেন বিতর্ক সংগঠন করতে হলে এটি তত্ত্ববধায়ন করার জন্য শিক্ষক লাগবে। স্যার এই কথা বলার পর আমি যোগাযোগ করি ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও বর্তমান এফসিডিএসের সিনিয়র মডারেটর সোহেল মোস্তাক স্যারের সাথে। স্যারকে আমি ব্যাক্তিগতভাবে অনেক পছন্দ করতাম তাই তাকেই প্রথম অনুরোধ করি। তিনি বিতর্ক নিয়ে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং অধ্যক্ষ মহোদয়ের সাথে যোগাযোগ করেন। এর পরের প্রতিটি পদক্ষেপে তার অনস্বীকার্য ভূমিকা ছিলো।
পরবর্তীতে বর্তমান ফেনী সরকারি কলেজ ডিবেটিং সোসইটি’র (এফসিডিএস) চীফ মডারেটর বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মোঃ হূমায়ুন কবির স্যারকে আহবায়ক করে সিনিয়র মডারেট মোঃ সোহেল মোস্তাক, সহকারী অধ্যাপক, ইরেজি বিভাগ, মডারেটর মু. মনজুরুল হাসান রুমি, প্রভাষক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, মডারেটর গোলাম রাব্বানি রানা, প্রভাষক, ইতিহাস বিভাগ, তানভীর উদ্দিন ফয়সাল, প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগকে নিয়ে ৫ সদস্যর আহবায়ক কমিটি গঠন করেন।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন অধ্যক্ষ
স্যাররা পুরোদমে কাজ শুরু করেন সংগঠনের নাম দেন ফেনী সরকারি কলেজ ডিবেটিং সোসাইটি (এফসিডিএস), স্লোগান ঠিক করেন ‘যুক্তিতে মুক্তি’ এবং লোগোও ডিজাইন করান। ২০১৯ সালে ২০ নভেম্বর ইংরেজি বিভাগের নাইটিংগেল হলে শুভপোক্রম অথাৎ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ফেনী সরকারি কলেজে নতুন ইতিহাস রচিত হয়। সেই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অধ্যক্ষ প্রফেসর বিমল কান্তি পাল, বিশেষ অতিথি ছিলেন তৎকালিন উপাধ্যক্ষ প্রফেসর মো. আবু নসর ভূঞাঁ, শিক্ষক পরিষদ সম্পাদক মোঃ জহির উদ্দিন স্যার অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন মু. মনজুরুল হাসান রুমি স্যার।
তখন আমাদের স্থায়ী কোন ঠিকানা ছিলনা । ইংরেজি বিভাগের শ্রেণীকক্ষে সাপ্তাহিক সেশন চলতো। বিভিন্ন দিবস কেন্দ্রিক প্রতিযোগিতা হতো। স্বাধীনতা দিবস-২০২০ উপলক্ষ্যে প্রথম আন্তঃবিভাগে বিতর্ক প্রতিযোগিতার প্রস্তুতি গ্রহন করা হয় কিন্তু করোনা মহামারির কারনে সেটি পরে স্থগিত করা হয়। ২০২০ সালের মার্চের দিকে আমাদের জন্য একটি রুম বরাদ্দ করা হয়। অনার্স ভবনের নিচতলায় যেখানে আগে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সেমিনার রুম ছিলো। তখন রুমটি ছিলো ব্যাবহারের অযোগ্য। বিগত ২ মাস আগে রুমে রুমের দেয়ালে নতুন রং, লাইট, ফ্যান, তাক, টাইলস করা, আসবাবপত্র, বই, বিতর্কের জন্য প্রয়োজনীয় সকল সামগ্রী সংগ্রহ করা হয়। এক কথায় একটি পরিত্যাক্ত রুমকে সুন্দর, মনোরম অফিসে পরণিত করা হয়।

নিয়মিত বিতর্ক সেশন…
গতকাল এফসিডিএসের এক বছর পূর্ণ হয়। আমি মনে করি আমরা সফল একটি বছর অতিক্রম করেছি। এই একবছরে দিনগুলো ছিলো অনেক চ্যালেঞ্জিং। আমাদের মডারেটর স্যারদের নিরলস পরিশ্রম, বুদ্ধিমত্তা, ধৈর্যের ফল আজকের সুসজ্জিত এফসিডিএস। আমি বিতার্কিকদের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জানাই এফসিডিএসের প্রধান পৃষ্ঠপোষক প্রফেসর বিমল কান্তি পাল স্যারে প্রতি তিনি সহযোগিতা না করলে এফসিডিএস আজকের এই অবস্থানে আসতে পারতোনা। সেই সাথে কৃতজ্ঞতা জানাই শিক্ষক পরিষদের সম্পাদকের নিকট এই কাজে তিনি পাশে ছিলেন সব সময়।
যাদের অবদান, পরিশ্রমরে কথা বলে শেষ করা যাবেনা তারা হলেন মোস্তাক স্যার এবং রুমি স্যার। কলেজ বন্ধ থাকাকালীন সময়েও কেবল মাত্র এফসিডিএসের কাজের তদারকি করার জন্য নিয়মিত কলেজে আসতেন, সময় দিতেন। প্রতিনিয়ত শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন এই সংগটনটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তাদের এই ত্যাগের ফলেই আমরা একটি সুন্দর পরিবেশ পেয়েছি। এফসিডিএস যতদিন থাকবে যতদিন আমরা থাকবো ততদিন আমাদের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তারা।

এফসিডিএসের অফিস…
৩ বছর আগে আমি যে স্বপ্ন দেখেছি তা বাস্তবে ধরা দিয়েছে। প্রফেসর বিমল কান্তি পাল, জহির উদ্দিন, সোহেল মোস্তাক, রুমি স্যাররা না থাকলে এই স্বপ্ন অধরাই থেকে যেতো যেমনটা ছিলো কলেজের বিগত ইতিহাসে। আমি কেবল স্বপ্ন দেখেছি বাস্তবায়ন করেছেন তারা। এফসিডিএস প্রতিষ্ঠা এবং এর উন্নতি সাধনে তাদের অবদান চির অম্লান। আজন্ম শ্রদ্ধাভরে স্মরণে থাকবেন আমার মানসপটে।
এক নয় কেবল একের পাশে আরো দুইটি শূন্য যোগ হয়ে সফলতার ১০০ বছর অতিক্রম করবে আমাদের ভালোবাসার এফসিডিএস। প্রথম প্রতিষ্ঠা বাুর্ষিকীতে সকল মডারেটর, বিতার্কিক এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং ভালোবাসা। জয় হোক বিতর্কের, জয় হোক এফসিডিএসের।
লেখক- বিতার্কিক, এফসিডিএস
সম্পাদনা:আরএইজ/এইচআর







