সবীর আহমেদ ফোরকান, পরশুরাম থেকে >>
শীতল পাটি। শুধু গ্রাম বাংলায় নয় বাঙালির ঐতিহ্যের একটি। দুপরের আহারের পর একটু হেলান দিয়ে নিজেকে বিছানার সাথে উজাড় করে দেয়া কিংবা গ্রীস্মকালে ক্লান্ত দেহটি বিছানার সাথে হেলান দিয়ে ঘুমানোর জন্য স্বস্তিদায়ক। গ্রামে শীতল পাটির কদর যুগে যুগে। তবে শুধু গ্রামে নয় নগরের মানুষের অন্যতম অনুসঙ্গ বলা যায়। এখনো কমেনি তার কদর। গ্রামের ন্যায় শহরেও এর চাহিদা ব্যাপক। মায়ার জাল বিছিয়ে বোনা শীতল পাটির সংস্পর্শ যেন পুরনো দিন গুলোকে মনে করিয়ে দেয়। মনে করিয়ে আমাদের অতীতের দিনগুলির কথা। আহা! কতইনা আনন্দের ছিলো সেসব দিনগুলো। দাদা-দাদী কিংবা বড়দেও মুখ থেকে কত গল্পই না শোনা হতো আমাদের। গ্রামের মানুষ একটুখানি আরামের জন্য তোষকের উপর এখনও শীতলপাটি বিছিয়ে তৃপ্ত হন। যদিও এখনো তা হারিয়ে যেতে বসেছে। এমন একটি গ্রাম পাওয়া গেলো যেখানে এ পেশাটি এখনো মিটি মিটি করে জিয়ে আছে।
জানা যায়, পরশুরামের গ্রামে গ্রামে একসময় বোনা হত শীতল পাটি। এখন সেটির পরিসর ছোট হয়ে এসেছে।পৌরসভার কোলাপাড়া(যুগী গ্রাম) গ্রামে এখনো কয়েকশ পরিবার শীতল পাটি বোনার সাথে যুক্ত।শীতল পাটি ছাড়াও বিভিন্ন পাটি বোনা হয় এখানে। এখন শীতল পাটির চাহিদা বেড়েছে।কিন্তু পাটি তৈরি উপকরনের অভাবে বোনা যাচ্ছে না শীতল পাটি। পরিবারের অভিঙ্গরাই বোনেন শীতল পাটি । প্রথমে বাজার থেকে পাটি পাতা (মোর্তাক) কিনতে হয়।বাঁশের কঞ্চির মতো দেখতে এ গাছ সাধারনত নদী,খাল,পুকুর পাড়ে বা পরিত্যাক্ত জমিতে জন্ম নেয়।এক আটি মোর্তাকের দাম পড়ে ২৫০/৩০০ টাকা।বাড়িতে এনে কচি মোর্তাক ৩ ফালি করে কাটতে হয়।এগুলোকে নীল বলে।এটি দিয়েই বোনা হয় শীতল পাটি। মোর্তাকের সাদা অংশও ফেলনা নয়।এটি দিয়েও তৈরি হয় পাটি।তবে সেটি শীতল পাটি নয়। দামও কম।নীল পাতলা করে কেটে গরম পানিতে সিদ্ধ করতে হয়।তারপর এটিতে রং লাগিয়ে কখনো বা রং ছাড়া শীতল পাটি বোনা হয়।এছাড়া পুরো পাটি তৈরির পর চারপাশে বাঁধ দিতে হয় বেত দিয়ে যা জালি বেত নামে পরিচিত। ৭ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৫ ফুট প্রস্থের একটি পাটি তৈরিতে একজন কারিগরের ৭/৮দিন সময় লাগে।একটি পাটি বিক্রি হয় ১২শ থেকে ১৪শ টাকায়। এছাড়া ছোট বড় সাইজের পাটিও তৈরি হয়।দামেও থাকে ভিন্নতা। পাটি তৈরি উপকরনের লাগামহীন দাম ও দূর্লভতার কারনে শীতল পাটি শিল্প অনেকটাই বিলুপ্তির পথে।
পরশুরাম পৌরসভার পশ্চিম কোলাপাড়া গ্রাম। এখানে প্রায় ৫শতাধিক হিন্দু পরিবার রয়েছে। মূলত তাদেরকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে শীতল পাটি শিল্প। এখানকার প্রায় ২০০ থেকে আড়াইশ পরিবার শীতল পাটি তৈরির সাথে জড়িত। কয়েক’শ বছর ধরে তাদের পেশা এটা। তবে শীতল পাটি শিল্প অনেকটাই মিইয়ে যাচ্ছে। অনেকে ছেড়ে দিয়েছেন এ পেশা। এরপরও কিছু মানুষ নাড়ির টানে বাপ-দাদার এ পেশাকে জিইয়ে রেখেছেন।
যুগী গ্রামের মধ্য বয়সী জ্যোতি রানী ও মিশুকা রানী জানান, ঐতিহ্যগতভাবে আমরা এ পেশায় জড়িত, আমাদের পুর্বপুরুষরা এ পেশা ছাড়তে নিষেধ করে গেছেন। তাছাড়া এর প্রতি বিশেষ মায়া ছাড়তে পারি না।
পাটি তৈরির কারিগর রাঁধা রানী (৬০) আক্ষেপের সুরে বলেন, বাবারে! পাটি বিক্রি করে যা পাই তা দিয়ে কোনরকমে সংসার চলে। কিন্তু তারপরও এটা ছাড়তে মন চায় না। কি করমু এটা না করে।
পাটি তৈরির প্রবীন কারিগর ধীরেন্দ্রকুমার নাথ (৮২), তার বাপ চাচারাও এ পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলো, তিনিও দীর্ঘদিন এ পেশার সাথে যুক্ত, তিনি জানান, সরকারের সহযোগীতা না পেলে পাটি শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। এখানকার পাটি কারিগরদের দাবি, পাটি শিল্পকে সরকার সহযোগীতা করলে এ শিল্প আরও উন্নত হবে। কারিগরদের আগ্রহ বাড়বে। বেঁচে থাকবে শীতল পাটি শিল্প। হারাবে না আমাদের ঐতিহ্য।
পরশুরাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মনোয়ারা বেগম জানান, সরকারী বরাদ্ধ পেলে পাটি তৈরির কারিগরদের সহায়তা দেয়া হবে এবং এ পেশাকে আরো গতীশিল করা হবে।
সম্পাদনা: আরএইচ/এইটএসটি/এসএইচএফ







