করোনায় মানবিক যোদ্ধা হয়ে কাজ করছেন ফেনী সরকারি কলেজ ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা হেল্পিং মাইন্ড’র সভাপতি মোস্তাক হোসেন সোহেল। ১৯৮৫ সালে ছাগলনাইয়া উপজেলার মহামায়া ইউপির মাটিয়াগোধা গ্রামের মাস্টার ফারুক আহমেদ ও বেগম মনোয়ারা ফারুক’র ঘর আলোকিত করে জন্ম নেয়া সোহেল মোস্তাক ১৯৯৫ সালে নিজ এলাকার বিদ্যাকুটির সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সমাপনী শেষ করেন। এরপর চাঁদগাজী হাই স্কুল থেকে ২০০১ সালে এসএসসি পাশ করেন। সে সময় স্থানীয় স্কুল বন্ধুদের নিয়ে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা মহামায়া গণপাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেন। সেখান থেকে পড়াশোনার তাগিদে চট্টগ্রাম কলেজে একাদশে ভর্তি হন, এবং ২০০৩ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। এরপর উচ্চ শিক্ষা অর্জনের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। তার বাবা মাস্টার ফারুক আহমেদ’র স্বপ্ন ছেলেও তাঁর মতো শিক্ষকতা করবেন। সেখান থেকে ইংরেজি বিভাগে ২০১০ সালে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করে। ২৯ তম বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে উত্তীর্ণ হয়ে ২০১১ সালে নিজ উপজেলা ছাগলনাইয়া সরকারি কলেজে ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান। একই বছর নভেম্বরের শেষের দিকে তার সহকর্মী তৎকালীন বাংলা বিভাগের প্রভাষক জাফর ইকবাল সহ কলেজের প্রাক্তণ শিক্ষার্থী মানছুর আলম, বাপ্পি, হাসান ও কাইয়ুমকে সাথে করে পথশিশুদের নিয়ে কাজ করা ‘হেল্পিং মাইন্ড’ নামক একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা গঠন করেন।
সভাপতি মোস্তাক হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন জাফর ইকবাল। শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে ৪০ জন পথশিশুকে একসাথ করে তাদেরকে খাদ্যের বিনিময়ে পড়াশোনার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেন। ৫ বছর অধ্যাপনার পর ২০১৬ সালে বদলী হয়ে ফেনী সরকারি কলেজে চলে যান। সেখানে থাকা অবস্থায় ভারতের আমন্ত্রনে দুই মাসের জন্য সরকারি খরচে চেন্নাই (এনআইটিটিটিআর) প্রশিক্ষণ নেন। পাশাপাশি একাধারে তিনি একজন কবি সাহিত্যিক ও ভ্রমণ পিয়াসু। দেশ বিদেশের বেশ কিছু জায়গায় ভ্রমণ করে অনেক জ্ঞান অর্জন করেন। ভারত থেকে ফিরে আসার পর একই বছর প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেয়ে চট্টগ্রাম সিটি কলেজে যান। সেখানেও দুই বছর অধ্যাপনার পর আবারো ফিরে আসে নিজ জেলা ফেনী সরকারি কলেজে। এসেই কলেজের সহকর্মী ও শিক্ষার্থীদের সাথে নিয়ে প্রথমবারের মতো প্রতিষ্ঠা করেছেন ফেনী সরকারি কলেজ ডিবেটিং সোসাইটি (এফসিডিএস)।

অধ্যাপনার পাশাপাশি নিজেকে জড়িয়ে রেখে প্রতিষ্ঠা করা হেল্পিং মাইন্ড’র শুরু থেকে পথশিশুদের জন্য একটি ফান্ড গঠন করেন। তাদের জন্য একটি স্কুল তৈরি করেন। সেখানে দু’জন শিক্ষক দিয়ে তাদেরকে হাতে কলমে শিক্ষা দেন। তাছাড়া বই, খাতা, কলম, পেঞ্চিল, জামা কাপড়, সবই বিনামূল্যে দিয়ে থাকেন। প্রতি বছর রমজানের ঈদে তাদেরকে নতুন জামা ও ইফতার সামগ্রী প্রদান করেন। শীতের সময় শীত বস্র এবং কম্বল তুলে দেন তাদের হাতে।
এছাড়াও ঈদের আনন্দ ভাগ করে নিতে রমজানের ঈদে তাদের মুখে তুলে দেন রান্না করা পায়েস, সেমাই ও নতুন টাকা। বিশ্ব ভালোবাসা, পহেলা বৈশাখের মতো দিবসগুলোতেও তাদের হাতে গোলাপ ফুলের স্টিক এবং খাবারের প্যাকেট তুলে দেন। বিভিন্ন দিবসে পথশিশুদের নিয়ে শহীদদের স্মৃতিতে পুস্পস্তবক অর্পণ করেন। পথশিশুদের কল্যাণে এবং তার এলাকায় পাঠাগার, স্কুল, মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থান এর উন্নয়নকল্পে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন এই মানবিক যোদ্ধা।
পিতার স্বপ্ন পূরণে শুধু তাঁর পছন্দের পেশার পাশাপাশি ২০১২ সাল থেকে মাটিয়াগোধা সওদাগর বাড়ি হাফেজিয়া মাদ্রাসার সভাপতি হিসেবে অদ্যাবধি কাজ করছেন তিনি। এবছর করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে ব্যক্তিগত উদ্যোগে নিজের হাতে গড়া স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা হেল্পিং মাইন্ড’র সদস্যদের নিয়ে মসজিদ, ধর্মীয় উপাসনালয় এবং উপজেলার বিভিন্ন স্থানে মানুষকে সচেতন করার জন্য সচেতনতামূলক লিফলেট, মাস্ক, জীবানুনাশক স্প্রে, হ্যান্ড স্যানিটাইজারসহ বিভিন্ন সামগ্রী বিতরণ করেন।

এছাড়াও করোনা শুরুর প্রথম থেকে এ পর্যন্ত নিজের ব্যক্তিগত তহবিল থেকে খাদ্যসঙ্কটে পড়া কর্মহীন, অসহায়, দিনমজুর ও হতদরিদ্র অনেক পরিবারের মাঝে খাদ্যসামগ্রীও নগদ অর্থ বিতরণ করেন। গত ২২ এপ্রিল অনলাইন নিউজ পোর্টাল নতুন ফেনী’তে “ভালো নেই নয়ন দাস” শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর হেল্পিং মাইন্ড’র খাদ্যসামগ্রী নিয়ে ছুটে যান নয়ন দাস’র পাশে।
মোস্তাক হোসেন সোহেল নতুন ফেনী’কে বলেন, ছোটবেলায় দেখতেন অনেকে পরিবারের আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে তাদের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করাতে পারছেনা। যৌতুকের জন্য অনেক মেয়ে তাদের স্বামীর সংসারে নির্যাতিত হওয়া। টাকার অভাবে বিয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসা যাওয়ার পথে অনেক মেয়ে ইভটিজিংয়ের শিকার হয়ে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। সেই থেকে স্বপ্ন বুনেন বড় হয়ে কিছু একটা করে অবহেলিত পথশিশুদের পাশে দাঁড়ানো। সমাজে যৌতুক প্রথা বন্ধ ও মেয়েরা ইভটিজিংয়ের শিকার যাতে না হয় সেজন্য মানুষের কল্যানে তাদের পাশে থেকে নিজেকে নিয়োজিত রাখা। কলেজের একঝাঁক তরুণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা হেল্পিং মাইন্ড প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে একমাত্র আর্ত্মমানবতার কল্যাণে কাজ করার জন্য।

তিনি আরো বলেন, অবহেলিত পথশিশুরা যাতে মানুষের মতো মানুষ হয়ে সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে এবং তাদের বাবা-মায়ের কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন পূরন করতে পারে সেজন্য তিনি কাজ করে যাবেন। পাশাপাশি যতদিন পর্যন্ত মহামারী করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব থাকবে ততদিন তিনি নিজের সর্বস্ব দিয়ে খাদ্যসঙ্কটে পড়া কর্মহীন অসহায়, দিনমজুর ও হতদরিদ্র মানুষের পাশে থাকবেন বলে জানান।
সম্পাদনা: আরএইচ/এমকেএইচ







