এম মাঈন উদ্দিন>>
আদিম পুরুষরা মুলত যাযাবর ছিলেন। তারা ঘুরে বেড়াতেন একস্থান হতে অন্যস্থানে জীবিকার সন্ধানে। আর এদের ছোট ছোট জনগোষ্ঠীকে বলা হতো ‘বেদুঈন’। সভ্যতার ক্রমবিকাশে তারা আজ অতীত। কিন্তু আধুনিক সভ্যতার এই লগ্নেও কিছু কিছু মানুষ যাযাবর বৃত্তি নিয়ে জীবন জীবিকা নির্বাহ করছে আমাদের দেশে, যারা এই সমাজে বেদে সম্প্রদায় বলে পরিচিত।
মিরসরাইয়ের জোরারগঞ্জে রয়েছে একটি বেদে পাড়া, যারা পূর্বপুরুষদের ঘানি টানতে টানতে আজ ক্লান্ত। সমাজের অবহেলা আর বঞ্চনার জন্য তারা পূনর্বাসনের জন্য সুযোগ পাচ্ছেনা। আজ থেকে ১২০/১৩০ বছর আগে মুন্সিগঞ্জ এবং যশোর জেলা থেকে আসা ৪/৫ টি সাপুড়ে ও মাল বৈদ্য সম্প্রদায়ের পরিবার মিরসরাইয়ের জোরারগঞ্জ সোনাপাহাড় গ্রামের অনাবাদি এবং বিস্তীর্ন এলাকায় বসতি স্থাপন করেন। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে আনাবাদি জমিগুলোকে আবাদযোগ্য করে তোলে তারা। ধীরে ধীরে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বেদে সম্প্রদায়ের লোকজন এখানে স্থায়ী আবাস গড়ে তোলে। বর্তমানে বেদে পাড়ায় পরিবার রয়েছে ২৬০ টি। লোকজন প্রায় ৩ হাজার।
বেদে পাড়ার সর্দার জাফর আহাম্মদ জানান, মাত্র ২ একর জায়গায় একসাথে বাস করছে ৩০০০ লোকজন। শিক্ষা,বাসস্থান, চিকিৎসা, স্যানিটেশন, বিশুদ্ধ পানি সহ হাজারো সংকটে তারা দিন যাপন করছে। এই দুরাবস্থা চলতে থাকলেও প্রশাসনের কোন সুনজর পড়েনি আজ পর্যন্ত। শুধু মাত্র ভোট এলেই তাদের প্রয়োজন পড়ে। অন্যসময় তাদের দিকে দৃষ্টি দেওয়ার কোন লোক খুজে পাওয়া যায়না। ৮০ বছর বয়স্ক এক বৃদ্ধ বললেন, আমি যখন এখানে এসেছি তখন আমার বয়স ছিলো ৭। আজ পর্যন্ত দেশে কতকিছু হলো কিন্তু আমাদের সমস্যা সমাধানে কোনদিন কেই এগিয়ে আসেনি।
জোরারগঞ্জ বেদে পাড়ার বাসিন্দারা বানরী, মালবৈদ্য, ও সাপুড়ে এই তিন সম্প্রদায়ে বিভক্ত। বানরীদের কাজ হচ্ছে বানর ধরা, বানরের খেলা দেখানো, মালবৈদ্যরা সাপে কাটা মানুষদের চিকিৎসা করেন, সিঙ্গা লাগান এবং ঝাড় ফুক করেন। সাপুড়েরা সাপ ধরে ও খেলা দেখায়।
বেদে পাড়ার সর্দার জাফর আহাম্মদ জানান, একসময় সকলে পূর্ব পুরুষদের পেশায় নিয়োজিত থাকলেও বর্তমানে অর্ধেকের বেশি পেশা পরিবর্তন করেছে। এ পেশায় আগে যা রোজগার হতো তা কমে গেছে। তাই পৈতৃক পেশা ছেড়ে দিয়ে কেই মাঠে বদলা হিসেবে কাজ করছে আবার কেই রিকসা চালাচ্ছে। সাধারণ মানুষদের কটুক্তি আর ঘৃনার কারনে অন্যনাও আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, ঝাড় ফুক সিঙ্গা লাগানোর কাজে মহিলারা গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়। যার চাহিদা বর্তমানে কমে গেছে। তাদের আয় সম্পর্কে জানা যায়, বানর গননা করে দিনে ১০০-১৫০ টাকা আর মহিলারা সিঙ্গা লাগিয়ে ৫০-১০০ টাকা আয় করে। এই রোজগার দিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকতে তাদের চরম হিমশিম খেতে হয়।
বেদে পাড়ার বাসিন্দা মানিক মিয়া (৭০) তাদের পেশার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বলেন, আামরা বর্তামানে চাই আমাদের সন্তানেরা স্কুল কলেজে লেখাপড়া করুক, কারন আজকের যুগে এই পেশাকে সবাই তুচ্ছ তাচিছল্য করে।
দশ বছর ধরে এখানকার ছেলে মেয়েরা পড়ালেখা করছে। কিন্তু এসএসসি ও এইচএসসি পাশ করার পর তারা যখন চাকরি পায়না তখন অন্যরাও পড়ালেখার ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। নান্টু নামের এক ছেলে জানায়, পড়ালেখা করে কি হবে পড়ালেখা করলে চাকরিও জুটেনা আবার পূর্বপুরুষদের পেশায় ও যাওয়া যায়না।
কোন প্রকার সরকারী বেসরকারী সহযোগিতা না পেলেও সামাজিকভাবে তারা খুবই সংগঠিত। নিজেদের মধ্যে কোন সমস্যা হলে তারা নিজেরাই এর সমাধান করে থাকেন। তারা দুটি সমিতি করেছে যার মাধ্যমে তারা সঞ্চয় করে সংগঠিত হচেছ।
বেদে পাড়ার সর্দার জানান, বিভিন্ন এনজিও সংস্থা দরিদ্র এলাকায় কাজ করলেও বেদে পাড়ায় কোন এনজিও সহায়তা করছেনা। তিনি স্যানিটেশন,শিক্ষা , এবং জীবনমান উন্নয়নে কাজ করতে এগিয়ে আসা প্রয়োজন কলে জানান।
উপজেলার ৩ নম্বর জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মকছুদ আহমদ জানান, বেদে পাড়ার লোকজন ভিন্ন সম্প্রদায়ের বলে এদের আলাদা করে দেখার কোন সুযোগ নেই। এদের নির্দিষ্ট কোন পেশা নেই। এদের প্রতি যেন বৈষম্যমূলক আচরন করা না হয়।
সম্পাদনা: আরএইচ/এমইউ