একুশে পদক বিজয়ী নাট্যচার্য্য সেলিম আল দীন ভাইয়ের বাল্যবন্ধু ছিলেন মাহবুব আলতমাস। তিনি মাহবুব ভাইকে খোকা কাকা বলেই ডাকতেন। প্রায় দুইদশক আগে সেলিম ভাই একদিন পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, খোকা কাকা এখন ফেনীতেই স্থিতু হবেন, তার লেখা-লেখির প্রচুর শখ। তোর সঙ্গে মনে হয় পরিচয় নেই। আমি বললাম, পরিচয় আছে, তবে ঘনিষ্ঠতা নেই। এই কথার পর সেলিম ভাই বললেন, আমি চাই তোদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতাও হোক, আশাকরি তোরা ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবি। তারপর বয়সের ব্যবধান ভুলে এক সঙ্গে অযুত কাজ করেছি…, ঘন্টার পর-ঘন্টা পার করেছি আড্ডায়… বিভিন্ন সংগঠন করতে এবং লেখা-লেখি করতে গিয়ে মান-অভিমানে জড়িয়েছি বার কয়েক। একাধিকবার সেলিম ভাই মিলিয়েও দিয়েছিলেন… একবার বলেছিলেন- ‘জানিস না, খোকা’রাতো শিশু হয়, শিশুদের সঙ্গে অভিমান করা কি সাজে?’ আমি অভিমান ভুলে ‘বুড়োখোকা’ ডেকেই হাসতে-হাসতে আবার এক সঙ্গে চলা-ফেরা শুরু করতাম…
আমার মনে আছে, তখন আমি ঢাকায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছি, মাহবুব ভাই ফেনীতে ‘সু-শাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর জেলা কমিটি করবেন। তিনিও নাছোড় বান্ধা, আমাকে তার সঙ্গে কমিটিতে সদস্য সচিব করবেনই করবেন। পরে তিনি আহ্বায়ক হয়ে আমাকে সদস্য সচিব করে কমিটি করলেন, ব্যস্ততার কারণে দু’তিনটের বেশি মিটিংয়ের থাকতে পারিনি…।
সেবার, মাঘ মাসের প্রচন্ড শীতে সেলিম আল দীন ভাই ফেনী এসেছিলেন আমার অনুজ কাজি ফয়সলের বিয়ের অনুষ্ঠানে। এসেই বললেন, দু’দিন আগেই চলে এলাম, তুইতো ব্যস্ত বিয়ে নিয়ে, আমি খোকা কাকুকে নিয়ে আমার গ্রামে চলে যাই, অনুষ্ঠানের আগে-আগে চলে আসবো। তারপর তিনি বাড়ি গিয়েই মধ্যরাতে জাল নিয়ে নাকি পানিতে নেমেছেন…! মাহবুব ভাই শতবার বাধা দিলেও তিনি শুনেননি, পরে মাহবুবভাই আমাকে ফোন দিলেন, আমি চিল্লা-চিল্লি করার পর সেলিম ভাই আমাকে বললেন, আমি এই গ্রামের ছেলে আমার কিচ্ছু হবে না… তারপরও আমার কড়া মেজাজ দেখে তিনি বললেন ঠিক আছেরে বাপ উঠছি।
তারপর প্রায় সপ্তাহখানেক পরেই একুশে পদক বিজয়ী নাট্যচার্য্য সেলিম আল দীন ভাই হঠাৎ করেই না ফেরার দেশে চলে গিয়ে আমাদেরকে কেমন যেনো একটু অসহায়ত্বের দিকেই ঠেলে দিয়েছিলেন..।
এক.
ততদিনে মাহবুব আলতমাস ফেনীর স্থানীয় পত্রিকাগুলোতে তার সাম্রাজ্য বিস্তার করে ফেলেছেন। ছোট-বড় নানান সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন অক্টোপাসের মতো…।
একদিন ঢাকায় এলেন, বললেন- বড় কাগজে লিখতে চাই, কি করি বলতো? আমি বললাম- কবি শামসুল ইসলামতো আমাদের পত্রিকার ফিচার ও সাহিত্য সম্পাদক, তিনিই আমাকে এই পত্রিকায় নিয়ে এসেছেন, আপনি চলুন কবি শামসুল ইসলামের সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দেই। যেই বলা সেই কাজ, তারপর অনেক ইতিহাস… অনেক স্মৃতি… সপ্তাহান্তে মাহবুব ভাইকে ঢাকায় আসতে হতো…।
সেবার, কবি শামসুল ইসলাম কিছুতেই বাংলা একাডেমির পুরষ্কারের আবেদনপত্র আনতে যাবেন না! আমি আর কবি প্রত্যয় জসিম বার-বার বোঝানোর পরও তিনি রাজি হচ্ছিলেন না, কবি শামসুল ইসলামের ধারণা রাজনৈতিক দলের সমর্থিত ছাড়া অন্য কেউ এই পুরষ্কার পায় না, এমন সময় মাহবুব ভাইকে বিষয়টি বললাম- মাহবুব ভাই কবি শামসুল ইসলামকে বললেন, এখনতো অরাজনৈতিক সরকার (তখন দেশে ওয়ান ইলিভেন-এর সরকার), এখনই আপনার উপযুক্ত সময়…। তখন আমি, প্রত্যয় জসিম আর মাহবুব ভাই গিয়ে বাংলা একাডেমি থেকে আবেদনপত্র এনে তাঁকে দিলাম। সত্যি-সত্যি কবি শামসুল ইসলাম বাংলা একাডেমি পদক পেয়ে গেলেন! মাহবুব আলতমাস ভাইয়ের সঙ্গে কবির ঘনিষ্ঠতা আরো বেড়ে গেলো। কিন্তু, নিয়তির খেলায় সেটা বেশিদিন স্থায়ী হলো না!
মাহবুব ভাই, তাজিম ভাই, নান্টু ভাই, নাসির ভাইয়েরা একুশে পদক বিজয়ী নাট্যচার্য্য সেলিম আল দীনের সঙ্গে বাংলা একাডেমি পদক বিজয়ী কবি শামসুল ইসলামকেও ফেনীতে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের পরদিনই কবি শামসুল ইসলাম ঢাকায় ইন্তেকাল করেছিলেন। আমি যেনো অভিভাবক হারিয়ে এলো-মেলো হয়ে গেলাম, আর মাহবুব ভাই নিজেকে কক্ষপথ হারানো তাঁরার মতো ভাবতে লাগলেন…!
দুই.
ফেনীর সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রিয়মুখ সদা হাস্যোজ্জল কবি ও মুক্তমনা লেখক মাহবুব আলতমাস ছিলেন সু-শাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর ফেনী জেলা শাখা, ফেনী পোয়েট সোসাইটি ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ফেনী জেলা শাখার সভাপতি ।
তার প্রকাশিত গ্রন্থ প্রজাপতি রঙ্গিন দিন (উপন্যাস), শালফুলি বৃষ্টি (ত্রয়ী কবিতাপত্র), দক্ষিণে বন্দনা করি বঙ্গমা সাগর (কবিতা), অন্তরাল (উপন্যাস), দশ আঙুলে কবিতা (কবিতা), মলিবুর স্বপ্নের ঠিকানা (ছোটগল্প), জনকের প্রতিকৃতি ও আমার কবিতা (কবিতা), সেদিনে পৌঁছতে চাই (কবিতা)।
মাহবুব আলতমাস ইদানিং রাজধানীর উত্তরার বাসিন্ধা…। রাজধানীবাসী হবার পর আমার সংশ্লিষ্ট প্রায় সব অনুষ্ঠানেই তিনি আসতেন। সম্প্রতিককালে শোকাহত-অসুস্থতার কারণে তেমন একটা আসতেন না। এইতো প্রায় মাসখানেক আগে একটি ইফতার মাহফিলে যানজটের ভয়ে আসতে না পেরে দূঃখ প্রকাশ করলেন। বললেন, মনটা তোমাদের মাঝেই পড়ে আছেরে…।
এর আগেরবার ফেনী সাংবাদিক ফোরাম ঢাকার ইফতার মাহফিলে এসেছিলেন অনেকগুলো কলম(বলপেন) নিয়ে গিফট করতে, বললেন, সাংবাদিকদের অনুষ্ঠানে কলমইতো মানায়…।
আজ (২৭ জুলাই, শুক্রবার) সকাল থেকেই আমার শরীর মন দু’টোই যেনো কেমন খারাপ যাচ্ছিলো, ঘরে আবার স্ত্রী-সন্তানও জ্বরে আক্রান্ত। এমন সময় আচানক খবর পেলাম প্রিয় স্বজন ‘আমার বুড়োখোকা’ মাহবুব আলতমাস(৭৬) সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন! রাজধানীর উত্তরা নিজ বাসায় দুপুর সাড়ে ১২ টার দিকে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেছেন। ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন। তিনি স্ত্রী, তিন মেয়ে, নাতি-নাতনি সহ বহু গুণগ্রাহি রেখে গেছেন।
হে বুড়োখোকা, আপনার মৃত্যুতে আমি বিশেষভাবে শোকাহত…! পরপারে ভাল থাকুন, মহান আল্লাহর দরবারে এই প্রার্থনা আমার।
লেখক : সাংবাদিক ও সংগঠক