মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রান্না করা, তাঁদের অস্ত্র লুকিয়ে রাখা, পাকিস্তানি বাহিনীর খবর সংগ্রহ করা এবং সম্মুখযুদ্ধে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে লড়াই করেছিলেন তিনি। দুর্ধর্ষ সেই কিশোরীর অসীম সাহসিকতার জন্য বীর প্রতীক খেতাব দেওয়া হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর হাতে তা তুলে দিতে ২২ বছর লেগে যায়। নিভৃতে জীবন যাপন করা এই সাহসী নারীকে খুঁজে পেতেই কেটে গিয়েছিল এতটা সময়। সেই বীর প্রতীক তারামন বিবি (৬২) আর নেই। চলে গেছেন লোকচক্ষুর অন্তরালে।
অনেক দিন ধরে শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে ভুগে গতকাল শুক্রবার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে কুড়িগ্রামের রাজিবপুর উপজেলা সদরে নিজ বাসায় মারা যান তারামন বিবি (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। আজ শনিবার বাদ জোহর জানাজা শেষে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে।মৃত্যুর সময় তারামন বিবি স্বামী আবদুল মজিদ, ছেলে আবু তাহের, মেয়ে মাজেদা খাতুনসহ পরিবারের সদস্যদের রেখে গেছেন। তাঁর ছেলেমেয়ে দুজনই বিবাহিত।
কুড়িগ্রামের রাজিবপুর উপজেলার কোদালকাঠি ইউনিয়নের কাছারিপাড়ার শংকর মাধবপুর গ্রামে তারামন বিবির জন্ম। শংকর মাধবপুরে ১১ নম্বর সেক্টরে কিশোর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ সরকার তারামন বিবিকে বীর প্রতীক খেতাব দেয়। কিন্তু এই মুক্তিযোদ্ধাকে খুঁজে বের করা সম্ভব হয় ১৯৯৫ সালে। ওই বছরের ১৯ ডিসেম্বর সরকারের পক্ষ থেকে তারামন বিবির হাতে সম্মাননা তুলে দেওয়া হয়।পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, গতকাল রাত একটার দিকে তারামন বিবি অসুস্থ হয়ে পড়লে রাজিবপুর উপজেলার স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. দেলোয়ার হোসেন তাঁর বাড়িতে আসেন। রাত দেড়টার দিকে তিনি তারামন বিবিকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।
শ্রাবণ ভাদ্র দিনের কথা। মুহিফ হালদারের সাথে তারামন আসলেন দশগরিয়াতে। এখানে আবার অন্য জীবন তার। এই প্রথম অস্ত্র চালানো শিখলেন। স্টেনগান কি করে চালাতে হয় বুঝলেন। একদিন খুব বৃস্টি হচ্ছে। আজকাল প্রায়ই হয় এমন ঝুম বৃস্টি। দুপুরের দিকে সবাই ভাত খাচ্ছে এমন বর্ষণমুখর মধ্যাহ্নে। আজিজ মাস্টার কোত্থেকে এসে বললেন তারামন গাছে উঠ। তারামন সুপারি গাছে ভালো চড়তে পারতেন। এই চিকণ গাছটি বৃস্টির কারণে এমনিতে পিচ্ছিল হয়ে আছে। তবুও তারামন উঠলেন। কি সর্বনাশ! মিলিটারিরা নদীতে গানবোট নামিয়ে দিয়েছে। তার মানে তারা আক্রমণ করতে চায়। তারামনের বুদ্ধিমত্তায় দূরবীন দিয়ে তাদের দেখতে পাওয়ার খবরে মুক্তিযোদ্ধারা ভাত খাওয়া বন্ধ করে পজিশন নিলো। সতর্ক অবস্থা। শুরু হলো গোলাগুলি। তুমুল গোলাগুলি। সন্ধ্যা পর্যন্ত চললো। তারামনের সেদিন কি হয়েছে সে জানে না। ঘোরগ্রস্ত অবস্থায় কখন যে সে হাতে অস্ত্র তুলে নিলো টেরই পেলো না। হঠাৎ সে বুঝতে পারলো তার গুলি শত্রুর পাষাণ বুকে বিদ্ধ হয়েছে। তার মনে হলো এতদিন এমন সময়েরই অপেক্ষায় ছিলো তার অবচেতন মন। সেসময়ের অনুভূতির সাথে আর কোনো অনুভূতির জোড়া হয় না। এই দেশ, মা, মাটি সব যেনো তার,একান্ত তার।
এরপর কতবার স্টেনগান চালিয়েছেন, কতবার তার কনুই ছিলে রক্ত বেরিয়েছে, পায়ের পাতায় ঘা হয়েছে সে হিসাব নেই। ব্যাথাগুলো তাকে ব্যাথা দেয়নি। যত ব্যাথা ততই বুঝেছেন স্বাধীনতা নিকটে। ততই স্বপ্ন প্রগাঢ় হয়েছে তার, স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলেন একটা স্বাধীন ভূমি। . তারামনের স্বপ্ন সত্যি হয়েছিলো। যুদ্ধ শেষ হয়। দেশটা স্বাধীন হয়। কিন্তু অনেকদিন পর তারামনের খোজ মেলে না। যেনো হাওয়া হয়ে গিয়েছেন এক প্রকার! তিনি ছিলেন প্রচন্ড কষ্টেসৃষ্টে। তাদের বোনদের বিয়ে হচ্ছিলো না। মানুষ বলে ক্যাম্পে থাকা মাইয়া, ভালা না”। তারউপর নাই থাকার জায়গা, নাই খাবার দাবার। আবদুল মজিদ নামে এক সহজ সরল মানুষ তাকে বিয়ে করেন। রাজীবপুরের এক চরে তাদের জীবন শুরু হয়। কি এক জীবন, চরের মতোই ভাংগা জীবন। চর ভাঙে, তাদের ঘর ভাঙে। নতুন করে আবার ঘর বাধতে হয়। আবার ভাঙে চর,আবার ভাঙে ঘর। এভাবে চব্বিশ বছর কেটে গেলো।
১৯৯৫ সালে ময়মনসিংহের এক গবেষক তাকে খুঁজে পান। সেবছর তাকে স্বাধীনতা যুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বীরত্বের পুরস্কার দেয়া হয়। বাংলাদেশে দুইজন মাত্র খেতাবধারী নারী মুক্তিযোদ্ধা আছেন। তারামন বিবি একমাত্র নারী যিনি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছিলেন। সম্মুখ যুদ্ধে সবার মতো অংশ নিয়েছিলেন। এজন্যে তারামন বিবিকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়।তবে তারামনদের কেউ মনে রাখেনি। নারী বলেই কি না কে জানে, অবহেলায় অবহেলায় এতো বেলা পার করে দিলেন তারামন। তবুও তারামন নামের এক পাগলি, স্বপ্নালু, চঞ্চল, সাহসী মেয়ের গল্প আমাদের মনে থাকবে। ধন্যবাদ তারামন বুবু, তুমি সত্য, তুমি সুন্দর, তুমি আমার সাহস
সম্পাদনা:আরএইচ/এইচআর