পাহাড় বোবা হলেও কাঁদতে পারে । তার বুকে জমে থাকা শত সহস্র বেদনাগুলো কান্না হয়ে ঝরে । সেই পাহাড়ের কান্নাকেই আমরা ঝর্ণা বলি। বর্ষায় তার যৌবন জেগে উঠে নাকি বিরহ বাড়ে সেই ব্যাপারে আমি সন্দিহান । শুকনো মৌসুমে অধিকাংশ ঝর্ণাতে পানি থাকেনা । তার আসল রূপ হলো পানি। পানি ছাড়া ঝর্ণা সুর ছাড়া গানের মতই মূল্যহীন। বর্ষায় পানিতে থই থই করে ঝর্ণাগুলো । যেন উতলে উঠে তার ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা সুপ্ত যৌবন। মানুষের যৌবন উত্তাপ ছড়ালেও তার যৌবন শীতলতা ছড়ায় । আমাদের যান্ত্রিক জীবনের অস্থিরতা দূর করে জীবনকে শীতল করতে ঝর্ণার পানি মহা ঔষধ বলা যায়।

সহস্রধারা-২ ঝর্ণা
করোনা মহামারির জন্য অনেকদিন ঘরে বসে থাকতে থাকতে জীবন যেন থমকে গেছে । নতুন করে নিজেকে জাগিয়ে তোলার জন্য কোথাও ভ্রমন করা অত্যাবশ্যকীয় হয়ে উঠেছিলো। তাই বিভাগের সিনিয়র-জুনিয়ররা মিলে ছুটে গেলাম ছোট্র দারোগার হাট সহস্রধারা-২ ঝর্ণা ও গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত দেখতে। নির্দিষ্ট দিনে সকাল ৯টায় বাস ছাড়লো ফেনী কলেজের সামনে থেকে। আমাদের মিনি বাস ছোট দারোগার হাট বাজার পর্যন্ত গিয়ে থামে । সেখান থেকে ঝর্ণা আরো ৫কি.মি.। সিএনজিতে ২০ টাকা ভাড়া। আমরা হেটেই চললাম। যেতে যেতে পথের দুপাশে ঢেঢষ,বরবটি, শিম, লাউ, পানের বরজ দেখে টাটকা সবজি দিয়ে ভাত খাওয়ার খুব ইচ্ছে জেগে ছিলো।
কিছুক্ষন হাটার পর পাকা এবং ইটের রাস্তা পেরিয়ে আমরা পাহাড়ী কাদাঁমাখা রাস্তায় পা দিলাম । বর্ষা মৌসুমে পর্যটকের আগমন বেশি বলে রাস্তার অবস্থা খুবই নাজুক ছিলো। আমরা নিজের শরীর নিয়ে হাটতে কষ্ট হলেও পাহাড়ী বাসিন্দারা কাধেঁ বোঝা নিয়ে অবলিলায় হেটে যাচ্ছে। কাদা রাস্তায় ২০- মিনিট হাটার পর একটা লেকের কাছে পৌছালাম। অনেকগুলো সিড়ি বেয়ে উঠে লেকের পরিবেশ দেখে মুগ্ধ হলাম। বাঁধ দিয়ে ঝর্ণার পানি আটকে রেখে কৃত্রিমভাবে এই লেক তৈরী করা হয়। বর্ষায় লেকের পানি বৃদ্ধি পেলে নিষ্কাষনের জন্য একটা ইজেক্ট নির্মাণ করা হয়। পানি গড়িয়ে নামার জন্য ইট-পাথরের কংক্রিট দিয়ে যে নালাটি তৈরী করা হয় সেটি বেশ দৃষ্টি নন্দন। পর্যটকরা এসেই প্রথমে সেখানে নামে। ঠান্ডা পানিতে গা ভিজিয়ে, সিড়ির মত বসায় জায়গায় বসে ছবি তুলে। আমরাও ব্যাস্ত হয়ে গেলাম মজা নিতে।
সবাই যখন ইজেক্টে সময় কাটাচ্ছে আমি তখন মাঝির সাথে কথা বলতে গেলাম। মনে প্রশ্ন জাগতে পারে মাঝি কেন আবার? লেক পার হয়ে ঝর্ণা পর্যন্ত পৌছাতে নৌকায় চড়তে হয় অবশ্য পাহাড়ি পথ ও আছে। প্লাস্টিকের নৌকায় চড়ে ঝর্ণায় যেতে ১০ মিনিট লাগে। কিন্তু সমস্যা হলো আমরা মানুষ ৩৪ জন নৌকা মাত্র একটা। এরমধ্য আমাদের আগে অনেকেই সিরিয়াল দিয়ে রেখেছে তাই নৌকার জন্য অপেক্ষা করতে গেলে আমিাদের অনেক সময় নষ্ট হবে। তাই আমরা পাহাড়ী দুর্গম পথে হাটা দিলাম। উঁচু, নিচু, কাদায় ভরা পিচ্ছিল পথ পেরিয়ে ১৫ মিনিট পর আমরা ঝর্ণার কাছাকাছি পৌছাই। সেখান থেকে রূপবতী সহস্রধারার রূপের সুধা অবলোকন করছি। কিন্তু বাধ সাধলো একটা পাহাড়ি নালা । এই নালা পার হতে হলে কোমর পর্যন্ত ভিজতে হয়। আমাদের মধ্য একদল সেই কারনে আবার লেকের দিকে ফিরে ঘেছে। আমরা নেমে পড়লাম পানিতে নেমে দেখি হাটু পর্যন্ত পা গেথে গেছে। তখন ভাবেতেছি অপেক্ষা করে নৌকায় করে আসলেই ভালো হতো। যাক অবশেষে কোমর ডুবিয়ে হলেও গন্তব্য পৌছাতে পেরেছি।

দূর থেকে ঝর্ণার রূপ, ঝর্ণার পাশে ধ্যানে বসেছে লেখক
দূর থেকে দেখেছিলাম কালো পাহাড়ে সবুজের বুক চিরে বয়ে যাওয়া ঝর্ণার ধারা। এখন সেই ঝর্ণার পাদদেশে এসে চিৎকার করতে মন চাইছে । মন খুলে বলতে ইচ্ছা করছে ‘আইএম দ্যা কিং অব ওয়াল্ড’। এটা প্রকৃতির এক কঠিন শক্তি মানুষকে জাগাতে পারে। মানুষের ভেতরটাকে আলোড়িত করতে পারে। একপাশে জুতোজোড়া কোনমতে রেখে নেমে পড়লাম ঝর্ণার জলধারায় সিক্ত হতে। উপর থেকে পানি পড়ে ঝর্নার পাদদেশে একটা খাদের সৃষ্টি হয়েছে। কোমর সমান পানিতে বালি আর নুড়ি পাথরে ভরা। ঝর্ণা ধারার নিচে মিনিটখানেকের বেশি দাড়াতে পারিনি। পানির চাপে মনে হচ্ছে যেন শরীর ছিদ্র হয়ে যাবে। পর্যটক বেশি হওয়ার ফলে নিজের ইচ্ছামত ছবি তুলা গেলনা তার উপর জুনিয়রগুলার উৎপাত । ক্যামেরাটা তাক করানোর দেরী সবগুলা ফ্রেমের মধ্য মাথা ডুকিয়ে দিবে। বেশ কিছুক্ষন ঝর্ণার পুকুরে জলকেলি আর ছবি তোলার পালা শেষ করে সময় হয়েছে বিদায় নেয়ার । কিন্তু কে শুনে কার কথা সবাই তখনো দুষ্টামিতেই ব্যাস্ত । ফরহাদ ভাইতো রীতিমত সবাইকে উঠানোর জন্য লাঠিপেটা শুরু করেছে।

ইজেক্টের সেতুতে দাড়িয়ে ছবি তুলেছেন , লেকের পাড়ে উঠার সিড়ি
যাক অবশেষে লাঠিপেটা খেয়ে হলেও ফেরার পথ ধরলো। আবরো সেই কষ্টকর পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে এসে ছেলেরা ঝাপ দিলো লেকের পানিতে। লেকে একটা পাকা ঘাটও ছিলো তবে পানি বেশ ঘোলা ছিলো। গোসল করতে নেমে আবার ফিরে গেলাম দুরন্ত শৈশবে । কেউ একজন বলে উঠলো আমাদের ফেনীর আঞ্চলিক ভাষায়- ‘এতড়া ইগ্গা কিয়া’, অন্যরা উত্তর দিলো ‘হাইল্লা’ আবার সে বললো ‘জাইল্যা কন? তুই। শুরু হয়ে গেলো খেলা। যে জাইল্যা মানে জেলে সে আরেকজনকে ধরবে যাকে ধরবে সে যার নাম বলবে ও আবার জাইল্যা হবে। খেলা শেষে গোসল সেরে আবার ইজেক্টের পানিতে নামি, ছবি তুলি । কিন্তু বড়ভাইর বকার জন্য বেশিক্ষন পানিতে সময় কাটানো হলোনা। উঠে আবার রওনা দিলাম সীতাকুন্ড বাজারের পথে হোটেলে খাবার খেয়ে সিএনজি যোগে রওনা দিলাম পরবর্তী গন্তব্য গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত।
সম্পাদনা:আরএইচ/এইচআর







