সোলায়মান হাজারী ডালিম>>
রমজানুল মোবারক মুসলিম উম্মাহর অন্যতম প্রধান ধর্মীয় ও জাতীয় উৎসব ঈদুল ফিতরের দিনটি অশেষ তাৎপর্য ও মহিমায় অনন্য। মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার শেষে শাওয়ালের বাঁকা চাঁদ নিয়ে আসে পরম আনন্দ ও খুশির ঈদ। রোজাদার যে পরিচ্ছন্নতার ও পবিত্রতার সৌকর্য দ্বারা অভিষিক্ত হন, যে আত্মশুদ্ধি, সংযম, ত্যাগ-তিতিক্ষা, উদারতা, বদান্যতা, মহানুভবতা ও মানবতার গুণাবলি দ্বারা উদ্ভাসিত হন, এর গতিধারার প্রবাহ অক্ষুণ রাখার শপথ গ্রহণের দিন হিসেবে ঈদুল ফিতর সমাগত হয়।
এদিন যে আনন্দধারা প্রবাহিত হয়, তা অফুরন্ত পুণ্য দ্বারা পরিপূর্ণ। নতুন চাঁদ দেখা মাত্র রেডিও-টেলিভিশন ও পাড়া-মহল্লার মসজিদের মাইকে ঘোষিত হয় খুশির বার্তার‘ঈদ মোবারক’। সেই সঙ্গে চারদিকে শোনা যায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত রোজার ঈদের গান: ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ/ তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আস্মানী তাগিদ/…’
ঈদ মানেই আনন্দ ও খুশির উৎসব। ‘ঈদ’ শব্দটি আরবি, শব্দমূল ‘আউদ’, এর অর্থ এমন উৎসব, যা ফিরে ফিরে আসে, পুনরায় অনুষ্ঠিত হয়, রীতি হিসেবে গণ্য হয় প্রভৃতি। এর অন্য অর্থ খুশি-আনন্দ। উচ্ছল-উচ্ছ্বাসে হারিয়ে যাওয়ার মুহূর্ত। ঈদ প্রতিবছর চান্দ্র বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী নির্দিষ্ট মাসের নির্দিষ্ট তারিখে নির্দিষ্ট রীতিতে এক অনন্য আনন্দ-বৈভব বিলাতে ফিরে আসে।
এক মাস কঠোর সিয়াম সাধনার মাধ্যমে নানা নিয়ম কানুন পালনের পর উদ্যাপিত হয় ঈদুল ফিতর; অন্য কথায় রোজার ঈদ। ‘ফিতর’ শব্দের অর্থ ভেঙে দেওয়া। আরেক অর্থে বিজয়। দীর্ঘ এক মাস রোজা রাখার পর যে উৎসব উদ্যাপন করা হয়, তা-ই ঈদুল ফিতরের উৎসব। বিজয় শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহূত হয়েছে। গোটা রমজান মাস রোজা রেখে আল্লাহভীরু মানুষ তাঁর ভেতরের সব রকমের বদভ্যাস ও খেয়াল খুশিকে দমন করার মাধ্যমে একরকমের বিজয় অর্জন করেন। সেই অর্থে এটি বিজয় হিসেবেও দেখা যায়। সব মিলিয়ে ঈদুল ফিতরকে বিজয় উৎসব বলা যেতে পারে। ঈদুল ফিতরের প্রতিটি অনুশাসনে ইবাদতের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। তা ছাড়া এদিন প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে সত্যনিষ্ঠ জীবনযাপনের তাগিদ এবং মানবতার বিজয় বার্তা।
তবে প্রচলিত নিয়মে দীর্ঘ এক মাস রোজা রাখার পর আনন্দ-উৎসবের মাধ্যমে দিনটিকে স্মরণীয় করার নাম ঈদ উৎসব। ‘ঈদুল ফিতর’ শব্দ দুটিও আরবি, যার অর্থ হচ্ছে উৎসব, আনন্দ, খুশি, রোজা ভঙ্গকরণ ইত্যাদি। সুদীর্ঘ একটি মাস কঠোর সিয়াম সাধনা ও ইবাদত-বন্দেগির পর বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ রোজা ভঙ্গ করে আল্লাহর বিশেষ নিয়ামতের শুকরিয়া স্বরূপ যে আনন্দ-উৎসব পালন করেন, সেটিই ঈদুল ফিতর।
সারা বিশ্বের মুসলমানের সর্বজনীন আনন্দ-উৎসব ঈদুল ফিতর। বছর জুড়ে নানা প্রতিকূলতা, দুঃখ-বেদনা সব ভুলে ঈদের দিন মানুষ সবার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিলিত হন। ঈদগাহে কোলাকুলি সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও ভালোবাসার বন্ধনে সবাইকে নতুন করে আবদ্ধ করে। ঈদ এমন এক নির্মল আনন্দের আয়োজন, যেখানে মানুষ আত্মশুদ্ধির আনন্দে পরস্পরের মেলবন্ধনে ঐক্যবদ্ধ হন এবং আনন্দ সমভাগাভাগি করেন। মাহে রমজানের এক মাসের সিয়াম সাধনার মাধ্যমে নিজেদের অতীত জীবনের সব পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত হতে পারার পবিত্র অনুভূতি ধারণ করেই পরিপূর্ণতা লাভ করে ঈদের খুশি। আর আনন্দ ও পুণ্যের অনুভূতিই জগতে এমন এক দুর্লভ জিনিস, যা ভাগাভাগি করলে ক্রমেই তা বৃদ্ধি পায়। ঈদুল ফিতর বা রোজা ভাঙার আনন্দ-উৎসব এমন এক পরিচ্ছন্ন আনন্দ অনুভূতি জাগ্রত করে, যা মানবিক মূল্যবোধ সমুন্নত করে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের পথপরিক্রমায় চলতে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের উদ্বুদ্ধ করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) সানন্দে ঘোষণা করেছেন, ‘প্রত্যেক জাতিরই নিজস্ব আনন্দ-উৎসব রয়েছ, আমাদের আনন্দ-উৎসব হচ্ছে এই ঈদ।’ (বুখারী ও মুসলিম) ।
ঈদ ধনী-গরিব সব মানুষের মহামিলনের বার্তা বহন করে। ঈদের দিন ধনী-গরিব, বাদশা-ফকির, মালিক-শ্রমিকনির্বিশেষে সব মুসলমান এক কাতারে ঈদের দুই রাকাত ওয়জিব আদায় এবং একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি করে সাম্যের জয় ধ্বনি করেন। রমজান মাসে সংযম ও আত্মশুদ্ধি অনুশীলনের পর ঈদুল ফিতর ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সব শ্রেণীর মানুষকে আরও ঘনিষ্ঠ বন্ধনে আবদ্ধ করে, গড়ে ওঠে সবার মধ্যে সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য ও ঐক্যের বন্ধন। ঈদের দিন মসজিদে, ময়দানে ঈদের নামাজে বিপুলসংখ্যক ধর্মপ্রাণ মুসল্লির সমাগম হয়েছে থাকে। সবাই সুশৃঙ্খলভাবে কাতারবদ্ধ হয়ে ঈদের নামাজ পডেন। নামাজ শেষে ধনী-নির্ধন, পরিচিত-অপরিচিত সবাই সানন্দে কোলাকুলি করেন। রাজধানীতে জাতীয় ঈদগাহ ময়দান, বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদসহ দেশের সব ঈদগাহ ও মসজিদে ঈদের জামাতে পার্থিব সুখ-শান্তি, স্বস্তি আর পারলৌকিক মুক্তি কামনা করে আল্লাহর দরবারে বিশেষ মোনাজাত করা হয়। সেই সঙ্গে বিশ্বশান্তি এবং দেশ-জাতি ও মুসলিম উম্মাহর উত্তরোত্তর শান্তি, সমৃদ্ধি, অগ্রগতি ও সংহতি কামনা করা হয়।
প্রকৃতপক্ষে ঈদ ধনী-দরিদ্র, সুখী-অসুখী, আবাল বৃদ্ধবনিতা সব মানুষের জন্য কোনো না কোনোভাবে নিয়ে আসে নির্মল আনন্দের আয়োজন। ঈদ ধর্মীয় বিধিবিধানের মাধ্যমে সর্বস্তরের মানুষকে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াসে নেয় এবং পরস্পরের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের শিক্ষা দেয়। মহান সৃষ্টিকর্তার দরবারে আমাদের মনোবাক্যে প্রার্থনা হলো জগতের সব মানুষের সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি। পৃথিবী সর্বপ্রকার হিংসা-বিদ্বেষ ও হানাহানিমুক্ত হোক! সন্ত্রাসের বিভীষিকা দূর হোক! আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি ও সৌহাদের বন্ধন দৃড়তর হোক! আগামী দিনগুলো সুন্দর ও সৌন্দর্যমন্ডিত হোক! হাসি-খুশি ও ঈদের আনন্দে ভরে উঠুক প্রতিটি প্রাণ। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সংযম, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির পরিবেশ পরিব্যাপ্তি লাভ করুক এটাই হোক ঈদ উৎসবের ঐকান্তিক কামনা। তাই আসুন, ঈদের আনন্দ ছড়িয়েছে দিই সবার প্রাণে-মনে। বুকে বুক মিলিয়ে আসুন সবাই সবার হয়ে যাই। সবাইকে পবিত্র ঈদুল ফিতরের প্রাণঢালা শুভেচ্ছা ও আন্তরিক অভিনন্দন—‘ঈদ মোবারক আসসালাম!’
ঈদ :সামাজিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব
প্রতিবছরই ঈদ আসে। ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে আনন্দ। শৈশবের ঈদ উদযাপনে এ আপ্তবাক্যটির বিপরীতে ভিন্ন কিছু ভাবার কোনরূপ সুযোগই ছিল না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আনন্দের পাশাপাশি শঙ্কা, বিড়ম্বনা সমানভাবে অবস্থান করলেও ঈদ উদযাপনে নানাজনের নানাবিধ পরিকল্পনার ঘাটতি লক্ষ্য করা যায় না। ঈদ উদযাপন করার জন্য অনেকে দেশের বাইরে যান, অনেকে দেশের ভিতরে ‘দ্যাশে’ (গ্রামের বাড়ি/ দেশের বাড়ি) যান। ‘দ্যাশে’ যাওয়া মানুষের সংখ্যাই বেশি। ঢাকায় বসবাসকারী মানুষের সিংহভাগই ঈদের সময় গ্রামের বাড়ি যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়েন। বাস, ট্রেন, লঞ্চ কোথাও তিল ধারণের জায়গা থাকে না। এমনকি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও বাস, লঞ্চ বা ট্রেনের ছাদে করে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ঈদের আনন্দে শামিল হওয়ার এই যজ্ঞে আইন-কানুন, বিধি-নিষেধ সবই যেন নস্যি। যারা গ্রামের বাড়িতে শত চেষ্টা করেও যেতে পারেন না, তারা বাধ্য হয়ে দেশে (ঢাকা) পড়ে থাকেন। ঈদ আসলেই পত্রিকায় ‘নাড়ীর টানে বাড়ি ফেরা’ অথবা ‘সবার সঙ্গে ঈদ উদযাপনে গ্রামে যাত্রা’ সংক্রান্ত বড় বড় শিরোনাম দেখা যায়। মানুষের যাত্রা নির্বিঘ্ন করতে হিমশিম খেতে হয় পুলিশসহ সংশি¬ষ্ট প্রশাসনকে। কিন্তু কেন এমন হয় ? কেন মানুষ তার স্বপ্নের শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়িতেই যেতে চায় ? ঢাকা কি তাহলে তাদের জীবনধারণের ন্যূনতম সংস্থান কিছুটা নিশ্চিত করতে পারলেও আত্মিক সমপর্কের বিষয়টিতে একেবারেই উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছে ? অথবা মানুষ কেন ঢাকাকে নিজের মনে করতে পারছে না ? উপরোক্ত জিজ্ঞাসার একটিরও উত্তর সমপর্কে যদি নিশ্চিত হওয়া যেতো তাহলে অন্তত ঈদকেন্দ্রিক অনেক বিড়ম্বনা এড়ানো যেতো।
ঈদ সাম্য, ত্যাগ, ভ্রাতৃত্ববোধ, আত্মশুদ্ধির বিষয় হিসেবে পরিগণিত হলেও অনেকে এটাকে অতি মুনাফা অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। ঈদ উত্সবকে কেন্দ্র করে মানুষের চাহিদা স্বাভাবিকের তুলনায় বৃদ্ধি পায়। উদ্যোক্তা কিংবা ব্যবসায়ীরা সেভাবেই তাদের পণ্য উত্পাদন, আমদানি ও কেনাবেচা করেন। কিন্তু মানুষের এই চাহিদাকে পুঁজি করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে মানুষকে মোটামুটি জিম্মি করে অর্থ উপার্জনের অসুস্থ ও জঘন্য পন্থা অবলম্বন করা মানুষের সংখ্যাও একেবারেই কম নয়। ঈদের সময় মানুষের যাতায়াতের জন্য গণপরিবহনে বেশি ভাড়া নেয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এক্ষেত্রে পরিবহন ব্যবসায়ীদের যুক্তি হলো, তারা সারাবছর নির্ধারিত ভাড়ার কমে যাত্রী সেবা দেন। ঈদেই শুধু তারা নির্ধারিত ভাড়া নেন। এর বাইরে আরেকটি যুক্তি তারা দেখান যে, ফিরতি পথে যাত্রী পাওয়া যায় না। গাড়ি খালি থাকে। তাই ভাড়া একটু বেশি নেয়া হয়। এসব যুক্তি আসলেই গ্রহণযোগ্য নয়। ব্যবসায় করতে গেলে লাভ-লোকসান থাকবে, ঝুঁকি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এটি একেবারেই অবান্তর ও অগ্রহণযোগ্য বিষয় যে, আমি সেবাটি গ্রহণ না করলেও আমাকে তার মূল্য দিতে হবে? আমি যাত্রী না হয়েও আমাকে কেন ভাড়া দিতে হবে? এর কোন জবাব নেই। অনেক ক্ষেত্রেই সরকারি কর্তৃপক্ষ এসব অনিয়মের কোন যৌক্তিক সুরাহাও করতে পারে না। শুধু উত্সবের আবেগকে পুঁজি করে এরকম ব্যবসা করা নৈতিক মানদণ্ডে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। পৃথিবীর অনেক দেশে ধর্মীয় ও সামাজিক উত্সব উপলক্ষে পণ্য দ্রব্যের দাম কমানো হয়, বিভিন্ন ধরনের মূল্যহ্রাসের সুযোগ দেয়া হয়। কিন্তু আমরা অনেকক্ষেত্রেই এর ঠিক বিপরীত অবস্থার সৃষ্টি করি। এতে করে মানুষ তার উত্সব উদযাপন করতে বিড়ম্বনার শিকার হয়। প্রতিবছরই যাকাত দেয়া-নেয়ার সময় ছোট-বড় নানাবিধ ঘটনা দুর্ঘটনার সৃষ্টি হয়। হুড়োহুড়ি করে যাকাতের কাপড় ও টাকা নিতে গিয়ে পদদলিত হয়ে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে থাকে। এবছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। যাকাত প্রদানকে কেন্দ্র করে ময়মনসিংহে যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে সেটার দায় সংশি¬ষ্ট ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষ কোনভাবেই এড়াতে পারেন না। ভাবা যায়, একটুকরো কাপড়ের জন্য পদদলিত হয়ে মৃত্যু। কর্তৃপক্ষের কি ধরনের লাগামহীন উদাসীনতা ও অব্যবস্থাপনা থাকলে এরকম মর্মান্তিক ঘটনার সূত্রপাত হতে পারে। যদিও এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি কোনভাবেই রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। স্বাধীনতা পরবর্তীতে এদেশে এ ধরনের দুর্ঘটনায় শতাধিক হতদরিদ্রের মৃত্যু হয়েছে যার মধ্যে বেশিরভাগই বৃদ্ধা, নারী ও শিশু। তাই একথা বলা নিশ্চয়ই অযৌক্তিক হবে না যে, সমাজে সাম্যের অনুপস্থিতি যত প্রকট হচ্ছে, সবকিছু ছাপিয়ে শোকবার্তার উত্সব যত আনুষ্ঠানিক হতে থাকবে এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ যত বিলম্বিত হবে, এরকম মানবসৃষ্ট দুর্ঘটনা বা প্রতারণা এড়ানো ততই অসম্ভব হয়ে উঠবে।
ঈদকে ঘিরে প্রবহমান অর্থনীতির পাশাপাশি মানুষের হূদ্যতা, সামাজিকতা, আবেগ, অনুভূতির বিষয়টিও প্রণিধানযোগ্য। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের বিশেষ করে ধনী-গরিবের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য কমিয়ে আন্তরিক সম্মিলন ঘটানো এর উদ্দেশ্য হলেও বিষয়টি আমাদের সমাজ বাস্তবতায় তেমন একটা দেখা যায় না। পারিবারিক বন্ধনে মূল্যবোধের চর্চা কিংবা ধর্মীয় অনুশাসনের জায়গাটি শিথিল হওয়ায় মানুষের মনে পরস্পরের প্রতি সৌহার্দ্য, সমপ্রীতি বা সহমর্মিতাবোধের শিক্ষা সঞ্চারিত হচ্ছে না সমাজে। এর পরিণতিতে মানুষ সমাজবদ্ধ জীব হিসাবে সমাজের অন্য সকলের প্রতি তার অবশ্য পালনীয় কর্তব্যের বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছে। এজন্যই মানুষে মানুষে পরস্পর যোগাযোগও কমে যাচ্ছে। এটা শুধু ছেলে-মেয়েদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বড়দের মধ্যেও বিরাজমান। আধুনিকতার নামে মানুষের ভোগবাদিতা বেড়ে যাওয়ায় সামাজিক কাঠামোগুলো ভেঙে সামাজিক সমপর্কগুলো দুর্বল করে দিচ্ছে। সমাজে ধনী-গরিবের ব্যবধান না কমলে সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো আরও দুর্বল এবং মানুষে মানুষে সম্পর্ক আরও শিথিল হবে। ঈদে কে কোন দেশে ঘুরতে গেলো, কত টাকা বাজেট রাখল, কত দামি জামা-কাপড় কিনল, ‘কিরণমালা’ পাওয়া না পাওয়ার মাঝেই শুধু জীবন-মরণের ফারাক, এসব বিষয়ই যেন মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ত্যাগের চেয়ে ভোগই প্রাধান্য পাচ্ছে। পরিবারের সদস্যরা কে কোথায় কেমন আছে, প্রতিবেশী মানুষটি ঈদের দিনে কেমন আছে, গৃহকর্মী শিশুটির উপর অতিরিক্ত চাপ হয়ে যাচ্ছে কিনা, অধঃস্তন কর্মীদের বেতন বোনাস ঠিকমত পরিশোধ করা হয়েছে কিনা এসব ভাবার সময় কোথায়? আমরা এমন এক সমাজ তৈরি করেছি যেখানে নিজের বাইরে অন্য কাউকে নিয়ে ভাবার সময় নেই। আমরা আধুনিক হচ্ছি, উন্নত হচ্ছে আমাদের জীবন ব্যবস্থা, কিন্তু মানবিক মূল্যবোধের কতটুকু উন্নতি হচ্ছে, ভেবে দেখার সময় এসেছে।
লেখক: ফেনী প্রতিনিধি, বাংলানিউজটুয়েন্টিফোরডটকম।
ঈদুল ফিতর সর্বজনীন আনন্দ-উৎসব







