ঈদ সংখ্যা- ২০১৭
এ ম এ ন ক রি ম ।
শিক্ষা একটি মানুষের মৌলিক অধিকার। এই শিক্ষার মাধ্যমে ভাল খারাপ নির্ণয় করার সুযোগ থাকে। মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীদের মাঝে পার্থক্য করা যায়। পৃথিবীর আদি থেকে শুরু হয়েছে শিক্ষা। শিক্ষা গ্রহনের দিক থেকে দু’প্রকারের। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। শিক্ষার সংজ্ঞা নিয়ে দার্শনিকরা বিভিন্ন মত দিয়েছেন। সক্রেটিসের মতে,‘শিক্ষার হল মিথ্যার অপনোদন এবং সত্যের আবিষ্কার’। প্লেটোর মতে, ‘সুস্থ্য দেহে সুস্থ মনের বিকাশ সাধন করে অন্তর্নিহিত শক্তির পরিপূর্ণ বিকশিত করার রূপই হল শিক্ষা’।
ইবনে সিনার মতে, ‘মানবতার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করার জ্ঞানই হল শিক্ষা, এতে আত্মা অবিনশ্বরতা পাবে’। অন্যদিকে অধ্যাপক আবু হামিদ লতিফের মতে, ‘মানুষ দৈনন্দিন জীবনে দেখে, শোনে, ঠেকে, ঠকে, অনুসরণ ও অনুকরণ করে যা কিছু অর্জন করে তাই হল শিক্ষা’।
বিভিন্ন বিষয়ে যেমন মতবাদ রয়েছে। তেমনিভাবে শিক্ষা নিয়েও অনেক মতবাদ শিক্ষা দর্শনে বিদ্যমান। ৪ টি মতবাদ আজ বিখ্যাত। ১.ভাববাদ ২.প্রকৃতিবাদ ৩.বাস্তববাদ ৪. প্রয়োগবাদ।
ভাববাদী দর্শন দার্শনিক মতবাদ গুলোর মাঝে অতি প্রাচিন। এ মতবাদ বলে, জড় জগত ছাড়াও আরো একটি জগত রয়েছে, যাকে বলা হয় আধ্যাত্মিক জগত। ভাববাদীরা শিক্ষার লক্ষ্য হিসেবে আত্মবিকাশ ও আত্মোপলব্ধির উপর বিশেষভাবে জোর দিয়েছে। শিক্ষাক্রম সম্পর্কে তাদের বক্তব্য, শিক্ষাক্রমের সংগঠন হবে ব্যক্তির নৈতিক, বৈব্ধিক ও নান্দনিক এর পরিপূরক। তাদের মতে, শিক্ষক হবেন তিনি, যার পরিপূর্ণ আত্মোপলব্ধি রয়েছে। প্লেটো, কমেনিয়াস, কান্ট ও রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ এই মতবাদের অনুসারী।
প্রকৃতিবাদ দর্শনের মতে, প্রকৃতি হল প্রকৃত পক্ষে বাস্তব, আর সব মিথ্যা। জড়বস্তুই প্রকৃত বাস্তব, মন বা আত্মা বলতে কিছু নেই। প্রকৃতিবাদীরা জগতের সব কিছুকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাখ্যা করেছেন। এই মতবাদের প্রবক্তা হলেন, এরিস্টটল, ডারউইন, রুশো প্রমুখ। এদের মতে শিক্ষার লক্ষ্য হলো,আত্মপ্রকাশ ও আত্মসংরক্ষণ। তাদের মতে শিশুরা প্রকৃতি থেকে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিখবে। এই দর্শনের মতে কোন নির্দিষ্ট শিক্ষাক্রমের প্রয়োজন নাই। তাঁরা হাতে কলমে শিক্ষার কথা বলেছেন। শিশুদের খেলাচ্ছলে শিক্ষা দেয়ার কথা বলেছেন। এখানে শিক্ষকের ভূমিকা দর্শকের মত।
বাস্তববাদ দর্শনে বস্তুর অস্তিত্বই মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। এর জনক এরিস্টটল। বাস্তববাদ দর্শনের মূল কথা হল, বাস্তব অস্তিত্বের একটি জগত আছে যা মানুষ গঠন বা তৈরী করতে পারে না। তাদের মতে শিক্ষার লক্ষ্য, আহরিত জ্ঞানকে মানব কল্যাণে লাগানো। উপার্জন ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য তারা বিজ্ঞান ভিত্তিক শিক্ষার উপর জোর দিয়েছেন। তাদের মতে, পুঁথিগত শিক্ষা নয়,যে শিক্ষা বাস্তবে কার্যকরী তাই প্রকৃত শিক্ষা। বাস্তববাদী শিক্ষক হবেন যথার্থ বাস্তববাদী। তিনি শিশুর বিকাশের উপযুক্ত পরিবেশ নির্মানে সচেষ্ট থাকবেন। ভাববাদ, জড়বাদ, প্রকৃতিবাদ এর অসম্পূর্ণতা কাটিয়ে প্রয়োগবাদের আবির্ভাব। এর মূল কথা হল, জীবনের কোন পূর্ব নির্দিষ্ট স্থায়ী মান বা মূল্যবোধ নেই যা সর্বকালের জন্য প্রযোজ্য। তাদের মতে শিক্ষার লক্ষ্য হবে, দৈহিক, নৈতিক ও বৌদ্ধিক মূল্যবোধ সৃষ্টি করা। এই দর্শন মনে করে, বর্তমান ও ভবিষ্যতে যা কাজে লাগবে এমন জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের বিষয় গুলো শিক্ষাক্রমে স্থান পাবে। শিক্ষকের কাজ হবে, শিশুদের জন্য আদর্শ শিক্ষা পরিবেশ রচনা করা। এই দর্শনের মতে, শিক্ষার পদ্ধতি হবে কর্ম কেন্দ্রিক।
এভাবে বিভিন্ন মতবাদের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন শিক্ষা কমিশন বিভিন্ন শিক্ষাক্রম বা শিক্ষা নীতি দিয়েছেন। বাংলাদেশের ১ম শিক্ষানীতি ছিল কুদরত-ই-খোদা শিক্ষানীতি। এই নীতির অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল জাতীকে দেশ প্রেমিক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করণ ও বিশ্ব নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। এরপরও আরো অনেক শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। অবশ্যই সবার উদ্দেশ্য ভাল শিক্ষা ব্যবস্থা উপহার দেয়া। কিন্তু, এর ফিডব্যাক নিয়ে বক্তব্য দিতে সবাই নারাজ।
আবার পিছনের দিকে তাকাই। যখন ভাববাদে প্রাধান্য দিয়েছে আধ্যাত্মিকাকে। প্রকৃতিবাদ প্রাধান্য দিয়েছে দৃশ্যমান বস্তুর থেকে শিক্ষা নেয়ার ব্যাপারে। জড়বাদ গুরুত্ব দিয়েছে বস্তুকে অর্থাৎ ধর্মহীনতাকে। আর প্রয়োগবাদ প্রাধান্য দিয়েছে ব্যহারিক বা ফলিত জ্ঞানকে। কিন্তু, বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থাকে বলা হয় একটি অত্যাধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা। তবে তা হতে পারে প্রুক্তির চোখে তাকালে। বলা যেতে পারে যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা তা ধর্মহীনতার চোখে তাকালে। বলা যেতে পারে এই শিক্ষা ব্যবস্থা কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা তা পুঁজিবাদের চোখে তাকালে। এখানো আরো সংযুক্ত করা হয়েছে দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেও। তবে এটা সত্য, কিছুটা হলেও মানুষ কর্মমুখী হয়েছে। কিন্তু, বেকারত্ব এখনো কমেনি। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় মানুষ এসেছে কিন্তু,অপব্যবহার হচ্ছে হ্রাস পায়নি। সব চেয়ে হতাশার বিষয় প্রযুক্তির উল্লাসে আমরা হারিয়ে ফেলছি আমাদের মূল্যবোধকে হোক তা সামাজিক,ধর্মীয় বা মানবিক। দিনদিন মানুষ ডুবে যাচ্ছে নিরাপত্তাহীনতার অতল সাগরে। হোক তা মানষিক, শারিরীক বা অর্থনৈতিক।
আমাদের জাতি আমাদের আবেগের ও বিশ্বাসের জায়গা গুলো নিয়ে খেলা করছে। আমরা পত্রিকায় দেখি, নারায়ণগঞ্জ দেশের এলিট বাহিনী কর্তৃক সেভেন মার্ডার হতে, পঞ্চাশের উপরে সাংবাদিকের সামনে বিশ্বজিৎকে হত্যা করতে, মাধ্যমিক স্কুলের অফিসে শিক্ষককে বসে ধুমপান করতে, দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক বা ভিসিকে দুর্নীতি বা নারী কেলেঙ্কারির দায়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিদায় নিতে, লিমনের পায়ে গুলি করে আবার তার নামে মামলা দিতে, বিচারকের এজলাসে লাথি মেরে আবার সম্মানিত বিচারপতি হতে, বইমেলার সামনে লেখককে হত্যা করতে, দেশের সচিব হয়ে মুক্তিযুদ্ধের সনদ জালিয়াতি করতে, শত শত গুম হওয়াআত্মীয়ের আত্মনাদে বাংলার আকাশ কাঁপতে। এভাবে আরো অনেক ঘটনার উদারণ দেয়া যাবে অনেক সহজে কিন্তু, ইতি টানা হবে অনেক কঠিন। আজ ঘুরেফিরে আমাদেরকে পুঁজিবাদের নেশায় আসক্ত করা হচ্ছে। কোন সময় ধর্মনিরপেক্ষতার আবার কোন সময় প্রযুক্তির উৎকর্ষতার দোহাই দিয়ে। কিন্তু, এই পুঁজিবাদ কি পেরেছে কোন দেশে শান্তি দিতে? বরং দিয়েছে আন্তরিকতার পরিবর্তে আত্মকেন্দ্রিকতা, ঐক্যের পরিবর্তে বিভক্তি,সততার পরিবর্তে অসততা,মানবিকতার পরিবর্তে অমানবিকতা।
আজ সবাই শিক্ষাকে টাকার একমাত্র সিঁড়ি হিসেবে ধরে নিচ্ছে। তাই, সবাই যান্ত্রিকতার নেশায় মত্ত। আজ স্কুলগুলোতে মানবিক বিভাগে পড়ে ক্লাসের শেষ ক্রমিকের শিক্ষার্থীরা। মনে হচ্ছে মানবিক বিভাগ শুধু দুর্বল বা অমনোযোগী শিক্ষার্থীদের পাশ করার জন্য। আর বাকিরা ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে মানব সেবার নাম দিয়ে টাকার আকাশে ভাসার হিসাব কষছে। যদিও মাঝেমধ্যে ফাটাকেষ্ট মুভির মত মৃত লাশের অপারেশন টাকা দিতে হয়, বাম পায়ে সমস্যা থাকলেও ডান পায়ের অপারেশনের নিউজ পড়তে হয়। ইঞ্জিনিয়ারদের সততার জন্য বাঁশ প্রযুক্তির ব্যবহার বিল্ডিং বা কালভাটে দেখতে হয়, রানা প্লাজার মত নতুন বিল্ডিং এর ধবসের মর্মান্তিক খবর দেখতে হয়। আর ব্যাংক খাতের কথা দিয়ে লেখা দীর্ঘ করলাম না। আর এমবিএ বিবিএর হিড়িকে জাতি আজ দিশেহারা। অধিকাংশ ব্যাংকে এমবিএ, বিবিএ ছাড়া আবেদনই করার সুযোগ নেই। যদিও ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড মাদ্রাসার শিক্ষার্থী দিয়েও সার্ভিস দিয়ে আজ দেশের শীর্ষে অবস্থান করছে।
মানবিক বিভাগ কেন পড়বে তা অনেক শিক্ষকও জানে না। আর অভিবাকের কথা বাদই দিলাম। আর যারা পড়ছে তারাতো এসএসসি থেকেই হতাশ। সমাজে মনে করা হয় বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরাই মেধাবী। তাই, আজ বাংলা বিভাগ থেকে পড়েও সাহিত্য চর্চার অভ্যাস নাই। সমাজকর্মে পড়েও সামাজিক উন্নয়নের আগ্রহ নাই। ইতিহাসে পড়েও দেশ প্রেম নাই। সবই চলছে গতানুগতিক। তাই জাতি আজ শান্তিতে ইউনুছ, সাহিত্য রবীন্দ্রনাথের মত ব্যক্তিদের আগমনের কথা চিন্তা করে আর সময় নষ্ট করছে না। যেন আজ শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তন করছে না, একজন ঘুমন্ত মানুষকে ঘুম থেকে তুলে ঘুমের ঔষধ খাওয়াচ্ছে।
তাই দেশে বড় বড় সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ ইত্যাদি কাংখিত সংখ্যার তৈরি হলেও কাংখিত মানের হচ্ছে না। অর্থাৎ প্রকৃত শিক্ষা পাচ্ছে না। কারণ, শিক্ষার সর্বজনীন সংজ্ঞা হচ্ছে, কাংখিত আচরণের পরিবর্তনই শিক্ষা। আর এর কারণ হচ্ছে মানবিকতাকে অবমূল্যায়ন। আর মানবিকতার মূল্যায়ন করতে হলে আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ, মানবিক মূল্যবোধ ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে গুরুত্ব দিতে হবে। আর কোন ধর্মই মানুষকে উগ্রবাদিতা শেখায় না। আর এই কারণে স্যার স্ট্যানলে হল বলেছেন: ‘তুমি যদি তোমার সন্তানকে তিনটি ‘আর’ শিক্ষা দাও কিন্তু ৪র্থ ‘আর’ রিলেজিয়ন তথা ধর্মকে ত্যাগ কর তাহলে তুমি পাবে পঞ্চম ‘আর’ রাসক্যালিটি তথা বর্বরতা। অর্থাৎ হত্যা, ধর্ষন, খুন, নির্যাতন, অশান্তি, অত্যাচার, লুটপাট, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজী, দূর্নীতি ইত্যাদি।
তাই, হোক একজন শিক্ষার্থী ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ী, আইনজীবী, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ ও অর্থনীতিবিদ। কিন্তু, সবার আগে তাকে মানবিকতা শিক্ষা দিতে হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়







