এম এন করিম>>
বাংলাদেশ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা এক লীলা ভূমি। এখানে রয়েছে পাহাড়, নদী, সাগর ও বনের সুন্দর মিলন ভাবে। আমাদের দেশে রয়েছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ সমুদ্র সৈকত, সেন্ট মার্টিন, মাধবকুন্ড ঝর্না ইত্যাদি। যা দেখে মনে হয়, কোন এক কারিগর অতি নিপুন ভাবে সাজিয়েছে। এই কারণে প্রকৃতি প্রেমি ও ভ্রমণ প্রেমিরা পথের ব্যবধান ভুলে এসে ভীড় জমায় এসব স্থানে, দেশ হতে দেশান্তরে।
অনেকদিন শুনে আসছি খইছড়া ঝর্ণার কথা কিন্তু সময় হচ্ছিল না যাওয়ার। অবশেষে গত মাসে সিদ্ধান্ত নিলাম এবার বর্ষাই যাবো খইয়াছড়ায়। কারণ বর্ষায় থাকে ঝর্না গুলোর যৌবনকাল।
যাব এনএসটিইউ টুরিজম সোসাইটির পক্ষ হয়ে। তৈরী করা হল টি শার্ট। সবাই টি-শার্ট পেয়ে যেনো ট্যুরের নেশায় মত্ত হয়ে গেল। এদিকে সবার ল্যাব পরীক্ষার কারণে সময় যেন ধরা দিচ্ছিল না। সর্বশেষ, ১৪ আগস্ট সিদ্ধান্ত হল আমাদের ট্যুর হবে ১৬ আগস্ট। ১৪ আগস্ট উপকমিটি করে দেয়া হল, খাদ্য বিভাগ দেখবে শাহাদাত, জাকারিয়া, আজাদ। পরিবহন বিভাগ দেখবে আমান, আব্দুল করিম। চিকিৎসা বিভাগ দেখবে শাকিল ও রাজু। সার্বিক ব্যাবস্থাপনায় ও পরিচালনায় থাকবে সাদেক, হাফিজ, এম এন করিম।
১৬ তারিখের আগের দিন গুলি যেন যাচ্ছিল না। সবার অপেক্ষা এক জায়গায় কখন আসবে ১৬ আগস্ট। ভোর ৫ টায় ঘুম থেকে উঠে দেখি বাইরে বৃষ্টি। কলিজা যেন চ্যৎ করে উঠল। ট্যুর করতে পারবো কিনা।কিন্তু শুরু করলাম সবাই সবাইকে ফোন দেয়া। আগের নির্ধারিত সময় অনুযায়ী সবাই ভোর ৬ টায় হাজির নোয়াখালীর সোনাপুর রেল স্টেশনে। ৬টায় ট্রেন ভ্রমনের মাধমে শুরু হল আমাদের ১ডজন যুবকের দু:সাহসিক যাত্রা। চৌমুহনী এসে আবার আটকা পড়লাম বৃষ্টির কবলে। অনেকে মনে ভাবছিল আসলে যেতে পারবকিনা। কিন্তু তারপরও কিছু বলছিল না কারো মন ভাঙ্গার ভয়ে।
উঠলাম একটি চট্টগ্রাম গামি বাসে। বাস নামিয়েদিল মিরসসরাইয়ের পর বড় তাকিয়ায়। সকালের নাস্তা না করায় সবার পেটের ছোট ছোট প্রানি গুলো যেন বিক্ষোভ মিছিল করছিল। তাই সবাই নান্তা করে নিলাম। এর পরই খেলাম আরেক ধাক্কা। ঐদিকেও চলছে সিএনজি ধর্মঘট। সর্বশেষ সিদ্ধান্ত হল হেটে হলেও যাব। কিন্তু কিছু দুর যাওয়ার পর পেলাম একটা মাল গাড়ি। সবাই উঠে রওয়ানা হলাম গন্তব্যের দিকে। নামিয়ে দিল রেল লাইনের কাছে। এলাকার লোকদের জিজ্ঞেস করে শুরু করলাম হাঁটার প্রতিযোগিতা। আগে থেকে জেনেছিলাম অনেক হাঁটতে হবে তাই, ৮ লিটার পানি নিলাম খাওয়ার জন্য। অনেকে মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিলো না হাঁটার কষ্টে। প্রায় ১ ঘন্টা হাঁটার পর পৌঁছলাম কাংখিত ও লালিত স্থানে। সেখানে গিয়ে দেখি সবার চেহারা পরিবর্তন। কারোমুখে নেই কোন ক্লান্তির ছাপ। অনেকে ব্যস্ত হয়ে গেল ফটোসেশনের। আবার অনেকে নিজের শরীরকে ভাসিয়ে দিচ্ছিল ঝর্নার পানিতে।আবার অনেকে আবেগে পানও করছিল।
বিভিন্ন পর্যটনে রয়েছে বিভিন্ন কৃত্তিমতার হাত। আর এই খইয়াছড়া ঝর্নায় তারই অভাব। এই অভাবই তার এক অদ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য। এখানে শোভা বর্ধণেনেই কোন মানুষের হাত, সম্পুর্ন প্রাকৃতিক। ২০১০ সালে গিয়েছিলাম বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ঝর্না মাধবকুন্ডতে। সেখানে উঠেছিলাম ঝর্ণার উৎস দেখতে অতি কষ্ট করে। সেখানে দেখেছিলাম পাকৃতিক পানির সাথে কৃত্তিম পানি দিয়ে বাড়ানো হচ্ছিল পানির প্রবাহ। কিন্তু এখানেই নেই এমন কোন কৃত্তিমতার স্পর্শ। দুজন বন্ধুকে দেখছিনা, জিজ্ঞেস করলাম তারা কোথায়।একজন বলল উপরে ঝর্ণা দেকতে গিয়েছে।
জানলাম ঝর্না এখানেই শুরু। আরো ররেছে। উঠতে হবে পাহাড় বেয়ে। কিভাবে সম্ভব এমন ছিল অনেকের প্রশ্ন। আবার গুঁটিগুঁটি বৃষ্টি হচ্ছে। পাহাড় ছিল অনেক পিচ্ছিল। কিন্তু দু:সাহসীদের থামায় কে। শুরু করলাম ৫জন মিলে পাহাড় বেয়ে উঠার দু:সাহসী অভিযানে। অর্ধেক যাওয়ার পর দেখলাম তিনজন বিদায় নিয়েছে ভয়ে। তখনই মনে হয়েছিল এদেরকে নিয়ে কাজী নজরুলের ‘যৌবনের গান’ পাঠচক্র করা দরকার। কিন্তু, আমাদের চলছিল যাত্রা উর্ধব মুখে আবিস্কারের নেশায়। ১ম ধাপে গিয়ে পেলাম দুজন ১২ বছরের স্থানীয় শিশু ও আমাদের বয়সের ২ জন সহ মোট ৭ জন হলাম। মনে মনে বললাম, এবার কে ঠেকায়। শিশু গুলোর আচরণে মনে হয়েছিল অনেক আগের পরিচিত। শিশুরা আমাদেরকে বার বার শতর্ক করছিল এবং পথদেখিয়ে দিচ্ছিল কিভাবে যেতে হবে। কারণ প্রায় জায়গা ছিল পিচ্ছিল। কবার পা ফসকে গেলে নিশ্চিত যেতে হবে কাপনে বা কফিনে অথবা শ্মশানে। পর্যায়ক্রমে ৮ টি ধাপ অতিক্রম করলাম। তবে নেটে সার্চদিয়েও পাইনি মোট উচ্চতা কত। মনে হয়েছিল বাংলাদেশের এভারেস্ট জয় করেছি। কিন্তু সবার একটা দু:খছিল বৃষ্টির কারণে কেউ পারেনি এই জয়কে ফ্রেমে বন্ধী করতে। তারপর সবার চোখমুখে হাসি ছিল ৯ টি ঝর্ণা দেখা হল। এছিল এক ঝর্ণার নিরব সমাবেশ।
কিন্তু কেউ না দেখলে কল্পনাও করতে পারবেনা এমন ভাবে সৃষ্টিকর্তা কিভাবে এই ৯টি ঝর্ণা পরতে পরতে সাজিয়েছে। তখনই নিজের অজান্তে মুখ দিয়ে বের হয়ে আসে/ ‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা,/ তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা,/ ওসে স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সেদেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা।/ এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,
সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি।
লেখক: শিক্ষার্থী, ফলিত গণিত বিভাগ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।