ড. বদরুল হাসান কচি
খুব সকালেই আজ ঘুম থেকে জেগে ওঠা! জেগে ওঠা নাকি আসলে ঘুম না হওয়া বুঝতে পারিনি। মধ্য রাত অতিক্রান্ত হবার পর যিনি সাধারণত ঘুমান তার কাছে পাখি ডাকা ভোর সত্যি অপ্রত্যাশিত। ভাবিত হই তবে কেন এই অসম্পূর্ণ ঘুম? খুব সহজে বুঝে যাই গতদিন চার প্রগতিশীল নাগরিকের উপর দুর্বৃত্তদের নিসংসতার সংবাদটি এখনো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এদের মধ্যে যিনি মারা গেলেন জাগ্রতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সাল আরেফিন দীপন, তাঁর বাবা যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক এবং স্বনামধন্য লেখক আবুল কাশেম ফজলুল হক যখন বলেন তিনি ছেলে হত্যার বিচার চায় না, তাঁর চাওয়া মানুষের শুভবুদ্ধি উদয় ঘটুক; যখন মধ্য রাতে এই খবরটি অনলাইন মিডিয়াতে দেখি স্তব্ধ হয়ে যাই।
দেশের বিচার ব্যবস্থা আর অপরাধী সনাক্তকরণে সরকারের ব্যর্থতায় কতোটা আস্থাহীন হলে একজন বাবা ছেলে হত্যার বিচার চান না ভাবতে পারেন কেউ! স্বাধীনতার চার দশক পরে একটি গণতান্ত্রিক দেশের কোন সরকারের জন্যে এটা কতো বড় লজ্জার কথা। একজন সাধারন নাগরিকের কাছে এক অসহায় পিতার এমন উক্তি পাহাড়সম বেদনা বহন করে।
কেন তৈরি হলো এই আস্থাহীনতা? এক দিনেই কি এর উদ্ভব? কারা দায়ি? এমন অনেকগুলো প্রশ্ন পরপর এসে যায়। সচেতন মাত্রই উত্তর জানেন। গত বই মেলা অর্থাৎ চলতি বছরে ফেব্রুয়ারিতে যেটা হয়ে গেলো, আরেকটি সন্নিকটে। বই মেলা থেকে বের হবার পথে প্রবাসী লেখক অভিজিৎ রায় যিনি মেলা উপলক্ষ্যেই দেশে এসেছিলেন তাকে কিছু দুর্বৃত্ত রাতের অন্ধকারে পুলিশের ঘাড়ের কাছেই কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে পালিয়ে যায়। তাঁর বাবা অজয় রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক। বিজ্ঞান মনস্ক লেখক অভিজিৎ রায়ের একটি বইয়ের প্রকাশক ছিলেন গতদিনের ঘটনায় নিহত প্রকাশক দীপন। দুইজনের খুনের ঘটনাস্থল দুটো কাছাকাছি। একজন টিএসসি চত্বরে আরেকজন শাহবাগ আজিজ মার্কেটের নিজ বাণিজ্যিক কার্যালয়ে। তাদের দুজনের মধ্যে কতো মিল। দুজনে একই চেতনা ধারন করেন, একজন লেখেন আরেকজন তা প্রকাশ করেন, দুজনের বাবা একই বিদ্যাপীঠে শিক্ষকতা করেছেন এবং দুজনকে একই কায়দায় কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে, আরো দুঃখজনক হলো দুজনের বীভৎস লাশ চিহ্নিত করেছেন তাঁদের বাবারা। ব্যতিক্রম শুধু একটি জায়গায় অভিজিতের বাবা সন্তান হত্যার বিচার চেয়েছেন আর দীপনের বাবা বিচার চায় নি।
যেহেতু একই ধরণের অতীত ঘটনায় আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা বের করতে পারেনি কারা এই নিসংসতা ঘটিয়েছে সেহেতু কারা এর পেছনে জড়িত সেই প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানে যাবোনা। আস্থাহীনতার জায়গায় থামতে চাই। এযাবৎ যতোগুলো মুক্তমনা লেখক ব্লগার খুন হলেন আজ পর্যন্ত একটি ঘটনার বিচার হয়নি। ব্লগার আহমেদ রাজিব হায়দারের বিচারের কিছুটা অগ্রগতি হলেও বাকি গুলোর কোন কূল কিনারা করতে পারেনি প্রশাসন। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর এই চরম ব্যর্থতা যখন দীপনের বাবার কাছে স্পষ্ট তখন তিনি বিচার প্রত্যাশা করবেন কি করে। সরকারের এই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ প্রতিষ্ঠান যখন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে তখন এই দায়ভার এড়ানোর কোন সুযোগ সরকারের আছে কি?
লেখকঃ আইনজীবী, সম্পাদক- ল’ইয়ার্সক্লাববাংলাদেশ.কম ও নির্বাহী পরিচালক, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, ‘সপ্ন’।