বদলে যাওয়া বাঙালি সংস্কৃতি – নতুন ফেনী বদলে যাওয়া বাঙালি সংস্কৃতি – নতুন ফেনী
 ফেনী |
৮ অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৩ আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বদলে যাওয়া বাঙালি সংস্কৃতি

রাশেদুল হাসানরাশেদুল হাসান
  প্রকাশিত হয়েছেঃ  ০৪:৪৩ অপরাহ্ণ, ১২ এপ্রিল ২০১৬

স্বকৃত নোমান।
একটি জাতির জীবনচর্চা ও চর্যার বৈচিত্র্যময় সমন্বিত রূপ হচ্ছে সংস্কৃতি। যেমন আমরা বাঙালি। আমাদের জীবনযাপনের ধরণ, ঐতিহ্য, আচার-আচরণ, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা, নীতি-নৈতিকতা- এগুলো সংস্কৃতির প্রধান উপকরণ। এক জাতির সংস্কৃতির সঙ্গে অন্য জাতির সংস্কৃতির হুবহু মিল থাকে না। বাঙালির সংস্কৃতির সঙ্গে আরবীয় সংস্কৃতির মিল নেই। জার্মান সংস্কৃতির সঙ্গে ল্যাটিন আমেরিকার সংস্কৃতির মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। মঙ্গোলিয়ান সংস্কৃতির সঙ্গে চৈনিক সংস্কৃতির মিল নেই। তার মানে সংস্কৃতিরও অনেক রূপ আছে। একটা স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে বাঙালিরও নিজস্ব সংস্কৃতি আছে। বাঙালি ভাত-মাছ খায়, লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরে, জারি-সারি-ভাটিয়ালি গায়- এগুলো বাঙালি সংস্কৃতির উপাদান। এরকম হাজার হাজার উপাদান আছে, যেগুলো বাঙালিত্বের পরিচয় বহন করে। স্বকীয় বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সংস্কৃতির কারণেই বাঙালি বিশ্বের বুকে আলাদা অস্তিত্ব নিয়ে টিকে আছে, থাকবে। পৃথিবীর বুকে এমন জাতির সংখ্যা খুবই কম যারা সংস্কৃতির জন্য জীবন বিসর্জন দিয়েছে। বাঙালি দিয়েছে। ভাষা আমাদের সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ। আধিপত্যবাদী সংস্কৃতি আমাদের এই ভাষাগত সাংস্কৃতিক অধিকার হরণ করতে চেয়েছিল। আমরা তা মানিনি। আর মানিনি বলেই রফিক-সালাম-বরকত-জব্বার বিসর্জন দিলেন তাদের জীবন।

বাঙালি রবীন্দ্রসংগীত শোনে, কিন্তু আধিপত্যবাদী সংস্কৃতি রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করল। বাঙালি তা মানতে পারেনি। বিদ্রোহ-বিপ্লবে ফেটে পড়ল। সুতরাং দেখা যাচ্ছে স্বাধীনতা আন্দোলনের নেপথ্যে সংস্কৃতির ভূমিকাও অনেক। কিন্তু সংস্কৃতি কি অপরির্তনীয়? সংস্কৃতি কি যুগ যুগ ধরে একই রকম থাকে? না, পরিবর্তন নিশ্চয়ই আছে। গুণীজনেরা বলেন, সংস্কৃতি নদীর মতো। নদী যেমন গতিপথ বদলায়, সংস্কৃতিও তার গতিপথ বদল করে। আদি ও অকৃত্রিম সংস্কৃতি বলে কিছু নেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃতিরও পরিবর্তন হয়। পৃথিবীর সব জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিই সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে। বাঙালি সংস্কৃতিও এর বাইরে নয়। শত বছর আগের বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে আজকের বাঙালি সংস্কৃতির বহু অমিল খুঁজে পাওয়া যাবে। বাঙালির প্রাচীন সংস্কৃতি কী ছিল আর বর্তমানে কী আছে, এর মধ্যে কী কী পরিবর্তন ঘটে গেল, সুলুক সন্ধান করা যেতে পারে।

প্রথমে আলোচনা করা যাক বাঙালির খাওয়া-দাওয়ার সংস্কৃতি নিয়ে। খাদ্যাভ্যাসও কিন্তু সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। ধান চাষ ও চাল উৎপাদন বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ। ধনী-গরিব সবার প্রধান খাবার ছিল ভাত এবং মাছ। ঘি মেশানো ধূমায়িত ভাত খাওয়ার কদর ছিল প্রাচীনকালে। গরম ধূমায়িত ভাতের প্রতিটি কণা থাকত অভিন্ন, একটি থেকে আরেকটি বিচ্ছিন্ন, ঝরঝরে এবং অন্ন ছিল সুসিদ্ধ সুস্বাদু, সাদা রঙ, সরু ও সৌরভময়। দুধে রান্না করা চালের কথাও জানা যায়। অতীতে শাক ও অন্যান্য ব্যঞ্জনসহকারে ভাত খাওয়ার নিয়ম প্রচলিত ছিল। বিশেষ করে দরিদ্র জনসাধারণের মধ্যে শাক-সবজি তরকারিসহ ভাত খাওয়ার প্রথা প্রচলিত ছিল। তরকারির মধ্যে বেগুন, কুমড়া, ঝিঙা, করলা, কচু ইত্যাদি খেত বাঙালি। বিয়ে শাদি এবং অতিথি আপ্যায়নের সময় খাদ্যের তালিকা প্রসারিত হতো। প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় ছিল ভাত, গাওয়া ঘি, মৌরলা মাছের ঝোল, নালিতা শাক ইত্যাদি।
অতিথি আপ্যায়নে ভাতের সঙ্গে পরিবেশিত হতো দই, পায়েস, ক্ষীর এবং ছানার তৈরি মিষ্টান্ন। কর্পূর মেশানো সুগন্ধি জল পরিবেশনের কথাও জানা যায়। আহারের শেষে পরিবেশন করা হতো সুপারি ও নানা মসলাযুক্ত পান। প্রাচীনকাল থেকেই শুঁটকি বাঙালির জনপ্রিয় খাবার। শামুক, কাঁকড়া, বক, হাঁস, মোরগ, সারস, উট, গরু, শূকর ইত্যাদির মাংস কেউ খেত না। বিভিন্ন তরকারির সঙ্গে টকদই ব্যবহারের প্রচলন তখন থেকেই। ফলের মধ্যে কলা, তাল, আম, কাঁঠাল, বেল, নারিকেল, ইত্যাদি বাঙালির প্রাচীন খাদ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত। আপেল, আঙুর, নাশপাতি, বেদানা ইত্যাদি আসতো বাইরে থেকে। তবে খুবই কম। প্রাচীন বাঙালির খাদ্য তালিকায় ডাল উৎপাদন বা খাবারের উল্লেখ পাওয়া যায় না। বাংলাদেশে বা পূর্ব-ভারতে কখনই ডালের চাষ হতো না। চাল দিয়ে তৈরি হতো মুড়ি, চিড়া, খই, নাড়ু এবং তেলমুক্ত নানা প্রকারের পিঠা।
শত বছরের ব্যবধানে বাঙালির খাবার দাবারের সংস্কৃতিতে অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে। ভাত-মাছ এখনো বাঙালির প্রধান খাবার বটে কিন্তু ধান উৎপাদনে এসেছে পরিবর্তন। এসেছে উচ্চফলনশীল জাতের ধান। ঘি মেশানো ভাতের কথা এখন কেউ চিন্তাও করে না। ভাতের পাশাপাশি এখন যুক্ত হয়েছে আটা-ময়দার তৈরি রুটি এবং নানা ধরণের বিস্কিট, চানাচুর, সেমাই, নুডুলস ইত্যাদি। ডাল এখন বাঙালির প্রতিদিনের খাবার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। নিত্যকার খাদ্য হিসাবে মুরগির মাংস এখন সাধারণ ব্যাপার। মুরগির মাংস ছাড়া তো এখন অতিথি আপ্যায়নের কথা ভাবাই যায় না। কাঁকড়া খাওয়া এখন চিংড়ি খাওয়ার মতো এক ধরনের  বিলাসিতা বটে। বড় বড় হোটেল-রেস্তোরাঁয় কাঁকড়া নানাভাবে প্রক্রিয়াজাত করে পরিবেশন করা হচ্ছে। বকের মাংস খাওয়াও বর্তমানে এক ধরনের বিলাসিতা। এখন অতি উচ্চমূল্যে বিক্রি হয় বড় বড় বাইম মাছ। ঝিনুকও উঠে এসেছে খাদ্য তালিকায়। সেদ্ধ করা ঝিনুক সস দিয়ে খাওয়ার স্বাদই আলাদা! এসেছে হালিম, কাবাব আরো কত কিছু।
অতিথি আপ্যায়নেও এসেছে পরিবর্তন। আগে বড় বড় অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিথ অতিথিদের আপ্যায়ন করা হতো মাটিতে চাটাই পেতে কলাপাতায়। তারপর এল মাটির সানকি বা বাসন। এরপর এলো চিনামাটি, কাঁচ, স্টিলের থালাবাসন। অতিথিদের এখন চেয়ার-টেবিলে খাবার পরিবেশন করা হয়। খাবারের পর আগের মতো সেই মিষ্টান্নের সমাহার চোখে পড়ে না। বহুজাতিক কোম্পানির বিভিন্ন পানীয়, যেমন কোকাকোলা, ফান্টা, মিরিন্ডা, সেভেন আপ, পেপসি ইত্যাদি খাবারের পর পরিবেশন করা হয়।
এবার আসা যাক বাঙালির পোশাক-পরিচ্ছদ ও সাজসজ্জার সংস্কৃতি বিষয়ে। বাঙালির পোশাকের আদি রীতি ছিল সেলাইবিহীন একবস্ত্র। বাঙালি পুরুষেরা ধুতি আর মেয়েরা শাড়ি পরত। আর্থিক অবস্থা ভালো হলে গায়ের উপর একখণ্ড কাপড়ের ব্যবহার ছিল। এটা পুরুষের ক্ষেত্রে ছিল উত্তরীয়, মেয়েদের ক্ষেত্রে ওড়না। এই ওড়না প্রয়োজনে ঘোমটার কাজ করত। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তে এক কাপড়ই যথেষ্ঠ ছিল এবং এরা প্রয়োজনে এর আঁচল দিয়েই ঘোমটার কাজ চালাত। পরে সেলাই করে জামা-কাপড় উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে আমদানি হলো। ৭ম ও ৮ম শতকের দিকে কাপড়ে ফুল, লতাপাতা ইত্যাদির নকশার প্রচলন হয়। নর্তকীরা কোমর থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত আঁটসাঁট পাজামা, আর গলায় বড় একটা ওড়না ব্যবহার করত। সাধু-সন্ন্যাসী ও দরিদ্র শ্রমিকেরা পরত নেংটি। সৈন্য ও মল্লবীররা পরত হাঁটু পর্যন্ত আঁট-পাজামা। শিশুরা পরত হাঁটু পর্যন্ত ধুতি নয়তো আঁট-পাজামা। বাঙালিরা কোনো কালেই মাথায় কোনো আবরণ দেয়নি। ছিল লম্বা বাবরী চুল। কোঁকড়া কোঁকড়া চুল কাধের উপর থোকায় থোকায় ঝুলত।
কেউ কেউ আবার মাথার উপর প্যাচানো ঝুঁটি রাখত। মেয়েদেরও ছিল লম্বা চুল। ঘাড়ের উপর খোঁপা করে বাঁধা। কেউ কেউ পিছনে এলিয়ে দিত। সাধু-সন্নাসীদের লম্বা জটা দুই ধাপে মাথার উপর জড়ানো থাকত। শিশুদের চুল তিনটি ‘কাকপক্ষ’ গুচ্ছে মাথার উপর বাঁধা থাকত। সৈন্য ও প্রহরীরা ফিতাবিহীন পায়ের কণ্ঠা পর্যন্ত ঢাকা চামড়ার জুতা পড়ত। সাধারণ লোকেরা জুতা ব্যবহার করত না। ধনীরা কাঠের পাদুকা ব্যবহার করত। বিবাহিত নারীরা কপালে কাজলের টিপ, সিঁথিতে ও ঠোঁটে সিঁদুর, পায়ে লাক্ষারস, দেহ ও মুখে চন্দনের গুড়া ও চন্দন বাঁটা এবং জাফরান ব্যবহার করত। পুরুষেরা হাতের নখ বড় রাখত এবং নখে রঙ লাগাত। বিলাসিনীরা ঠোঁটে লাক্ষারস ও খোঁপায় ফুল গুঁজে দিত। অনেকে গলায় ফুলের মালা দিত। অনেক সময় বুকের কাপড় সরে গেলে ফুলের মালা দিয়ে বুক ঢেকে লজ্জা নিবারণ করত।
বারাঙ্গনারা দেহে পাতলা কাপড় পরত, বাহুতে সোনার বাজু, সুগন্ধি তেল দিয়ে চুল চূড়া করে বেঁধে তাতে ফুলের মালা জড়িয়ে নিত। কানে পরত কচি তালপাতার দুল। গ্রামের মেয়েরা আবার নগরের মেয়েদের সাজসজ্জা পছন্দ করত না। নগরের মেয়েরা বাঁকা ভাবে পা ফেলে কোমর দুলিয়ে হাঁটত আর সেটা গ্রামের মেয়েরা যদি নকল করার চেষ্টা করত তাহলে সামাজিক শাস্তির ব্যবস্থা ছিল। তাদের বলা হত সোজা পা ফেলে চলতে। এরাও কপালে কাজলের টিপ পরত, বিবাহিতারা হাতে দিত শঙ্খের সাদা বালা, কানে কচি রীঠাফুলের দুল, চুলে তেল। পুরুষেরা মাঠে আর মেয়েরা সংসারের হাট-বাজার করা থেকে শুরু করে সব কাজ করত। সূক্ষ্ম কার্পাস ও রেশম কাপড়ের জন্য বাংলাদেশ ছিল বিখ্যাত। তবে এসব ছিল উচ্চবিত্তের জন্য। সারারণ দরিদ্রের কপালে জুটতো মোটা ছিন্ন ও জীর্ণ কার্পাস কাপড়।
সময়ের ব্যবধানে বাঙালির পোশাক-পরিচ্ছদ ও সাজসজ্জার সংস্কৃতিরও বহু পরিবর্তন ঘটেছে। এখন কেউ সেলাইবিহীন বস্ত্র পরে না। তার বদলে স্থান করে নিল লুঙ্গি। পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাবে লুঙ্গির পাশাপাশি বাঙালি প্যান্ট পরতে শুরু করল। অভিজাতরা পরতে শুরু করল প্যান্ট-স্যুট-টাই। নারীদের শাড়ির পরিবর্তে এল সালোয়ার-কামিজ, কাঠের খড়মের বদলে চামড়া ও প্লাস্টিকের জুতা। জমিদার আমলে সাধারণ মানুষ জুতা পরলেও জমিদারের বাড়ির সামনে দিয়ে যাবার সময় জুতা খুলে যেতে হতো। এখন কি সেটা আর ভাবা যায়? শত শত বছর ধরে বাঙালি মাথায় কোনো আবরণ দিত না। মুসলিম সংস্কৃতির প্রভাবে এল টুপি, পাগড়ি। নারীরা পরতে শুরু করল বোরকা। ঠোঁটে লাক্ষারস ব্যবহারের বদলে এল লিপিস্টিক, নখের জন্য নেইল পালিশ। ফুলের মালা দিয়ে বুক ঢাকার পরিবর্তে চালু হলো ব্লাউজ, ব্রা ইত্যাদি। কানের কচি তালপাতা ও রীঠাফুলের দুলের বদলে এলো সোনা-রূপা ও ইমিটেশনের নানা গহনা। কার্পাস ও রেশম কাপড় উধাও হয়ে এখন প্রচলিত হয়েছে নানা ধরণের কাপড়। এখন মেহেদী গাছ থেকে মেহেদি পাতা সংগ্রহ করে কষ্ট করে বেটে হাতে লাগাতে হয় না। বিভিন্ন কোম্পানি বিভিন্ন নামে বাজারে এনেছে নানা প্যাকেটজাত মেহেদি।
খেলাধুলাতেও কম পরিবর্তন আসেনি। বাঙালির প্রাচীন খেলার মধ্যে ছিল হাডুডু বা কাবাডি। এছাড়া ছিল দাঁড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, নৌকাবাইচ, এলাটিং বেলাটিং, ঘুড়ি ওড়ানো, বলীখেলা, কড়ি, মার্বেল, ষোলঘুঁটি, লাটিম,  ডাংগুলি, এচিং বিচিং, ওপেন্টি বাইস্কোপ, কুতকুত, ফুল টোকা, পুতুল খেলা, নুনতা, পানি ঝুপ্পা, কানামাছি, গাইগোদানী, টোপাভাতি, লুডু ইত্যাদি। গ্রামগঞ্জের কোথাও কোথাও এখনো এসব খেলার প্রচলন থাকলেও মহানগর এবং নগর সভ্যতায় এখন আর এসব খেলার চল নেই। এসবের বদলে ধীরে ধীরে প্রচলন ঘটতে শুরু করল ক্রিকেট, ফুটবল ইত্যাদি খেলা। শহরে এমনকি গ্রামেও এখন ঢুকে পড়েছে হকি, ভিডিওগেমস এবং কম্পিউটার বা ইন্টারনেটভিত্তিক নানা খেলা। বাঙালির বিনোদনে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। একসময় যাত্রাপালার প্রচলন ছিল। এখন সেই স্থান দখল করেছে থিয়েটার, সিনেমা, রেডিও, টেলিভিশন। এসেছে ব্যাটারি চালিত নানা খেলনা গাড়ি, প্লাস্টিকের পুতুল, পশু-পাখিসহ কত কি। এখন আগের মতো আর কবিগানেরও প্রচলন নেই। পুঁথিপাঠও তেমন দেখা যায় না।
অপরদিকে, প্রাচীনকালে বাঙালির সংগীতকলা ছিল সংস্কৃত স্তোত্রসঙ্গীত প্রভাবিত। সেই সময়কার বৈষ্ণব ভাবাশ্রিত ধর্মসংগীতিগুলি আজও পূর্ব ভারতীয় মন্দিরগুলিতে গীত হয়। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে কবি জয়দেব বিরচিত ‘গীতগোবিন্দম্‌’ এই জাতীয় সঙ্গীতের একটি বিশিষ্ট উদাহরণ। ছিল জারি-সারি-ভাটিয়ালি গান। আঠার ও ঊনিশ শতকে বাংলায় প্রচলতি হলো বাউল সংগীত। তান্ত্রিক কর্তাভজা সম্প্রদায় ও ইসলামি সুফি দর্শনের ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল এই গানে। তারপর এলো রবীন্দ্র সংগীত। বাঙালির সংগীতের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ একটি ধারা। এই গানগুলির কথায় প্রাচীন হিন্দু ধর্মশাস্ত্র উপনিষদ ও মধ্যযুগীয় বৈষ্ণব পদাবলি ও বাউল গানের প্রভাব গভীর। তারপর এলো নজরুলগীতি ও অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী সংগীত। ১৮৬৭ সালে আয়োজিত হিন্দুমেলা বা স্বদেশী মেলায় দেশাত্মবোধক গানের ধারণার উদ্ভব হলো। বাংলা আধুনিক গানের ধারাও যথেষ্ট সমৃদ্ধ। ১৯৯০-এর দশক থেকে পাশ্চাত্য ধ্যানধারণা ও আধুনিক নগরজীবনকেন্দ্রিক বাংলা ব্যান্ড সংগীতের উদ্ভব হলো। এখন এই ব্যান্ড সংগীতেরই জয়জয়কার। উৎসব-আনন্দেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। বারো মাসে তেরো পার্বণের দেশ ছিল বাংলাদেশ। দুর্গাপুজা, লক্ষীপুজা, মনসা পুজা, স্বরস্বতীপুজাসহ নানা পুজাউৎসব ছিল বাঙালিদের মধ্যে। তারপর মুসলিম প্রভাবে এলো ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা, মহরম, আশুরা ইত্যাদি উৎসব। আগের মতো এসব উৎসব এখনো প্রচলিত বটে। তবে উৎসবের ধরন পাল্টে গেছে।
সময়ের সঙ্গে ঈদ-সংস্কৃতির পরিবর্তন হয়েছে, হচ্ছে। শত বছর আগের যে ঈদ-সংস্কৃতি, তার সঙ্গে বর্তমানের ঈদ-সংস্কৃতির ঢের তফাৎ। বাংলাদেশের বাঙালি মুসলমান সমাজেও গত তিন দশকে ঈদ-সংস্কৃতির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। তখনকার ঈদ-সংস্কৃতি বর্তমানের সঙ্গে মৌলিকভাবে ঠিক থাকলেও আনুসাঙ্গিক বহু কিছুর পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। পুজা ও ঈদ উৎসবের সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে থার্টি ফাস্ট নাইট, ভ্যালেন্টাইন ডে, জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী ইত্যাদি।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালির ভাষার পরিবর্তনও লক্ষণীয়। মুসলমান প্রভাবে বাংলা ভাষায় প্রচুর আরবি-ফারসি শব্দ ঢুকতে শুরু করল। ঔপনিবেশিক প্রভাবে ঢুকতে শুরু করল প্রচুর ইংরেজি শব্দ। আবার বঙ্কিমচন্দ্র যে ভাষায় সাহিত্য রচনা করেছেন, রবীন্দ্রনাথ সেই ভাষা বদলে দিলেন। তাঁর সাহিত্যের ভাষা হলো আরো আধুনিক। মানিক-তারাশঙ্করের মতো ঔপন্যাসিকরা ভাষাকে করলেন আরো আধুনিক। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সাহিত্যে ভাষার বড় পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল। বর্তমানের ভাষা তো আগের চাইতে অনেক পরিবর্তিত। এখন ভাষা নিয়ে চলছে দারুণ বিতর্ক। চলতি পথে, রাস্তায় ফুটপাতে, বাস, ট্রেনে, টেলিভিশনের নাটক, টকশো এবং রেডিওতে কান পাতলেই এখন প্রকৃত বাংলা ভাষার ব্যবহার শোনা যায় না। মানুষের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন এবং যোগাযোগের মাত্রা ভেদের ওপর ভাষার পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, হচ্ছে।
সংস্কৃতির উপযুক্ত অনুষঙ্গগুলি ছাড়াও হাজার হাজার অনুষঙ্গ আছে, পাঠক একটু খেয়াল করলেই এগুলোর পরিবর্তন দেখতে পাবেন। কিন্তু কথা হচ্ছে, সংস্কৃতির এই যে পরিবর্তন তাতে আমাদের কী লাভ বা কী ক্ষতি? লাভ-ক্ষতি দুটোই যে হচ্ছে, সন্দেহ নেই। সব কিছুরই ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক থাকে। গ্লোবালাইজেশনের কারণে আমাদের সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটছে। এই পরিবর্তনে আনন্দ যেমন আছে, বেদনাও কম নয়। সংস্কৃতির পরিবর্তনে আনন্দ কী? আগেই বলেছি, বাঙালির সংস্কৃতি ছিল সেলাইছাড়া কাপড় পরা। বাঙালিরা শাড়ি ও ধুতি পরত। তারপর লুঙ্গির প্রচলন শুরু হলো। আমরা এখন প্যান্ট-শার্ট পরি। কিন্তু এগুলো তো বাঙালির পোশাক নয়। এই দেশের, এই মাটির, এই সংস্কৃতির পোশাক নয়। তবু আমরা পরছি। আবার বাঙালি হাত দিয়ে ভাত খেত, এখনো খায়। তবে কোনো কোনো বাঙালি এখন কাঁটাচামচ ব্যবহার করে। বাঙালি ঢেঁকি দিয়ে ধান বানতো, চালের গুঁড়া করত, গরু দিয়ে ধান মাড়াতো। কিন্তু এখন মেশিন এসেছে। মেশিনই সব করে দিচ্ছে।
আগে গৃহকোণ থেকে নারীর বের হওয়াটা বাঙালি সংস্কৃতির মধ্যে ছিল না। এখন অফিস-আদালতে চাকরি করছে নারীরা, দেশ শাসন করছে নারী। আগে জমিদারি, সামন্ত প্রথা ছিল বাঙালির সংস্কৃতি। এখন তো ভাবাই যায় না। এরকম বহু পরিবর্তন ঘটে গেছে বাঙালি সংস্কৃতির। তবে এগুলো ইতিবাচক পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের ফলে বাঙালির জীবন-যাপন উন্নত হয়েছে, হচ্ছে। এই সাংস্কৃতিক পরিবর্তন আমাদের আনন্দ দেয়। সংস্কৃতি হারিয়ে গেছে বলে এতে হাহুতাশের কিছু নেই, বেদনার্ত হওয়ারও কোনো কারণ নেই। তবে সংস্কৃতির এমন কিছু উপাদান আছে, যেগুলোর পরিবর্তন ঘটলে জাতিগত সঙ্কট সৃষ্টি হয়। যেমন বাঙালি ভাত-মাছ খায়। এখন যদি বার্গার বা পিৎজা দিয়ে ভাত-মাছকে অপসারণ করে দেয়া হয়, তাহলে ক্ষতির কারণ আছে। ক্ষতিটা কীভাবে হচ্ছে? চালের তৈরি বাঙালির পিঠার কথাই ধরা যাক। পিঠা চাল থেকে এসেছে। কারণ বাংলায় ধান হয়। গম বাঙালির নিজস্ব নয়। ধান থেকে বাঙালি খই, মুড়ি, ভাত, চিড়া, চালভাজা এবং কত রকমের পিঠা বানাতো। এগুলো বানাতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তেল লাগত না। এগুলো বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতিটা হারিয়ে যাবে যদি বাইরের খাবারগুলো আসে। তাতে অর্থনৈতিক সঙ্কট তৈরি হবে। এ সংস্কৃতিগুলো অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত। বাঙালি ভাত ছেড়ে পিৎজা ও বার্গার খেতে শুরু করলে দেশের ধান উৎপাদনকারী কৃষকশ্রেণী ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শুকনো খাবারের পরিবর্তে বাঙালির মধ্যে ব্যাপকভাবে তেলের ব্যাবহারের ফলে শরীরে নানা রোগবালাই বাসা বাঁধছে। বাঙালি তার নিজস্ব বিনোদন বাদ দিয়ে যখন যখন বিদেশি চ্যানেল দেখে, হিন্দি সিরিয়াল দেখে, তখন বিদেশি পণ্যের বিজ্ঞাপনটাও দেখে। সেই বিজ্ঞাপন দেখে বিদেশি পণ্যের প্রতি আসক্ত হয়। বাঙালি যখন বিদেশি সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়, তখন শুধু তার সংস্কৃতির চিহ্নগুলো হারায় বা সাংস্কৃতিক ক্ষতি হয় তা নয়, অর্থনৈতিক ক্ষতিও হয়।
বাঙালি জারি-সারি-ভাটিয়ালি বাদ দিয়ে যখন ব্যান্ড সংগীতে আসক্ত হয়, তখন বাঙালির চিরয়াত ভাবুকতা উধাও হয়ে অস্থিরতার সৃষ্টি হবে। বাঙালির জারি-সারি-ভাটিয়ালি বা রবীন্দ্র-নজরুল সংগীত চিত্তকে প্রশান্তি দেয়, অপরপক্ষে পাশ্চত্য প্রভাবিত ব্যান্ড সংগীত চিত্তকে অশান্ত করে। অতএব, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটছে, ঘটবে- এটাই স্বাভাবিক। কিছু কিছু পরিবর্তনকে স্বাগত জানানো যায়। কিন্তু সব পরিবর্তনকে মেনে নিলে জাতিগত সঙ্কট যে তৈরি হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
সম্পাদনা: আরএইচ

 

আপনার মতামত দিন

Android App
Android App
Android App
© Natun Feni. All rights reserved. Design by: GS Tech Ltd.
extrabet güncel giriş extrabet giriş extrabet extrabet giriş extrabet grandpashabet grandpashabet güncel giriş grandpashabet giriş grandpashabet betasus güncel giriş betasus giriş betasus betasus matadorbet güncel giriş matadorbet giriş matadorbet matadorbet casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom pusulabet giriş pusulabet pusulabet giriş pusulabet pusulabet giriş pusulabet pusulabet giriş pusulabet betpark giriş betpark betpark güncel giriş betpark giriş betpark betasus güncel giriş betasus giriş betasus betasus matadorbet güncel giriş matadorbet giriş matadorbet matadorbet sahabet güncel giriş sahabet giriş sahabet sahabet betvole giriş betvole betvole giriş betvole betvole giriş betvole betvole giriş betvole marsbahis güncel giriş marsbahis giriş marsbahis grandpashabet grandpashabet güncel giriş grandpashabet giriş grandpashabet sekabet güncel giriş sekabet giriş sekabet sekabet pusulabet giriş pusulabet pusulabet giriş pusulabet onwin onwin güncel giriş onwin giriş onwin casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom marsbahis güncel giriş marsbahis giriş marsbahis casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom betebet giriş betebet meritking giriş meritking giriş casibom giriş casibom giriş onwin onwin güncel giriş onwin giriş onwin casibom giriş casibom giriş betebet giriş betebet güncel giriş betebet giriş betebet iptv iptv satin al iptv satin al iptv casibom casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom casibom giriş casibom güncel giriş casibom güncel giriş casibom giriş casibom bets10 giriş bets10 bets10 giriş bets10 iptv iptv satin al iptv satin al iptv casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom betebet giriş casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom casibom giriş casibom güncel giriş casibom güncel giriş casibom giriş meritking giriş meritking meritking giriş meritking casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom güncel giriş casibom giriş casibom giriş casibom casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom iptv iptv satin al iptv satin al ip tv casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom padisahbet güncel giriş padisahbet giriş padisahbet padisahbet vdcasino güncel giriş vdcasino giriş vdcasino vdcasino casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom ip tv satin al ip tv casibom güncel giriş casibom giriş casibom jojobet jojobet giriş jojobet jojobet giriş jojobet jojobet casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom jojobet casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom jojobet jojobet güncel giriş jojobet giriş jojobet casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom jojobet jojobet güncel giriş jojobet giriş jojobet casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom casibom casibom güncel giriş casibom giriş casibom preload imagepreload image