রিন্টু আনোয়ার
আগাম ঘোষণা দিয়ে ঢালঢোল পিটিয়ে দেশজুড়ে ১০ জুন থেকে শুরু হওয়া এক সপ্তাহের জঙ্গিবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান শেষ হয়েছে গত শুক্রবার ভোরে। এতে গ্রেফতার করা হয়েছে প্রায় ১৪ হাজারের মতো। পুলিশের দাবি, গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ১৭৬ জন জঙ্গি। তবে, অভিযানে আলোচিত কোনো জঙ্গিকে ধরার খবর পাওয়া যায়নি। এমনকি গত ১৮ মাসে উগ্রপন্থিদের ৪৭টি হামলায় যে ৪৯ জন নিহত হয়েছে, তাতে জড়িত কাউকে গ্রেফতারের কথাও পুলিশ জানাতে পারেনি বলে সংবাদ মাধ্যমে বলা হয়েছে।
সাঁড়াশি অভিযানটি শুরু থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ। আগাম ঘোষণা নিয়ে এমন অভিযান নজিরবিহীন। জঙ্গিবিরোধী অভিযানে গিয়ে ১৩ সহস্রাধিক মানুষকে গ্রেফতারও প্রশ্নযুক্ত। জঙ্গি ধরতে গিয়ে এত সংখ্যক মানুষকে পাকড়াও করার যৌক্তিকতা পাননি বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, পুলিশ তার স্বাভাবিক কার্যক্রমের মধ্যেই উগ্রপন্থিদের ধরতে পারতো। অভিযোগ আছে, অনেক এলাকা থেকে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের সবাইকে আদালতে হাজির করা হয়নি। অনেকে থানা বা পুলিশের হেফাজত থেকে বিশেষ লেনদেনে ছেড়ে দেয়া হয়েছে বলে সূত্রে প্রকাশ। এমনকি অনেককে গ্রেফতার করা হয়েছে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ বা মামলা ছাড়াই। তবে ঈদের আগে পুলিশের বিরুদ্ধে গ্রেফতার ‘বাণিজ্য’ করার অভিযোগ পুরানো। যদিও উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মতো অভিযানে ৫৪ ধারার লাগামহীন অপপ্রয়োগ হয়নি তা বোঝাতে গ্রেফতারি পরোয়ানাভুক্ত পুরনো আসামির সংখ্যা বেশি দেখানো হয়েছে। পুলিশের দাবি- গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ছয় হাজার ২৬ জনই পরোয়ানাভুক্ত আসামি। এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের যুক্তি হচ্ছে- দীর্ঘদিন ধরে অনেক ওয়ারেন্ট তামিল হয়নি। অভিযানে অনেক ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি, সন্ত্রাসী, মলম ও অজ্ঞান পার্টির সদস্য গ্রেফতার হয়েছে। তাই গ্রেফতারের সংখ্যাটি বড়। মন্ত্রীর দাবি- রোজায় সাধারণ মানুষ নির্বিঘেœ রয়েছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কাউকে আটক করা হয়নি। অভিযানের ৭৫ ভাগ সফল বলেও দাবি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর।
সারা দেশে গত দুই বছরে ৪৯ ভিন্ন মতালম্বীকে একই কায়দায় হত্যা করা হয়েছে। এদের মধ্যে মন্দিরের পুরোহিত, আশ্রমের সেবায়েত, খ্রিস্টান ব্যবসায়ী, শিয়া সদস্য, মসজিদের ইমাম আর ব্লগারতো রয়েছেনই। গত ৫ জুন চট্টগ্রামে খুন হন পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু। এর পর ৯ জুন পুলিশ সদর দপ্তরে চলমান পরিস্থিতি নিয়ে পুলিশ মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হকের নেতৃত্বে সভা হয়। সেখান থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হয়, মধ্যরাত থেকে শুরু হবে জঙ্গিবিরোধী অভিযান। বাবুল আক্তারের স্ত্রীকে হত্যার পর থেকে দেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন ১৩ জন। তাদের মধ্যে সন্দেহভাজন জঙ্গি নিহত হয়েছে পাঁচজন। বাকিরা ছিনতাইসহ অন্যান্য সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িত বলে দাবি পুলিশের।
সাঁড়াশি অভিযানের প্রাপ্তি নিয়ে এখন চলছে নানা বিশ্লেষণ। মোটাদাগে কাজের কাজ যেটা হয়েছে তা হলো কারাগার টইটুম্বর হয়েছে। এমনিতেই কারাগারগুলো আসামী-কয়েদিতে ঠাঁসা। এতোদিন বিভিন্ন সূত্রে এমন কথা শোনা গেলেও মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান সেদিন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার পরিদর্শন করে এসে যোগ করেছেন আরো ভয়ানক তথ্য। তিনি সংখ্যা তথ্য দিয়ে জানিয়েছেন, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ধারণক্ষমতার তিন গুণ বেশি বন্দী। এতো বন্দীর মানবেতর জীবনযাপন ও করুণ অবস্থার কথা জানান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, কারাগারে বন্দীর ধারণক্ষমতা রয়েছে ২ হাজার ৬৮২ জন। অথচ বন্দী রয়েছে ৭ হাজার ৩২৮ জন, যা ধারন ক্ষমতার তিন গুণেরও বেশি। মাত্র এক মাস পরই কারাগারটি কেরানীগঞ্জে স্থানান্তরিত হচ্ছে। এ কারণে বন্দীদের ওপর এর প্রভাব ফেলছে। এরইমধ্যে কারাগারের ৫৫০ জন নারী বন্দীর মধ্যে ৩৭৬ জনকে কাশিমপুর কারাগারে নেওয়া হয়েছে। তিনি কারাগারে বন্দীসেবার মান নিশ্চিত করার জন্যও সুপারিশ করেন। ড. মিজান বলেন, বন্দীদের চালান দেওয়া যেন বাণিজ্যে রূপান্তরিত না হয়, সে বিষয়টি কর্তৃপক্ষ নজরে আনবে। এ ছাড়া ব্যক্তিগত ক্ষোভ থেকে কোনো বন্দীকে যেন নরকযন্ত্রণায় না রাখা হয়। কারা হাসপাতালের চিত্র তাকে আহত করেছে বলেও জানান। আদালত জামিন দেওয়ার পরও কারাগার থেকে মুক্তি না দেওয়ার বিষয়টিকে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন মনে করেন তিনি। সারা দেশে ৫৭৬ জন বন্দী সাজাভোগ শেষে জামিন পেলেও তারা বন্দী রয়েছেন। মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান বাস্তবতার অতিরিক্ত কিছুই বলেননি। আমাদের অনেকেরই জানা, নতুন বন্দির চাপে স্থান সংকুলান না হওয়ায় পালাক্রমে ঘুমাতে হচ্ছে বন্দিদের। এ সংকটকে আরো তীব্র করেছে পুলিশের সাঁড়াশি অভিযান।
সারা দেশে ছোট-বড় মিলিয়ে কারাগারের সংখ্যা ৬৮টি। যার মধ্যে কেন্দ্রীয় কারাগার ১৩টি। বন্দির এই বাড়তি চাপের কারণে এসব কারাগারে শুধু স্থান সংকটই সৃষ্টি হয়নি, খাওয়া-চিকিৎসা-গোসল-শৌচকর্ম থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই চলছে অমানবিক পরিস্থিতি। এই মানবিক বিপর্যয়ের বেশি শিকার মহিলা ও শিশু বন্দিরা। অনেক বন্দিই ঘা, অ্যালার্জি, দাউদ, অ্যাকজিমার মতো চর্মরোগ ছাড়াও নানা ছোঁয়াছে রোগে আক্রান্ত। বন্দির বাড়তি চাপের কারণে মাঝে মাঝে এক কারাগার থেকে আরেক কারাগারে বন্দিদের অদলবদল করে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করা হলেও বাস্তব কারণেই উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে না। এছাড়া কারাগারের ভেতরের পরিস্থিতি নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। এর ভেতরে এক ধরনের সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা চালু রয়েছে, যার ফলে বন্দিদের সঙ্গে সামন্ত প্রভুর মতো আচরণ করা হয়। এতে অপরাধী আরো অপরাধ প্রবণই হচ্ছে। সবমিলিয়ে অবস্থা ভয়াবহ। দেশে যেভাবে অপরাধ বাড়ছে, তাতে প্রতিনিয়ত গ্রেফতারের সংখ্যা বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। কারাগারের সংখ্যা বাড়িয়ে এর সমাধান আশা করা ঠিক হবে না। তা ভাবলে প্রতি জেলায় আরো একটি করে কারাগার তৈরি করেও কূল মিলবে বলে মনে হয় না। আগে দরকার দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা।
এদিকে পুলিশের ধরপাকড়ের সাথে কোথাও কোথাও চলছে সিভিল নিরাপত্তা গ্রুপের তৎপরতা। খুলনা, মাগুরা, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুরসহ দেশের কোথাও কোথাও এলাকার কিছু মানুষের সমন্বয়ে পুলিশের তত্বাবধানে গড়ে তোলা হয়েছে বিশেষ প্রতিরক্ষা দল। তাদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে লাঠি, বাঁশি ও টর্চলাইট। পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ধারাবাহিক গুপ্তহত্যা ও জঙ্গি হামলার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের মনোবল ও সচেতনতা বাড়াতেই তাদের এই উদ্যোগ। শুনতে ভালো মনে হলেও এমন উদ্যোগের ফলাফল নিয়ে চিন্তিত হতে হয়। এ লাঠিগুলো কাদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে, এগুলো কাদের গায়ে পড়বে ? দুর্ভাবনার বিষয়। এ ধরনের উদ্যোগ আগেও নেওয়া হয়েছে। পরিণামে অঘটন ঘটেছে। যে যেভাবে পেরেছে সুবিধা নিয়েছে। মানবাধিকার কর্মীদের অনেকে মনে করেন, এটি মোটেই নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধানের যুতসই পন্থা হতে পারে না। তাদের যুক্তি হচ্ছে- নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব রাষ্ট্রের আরও নির্দিষ্ট করে বললে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। ফলে নাগরিকদের হাতে এ দায়িত্ব তুলে দেয়া খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
সাঁড়াশি ধরপাকড়ে কী পেল বাংলাদেশ
