সোহেল রানা>>
ফেনীতে যোগদানের তিনদিনের মাথায় আমার আবেগের পারদ থার্মোমিটার ভেংগে বেরিয়ে আসতে চাইল। নিজের ভেতরের এই জলোচ্ছ্বাস আমি ফেইসবুক স্ট্যাটাসে ঢেলে দিলাম। সেদিন আমি ফেইসবুকে লিখেছিলাম, “আমার সিভিল সার্ভিস ক্যারিয়ারের সর্বশ্রেষ্ঠ স্টেসন ফেনী”। কারণ আমার সিভিল সার্ভিস জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ বস। অনেকেই বলেছিলেন,“টু আরলি টু সে”। অনেকেই আমায় প্রায়ই অনেক কিছুই বলেন। অনেক প্রশ্নের উত্তর নিরবতা আর কাজের মধ্যে দিয়ে দেওয়াই ভালো।
জেলা প্রশাসক অনেক রকমই হন, তবে তারা যে আমিন উল আহসানের মত হন সেটি জানা ছিল না। আমিন উল আহসান ছিলেন স্বচ্ছ কাচের মত, রোদক্লান্ত পথিকের জন্য বটবৃক্ষের ছায়ার মত। আমিন উল আহসান ছিলেন সহজ করে বলা গল্পের মত, এক অনন্ত প্রশ্রয়ের নাম।
একজন জেলা প্রশাসক আমার মত একজন নগণ্য সহকারী কমিশনারকে শিং মাছ পাতে বেড়ে দিবেন, তাও আবার নিজ হাতে। এটি আমি মেনেই নিতে পারলাম না! পারল না আমার সস্তা আক্যুয়াস হিউমারও।
একজন জেলা প্রশাসক আমাকে হেড চেয়ারে বসার জন্য চারবার অনুরোধ করেন (নিজে অন্য চেয়ারে বসে ) এটাও আমি ও আমার জড় দারিদ্র্য কোনভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না।আর এ কারণেই মুগ্ধতার পারদ তিনদিনে বিস্ফরিত হয়েছিল।
ব্যক্তি আমিন উল আহসানের এই ধরণের আচরণ পূব দিক ফুঁড়ে ওঠা প্রতিদিনের সূর্যের মতই স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত যেকোন স্যাপিয়েন্স ক্রোমোজোমধারীর কাছেই। কিন্ত আমিন উল আহসান যে একজন জেলা প্রশাসক! একটি পরিবার (প্রশাসন), কিছু ক্ষয়িষ্ণু ঐতিহ্য আর বহুবিধ আচার ও প্রথার রাজদন্ডের ভার তার হাতে।তিনি শুধু একজন মানুষই নন, তিনি ফেনী জেলার বাংলাদেশও বটে। তার চোখ দিয়েই রাষ্ট্র ফেনী জেলাকে দেখে আবার তার চোখ দিয়েই ফেনীবাসী রাষ্ট্রকে দেখেন। এই দুর্মূল্যের বাজারে তাও কিছু ভালো মানুষ হয়, তাই বলে একজন জেলা প্রশাসক ঘরের দরজা খুলে রাখেন মানুষের জন্য, একজন জেলা প্রশাসক বুঝি সাধারণ মানুষের সাথে এ রকম জেনুইনলি মেশেন? একজন জেলা প্রশাসক বুঝি এতটাই নির্মোহ নির্লোভ হন।
একজন জেলা প্রশাসক বুঝি অফিসারের বাইরে এতটাই মানুষ হন!
স্যার বলেছিলেন,‘ যেদিন আমার বাবা আমাকে বকা দিতেন, সেদিন তার পড়াশোনা হত না”। অন্তর্নিহিত দর্শন হলো মানুষকে অনুপ্রাণিত করে কাজে উদ্বুদ্ধ করা। সে কারণে অনেকের সমালোচনা ছিল তিনি বোধহয় অতটা শক্ত নন। কিন্তু বিনা কারণে জাহিরি হাসিলের উদ্দেশ্যে শক্ত হয়ে হৃতপিন্ডকে কষ্ট দেওয়ার কি মানে? স্যারের শক্তি আমি দেখেছিলাম পরশুরাম উপজেলা নির্বাহী অফিসারের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায়, অনেকেই দেখেছেন রাজাঝির দিঘী উচ্ছেদের সময়। শক্তের জন্য ইস্পাত কঠিণ শক্ত হওয়া আর নরম ও দুর্বলের জন্য অনেক বেশি নরম হওয়ার আসল শক্তের লক্ষণ। এক ধরণের এন্টি-ম্যাকিয়াভেলিয়ান “Y” শ্রেণীর প্রশাসনকে স্যারের চোখ দিয়ে প্রত্যক্ষ করেছিলাম।
আমাদের মধ্যে যারা আগে মানুষ পরে অফিসার, ন্যায়পরায়ণতার ছটফটানি যাদের চোখে-মুখে, গণমানুষের প্রতি যাদের দায়বদ্ধতা উৎসব বেঁচে থাকার চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান, স্রোতের চেয়েও যাদের কাছে মানুষের অশ্রুর প্রবাহ অধিকতর খরস্রোতা তাদের পথচলার অবিসংবাদিত পাঞ্জেরীর নাম আমিন উল আহসান। প্রশাসনও যে জীব, আইনও যে সংবেদনশীল, স্রোতে ভাসার মিছিলেও যে দাঁড়িয়ে যাওয়া মানুষ থাকে, সীমাবদ্ধতার সাথেও যে চিরন্তন লড়াই জমা থাকে সেটি স্যারকে দেখার পর থেকেই বিশ্বাস করা শুরু করলাম। সিটিজেন’স ভয়েস নামে ফেসবুক গ্রুপে মানুষের সমালোচনার তীরের ঢাল হিসেবে উনি যা বললেন সেটিই আদর্শ শাসকের দর্শণ, “ চেয়ারে বসলে তো মানুষের গালমন্দ শুনতেই হবে, মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে দিতেই হবে”। এও বুঝি একজন শাসকের উত্তর হয়!
সিটিজেন’স ভয়েস যদি আত্মঘাতী হয় তবে সেই আত্মহত্যা আমিন উল আহসান মানুষের স্বার্থে হাসিমুখেই করেছিলেন।
একজন জেলা প্রশাসক রাষ্ট্রের সার্বিক ক্ষমতার সমীকরণে খুব সামান্য এক সমাধান। রাষ্ট্রের খুব হিসেবী, দুর্বোধ্য আর জটিল চরিত্রের ভেতরে থেকে রিপাবলিকের মালিকদের সংবিধান আর আইনের আলোকে হিস্যা বুঝিয়ে দেওয়া বেশ দুরূহ। আর এখানেই ছিলেন স্যার ব্যতিক্রম। মানুষের হিস্যা বুঝিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে স্যারের যে হাস-ফাস, যে প্রবণতা তা ফেনীর মানুষকেও ছুঁয়েছে। ভালোবাসা ছোঁয়াচে স্যার। কান পেতে শুনুন মানুষের ভালোবাসার ছুঁয়েছে। অন্তত এটুকু বুঝেছিলাম রাষ্ট্রের সমীকরণ সহজ হলে উনি হারুন-অর-রশিদ ই হতেন। মানুষ আমিন উল আহসানের কষ্ট ভুলিয়ে দেওয়া নির্মল হাসি, ভয়ংকর সুন্দর চপলতা আর সততার প্রতি সীমাহীন কমিটমেন্ট মানুষ হওয়ার প্রতি আমাদের লোভ বাড়িয়ে দেয়। আমি সবসময় বলেছি এবংবুকে হাত দিয়েই বলতে পারি- আমিন উল আহসানরা এই প্রজাতির সম্পদ। তার নির্মল হাসিতেই আমরা এক অন্য রকম সবুজ ভবিষ্যতের আভাস পাই।
স্যার:
আপনি যত দুর্বল ই হন না কেন, যত সীমাবদ্ধতাই আপনার থাকুক না কেন আমাদের কুড়িয়ে আনা বকুলের মালা আমরা আপনার গলাতেই দিব। আমাদের মানুষ তৈরীর পাঠশালায় আমরা আপনাকেই শিক্ষক মানব। টাইম-স্পেসকে যতই রিওয়াইন্ড করা হোক গলা বা মালা পরিবর্তিত হবে না এটি সুনিশ্চিত।
আপনাকে নিয়ে অনেকবার লিখার ইচ্ছা আমার বসের স্তুতিবাদের সমালোচনায় সত্যিকারের অনুভূতি হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে লিখতে পারি নি। আপনাকে আমি ভয় পাই কারণ আপনাকে ফেনীর গণমানুষের মতই আপনাকে আমিও ভালোবাসি। ভালোবাসায় ভয় সবসময় বেশি। যারা অসৎ ও ন্যায়পরায়ণ নয় তাদেরকে আমি বিন্দুমাত্র ভয় করি না; বরং চোয়াল শক্ত করেই কথা বলি। অনেক বিব্রত করেছি স্যার, প্রত্যাশার ধারে-কাছেও যেতে পারিনি। ক্ষমা চাওয়া ছাড়া এই বিদায়বেলায় কিছুই বলার নেই আমার। আমার মন খারাপ, এতটা মন খারাপ জীবনে খুব কম হয়েছে।হলেও এতটা নির্লজ্জের মত পাবলিকলি মন খারাপের কথা কখনো বলা হয় নি। আপনার একান্ত এক অনুসারীকে আপনি ফেলে গেলেন, বাতিঘরটি বহন করে নিয়ে যাচ্ছেন খুলনায়। আপনার জন্য আমার ও আমার মত আমাদের অশ্রসিক্ত শপথ, আমরা সবাই মানুষ হতে চাই, আমিন উল আহসানের মতই আলোয় পরিপূরণ মানুষ। আপনার হাতেই লাল-সবুজের বিজয় নিশান ছড়িয়ে যাক, যখন চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসব তখন আমরা আপনার মাঝেই দিপশিখা খুজে নিব।
লেখক: সহকারী কমিশনার, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, ফেনী।