তাসলিমা বেগম তাসমি:
আমাদের তখন আইন ও প্রশাসন কোর্স চলছিল। কালেক্টরেটের খবরাখবর নিয়মিত নিতাম ফোনে। সোহেল খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসনে জয়েন করেছে ফোনেই শুনতে পেলাম। প্রশিক্ষণ শেষে ফিরে এসে সোহেলের সাথে কাজ করা হয়নি। মাত্র কিছুদিন তাকে দেখেছি। কিছুদিন বলতে সপ্তাহখানেক। তারপরেই সোহেল ফেনী কালেক্টরেটে চলে যায়। সেখান থেকে প্রশিক্ষণে আবার ফেনী কালেক্টরটে। সোহেলকে বাকীটুকু দেখেছি বিভিন্ন সময়ে পত্রিকার পাতায় অপরাধ নিবারণে ওর পরিচালিত মোবাইল কোর্টের খবরে, ফেসবুকের পাতায়।
যদ্দুর মনে পড়ে ফেসবুকের পাতায় জেনেছি ও প্রশিক্ষণে সেরা তার্কিক ট্রফি জিতেছে। তা জিততেই পারে। সোহেল জানে প্রচুর। সে জানাকে প্রকাশও করতে পারে দারুণ উচ্চারণ আর স্বরের প্রক্ষেপণে। সোহেল আইন ও প্রশাসন কোর্সের সবচেয়ে কাংখিত এওয়ার্ড রেক্টর্স এওয়ার্ড পেয়েছে। তা পেতেই পারে। সোহেল ভার্সাটাইল। একসপ্তাহের মতো যখন ওকে সরাসরি দেখেছি, তখন দেখেছি আরেফিন স্যারের সাথে অনর্গল সাহিত্য, ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি, দর্শনসহ অনেককিছু নিয়ে তর্ক করতে। আরেফিন স্যারের জানার পরিধি এতো বেশী যে আমি তার সাথে পারতপক্ষে তর্কে যেতাম না। কিছু জানার থাকলে জেনে নিতাম শুধু। একটা প্রশ্ন করলে দশ পেরিয়ে বারোটা তথ্য দিতেন স্যার। ডিসি স্যার তাকে স্নেহ করে বলতেন ‘পন্ডিত’। অথচ সোহেল আরেফিন স্যারের সাথে সাবলীলভাবে তর্ক করতো। বাংলোতে দ’দিন এই দু’জনের তর্ক উপভোগ করেছি।
সোহেল কবিতা লেখে। তা লিখতেই পারে। এখন সবাই কবিতা লেখে। তরুলতা, প্রকৃতি, নারী, প্রেম, হতাশা, সরকারের সমালোচনা, বেদনা, দু:খ এইসব হাবিজাবি নিয়ে কলম চালিয়ে অনেকেই নিজ পয়সায় অথবা যদি কোন গুরুত্বপূর্ণ পোস্টে থাকেন তেলবাজদের পৃষ্ঠপোষকতায় অথবা নিজের বিজ্ঞাপনটা নিজেই দিয়ে ফেসবুকে নিজেকে জাহির করেন। ইনবক্সে কয়জন ফিদা হয়ে তার কবিতার প্রশংসা করেছেন তা নিয়ে সুখী সুখী স্ট্যাটাস দেন। কাউকে কাউকে আবার তাদের অতিভক্তরা ট্যাগ দেন। ভালো লাগে এসব দেখতে। আমার একজন ফেসবুক কবি বন্ধু আছেন সাইয়েদ জুবেরী। এই ভদ্রলোক ১৭ কোটি বাঙালি কবির মধ্য থেকে ৫ জন আসল কবি খুঁজে পাবেন ভেবে খুশি হন। আমি ফেসবুকে এইলেবল পরিচিত সব কবিদের কবিতা পড়ি। এগুলো নিউজফিডে চলে আসে। পড়ার পরে স্ক্রল করে নিচে নেমে যাই। একদিন সোহেলের কবিতা চোখে পড়লো। কেউ একজন শেয়ার করেছে। পড়ার পর আমি নিজ দায়িত্বে ওর টাইমলাইনে গেলাম। গিয়ে দেখি ও শুধু লিখেই ক্ষান্ত নয়। আবৃত্তিও করে। সুন্দর বাঙ্গিমায় প্রকাশ। ভরাট ভয়েস। আমি বেছে বেছে কয়েকটা ইউটিউব লিংক পোস্ট করলাম।
আমাদের সার্ভিসে জয়েন করার পর পৃথিবীটা ছোট হয়ে যায়। দ্বিমত থাকতে পারে। তবে আমার ক্ষেত্রে হয়েছে। এই ছোট পৃথিবীতে সার্ভিস সংশ্লিষ্ট মানুষগুলো অনেকখানি জুড়ে থাকে। তাদের সাথে ২৪ ঘন্টার অন্তত ১২/১৪ ঘন্টা কাটাতে হয়। অন্যসময়েও ভাবনায় তারা থাকেন। অফিসকে অফিসে ফেলে রাখা যায়না। আমি অন্তত পারিনা। তাই এরা খুব আপন হয়ে যান। এই আপন মানুষগুলোকে আমরা বলি সহকর্মী।
ফেসবুকে পোস্ট দিতে গেলে এঁরা চলে আসেন। নিন্দুকেরা ও অল্প পরিচিতরা তখন ভাবেন সহকর্মীদের নিয়ে ফেসবুকের পোস্টগুলো বিশেষ উদ্দেশ্যে দেয়া। নগ্ন বাংলায় তেলবাজি করা। আমার খুব ভয় লাগে। তাই আমি কাউকে নিয়ে তখন পোস্ট দেই যখন তাঁর কাছে আমার অন্তত কাছাকাছি দিনগুলোতে কিছু পাওয়ার থাকেনা। যেমন ডিসি স্যারকে নিয়ে তখন পোস্ট দেই যখন এসিআর ফরোয়ার্ড হয়ে গেছে। খুব প্রমিনেন্ট কিম্বা প্রভাবশালী কারো কিছু শেয়ার দেইনা, তাঁদের নিয়ে পোস্টও দেইনা। আমাকে কেউ তেলবাজ ভাবলে আমার খারাপ লাগে। আমাকে কেউ শুধু বসবাজ ভাবলে আমার খারাপ লাগে। আমাকে কেউ শুধু সিনিয়রবাজ ভাবলে আমার খারাপ লাগে। আমাকে কেউ সুবিধাবাজ ভাবলে আমার খারাপ লাগে।
এখন যে ছেলেটির কথা লিখছি, সোহেল। সোহেল রানা। সে আমার ছোটভাই, সহকর্মী। ছোটভাই আগে লিখলাম। কেন লিখলাম জানিনা। আমার ভেতরে একটা ক্রাভিং আছে। বিজিতের আত্মীয় হবার কাংখা। কেউ যখন হেরে যেতে থাকে আমি তার পক্ষে থাকি। ক্রিকেটে আমি আফগানদের সাপোর্ট করি। কেনিয়াকেও করি। যে দল তুলনামূলক কম শক্তিশালী তাকে সাপোট করি। শক্তিশালী ক্রিকেটার দল জিতে গেলে তখন আমার হেরে যাওয়া দলটার জন্য খারাপ লাগে। সোহেলের নামটি খুব কমন। সোহেল রানা নায়কের নাম। বাংলা সিনেমার নায়কেরা অপরাধীদের ধরে পেটান। খুব ফাইট করেন। জাম্বু টাইপের গোটা দশেক কালপ্রিটকে সাঁই সাঁই করে লাথি দিয়ে উড়িয়ে দেন। তাদের হাসপাতালের ব্যান্ডেজ সবসময় কপালের একপাশে থাকে। সোহেলের নামটি কে রেখেছেন আমার জানা নেই। ওর মা, নাকি দাদী। বাবা বা দাদাভাই কিম্বা মামাও রাখতে পারেন। কে জানে হয়তো সোহেলের মায়ের প্রিয় নায়ক ছিলেন সোহেল রানা। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর সন্তান একদিন নায়কের মতোই কালপ্রিটদের হার্টের কাঁপুনি হবে। সেসব কিছু সোহেল হতে পারেনি। পারেনি বলেই আজ সোহেলকে আমার খুব আপন মনে হচ্ছে। ছোটভাই মনে হচ্ছে।
সোহেল হয়েছে কিছু একটা। ফেনীতে অপরাধীদের কাছে ত্রাস। আবার কিছুই হয়নি। প্রশাসন কাডারের সদস্য সংখ্যা পাঁচ হাজারের বেশী বোধ হয়। তন্মধ্যে একজন সোহেল। এমন কেউ নয়। সে গতরাতে (৮ মার্চ) মাদক ব্যবসায়ীদের একটা গ্যাংকে ধরতে গিয়ে কোপ খেয়েছে। খাঁটি দায়ের কোপ। ছোট বেলায় কামারদের আমি দায়ে ধার তুলতে দেখেছি। কুরবানীর ঈদের আগে গরু জবাইয়ের জন্য। সেই রকম দা দিয়েই কি ওরা সোহেলকে কুপিয়েছে! যারা কোপায় তাদের কেমন লাগে কী জানি! আর যারা কোপ খায়! আর যে মা-বাবার ছেলে কোপ খায় তার তাদেরই বা কেমন লাগে!
সিনেমার নায়কের মতো সোহেলের কপালে ব্যান্ডেজ পড়েনি। ব্যান্ডেজ পড়েছে শরীরের অনেক সংবেদনশীল জায়গায়। সে সাক্ষাতকারে বলেছে জীবন দিয়ে হলেও সে তার নিহত সহকর্মীকে বাঁচাতে পারলে খুশি হতো। সোহেলের সেই সহকর্মীর জন্য কষ্ট হচ্ছে। খোদা তাঁকে বেহেশতে নসীব করুক। কষ্টের তীব্রতাটা আছে। থেকে যায়। কতজন মারা যায় এমন। সবাইকে নিয়ে তো কী বোর্ডে ঝড় তুলিনা। আমরা এমন হায়। নিজেই অপরাধী।
আমার চাওয়া খুব সীমিত। অনেককিছু চাইতে পারিনা। রাষ্ট্রের কাছে কোন চাওয়া নেই। বড় বড় কথা লিখতে বুকের পাটা লাগে। আমার সেসব নেই।
সোহেল ভাইটি আমার! দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠো।
তোমার সুস্থতায় আবার তর্করা যোগ দিক। কবিতারা হাসুক। তুমি সুস্থ হও প্লিজ। মাফিয়া মাদকবাজদের কাছে তোমার হেরে যাওয়ার গল্প একদিন কবিতা হবে। হেরে যেতে যেতে একদিন তুমি কবিতা কিম্বা ধারালো দায়ের কোপের ছন্দে জিতে যাবে। দায়ের ধারটা ওরা তোমার শরীরে সংক্রমণ করেছে। সেই ধারে তুমি ধারালো হয়ে ওঠো।
লেখক: সহকারী কমিশনার (ভূমি), তারাগঞ্জ, রংপুর।







