হুসাইন আরমান ।
বর্তমান সময়ের সব চেয়ে আলোচিত ঘটনা কোটা সংস্কার আন্দোলন। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ আবার জেগে উঠেছে কোটা বৈষম্যের বিরুদ্ধে। ১৭৯১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিলো বৈষম্যমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা। এখন প্রশ্ন জাগে আমরা কি তা আজো পেরেছি। চাকরীর ক্ষেত্রে এদেশের মেধাবীরা যতটা বৈষম্যের শিকার হয় তা পৃথিবীর অন্য কোন দেশে হয় না। দেশের ৯৭.৩৭ শতাংশ মানুষের জন্য মাত্র ৪৪ শতাংশ আর ২.৬৩ শতাংশ মানুষের জন্য ৫৬ শতাংশ এটা কি ভাবা যায়! এ অদ্ভুদ কোটা পদ্ধতি পৃথিবীর আর কোন দেশে চালু নেই।
আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে দলিত সম্প্রদায়ের ১৫ বছরের জন্য কোটা বিদ্যমান। যুক্তরাষ্ট্রে ১০ বছর রেড ইন্ডিয়ানদের জন্য ২ শতাংশ কোটা সংরক্ষিত ছিলো। বাংলাদেশের মতো পৃথিবীর কোন দেশে কোটা চিরস্থায়ী নয়। বিবিএসের শ্রমশক্তি জরিপে বাংলাদেশে প্রকৃত বেকারের সংখ্যা ৪ কোটি ৮০ লাখ। দেশের বিশাল একটি অংশ বেকার থাকা সত্ত্বেও সরকার কোন যুক্তিতে কোটা সংস্কারের বিরোধিতা করছে তা বোধগম্য নয়। কোটা প্রথার কারণে শুধু মাত্র মেধাবীরা চাকরি বঞ্চিত হচ্ছেনা দেশেরও ক্ষতি হচ্ছে। কোটার মাধ্যমে অদক্ষ লোক সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অসীন হচ্ছে। এতে করে দেশের উন্নতি ব্যহত হচ্ছে এবং দূর্ণিতী বাড়ছে।
বাংলাদেশে প্রথম কোটা চালু হয় ১৯৭২ সালে। তখন মেধা কোটা ২০ শতাংশ, জেলা কোটা ৪০ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ ও নারী ১০ শতাংশ ছিলো। এরপর বিভিন্ন সময়ে সংস্কার হওয়ার মাধ্যমে কোটা বর্তমান অবস্থানে আসে। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৯(১), ২৯(১) ও ২৯(২) ধারায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ বলা আছে চাকুরির ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের সমান অধিকারের কথা। তাহলে কোটার মাধ্যমে সংবিধানকে অবমাননা করা হচ্ছে না? সংবিধানের সমুন্নত রাখতে যদি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সম্ভব হয় তাহলে কেন কোটা সংস্কার হবে না?
আজকে যখন ছাত্র সমাজ কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে সোচ্চার তখন অনেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের দোহাই দিচ্ছেন। কোটা সংস্কার করা হলে নাকি মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান করা হবে। অথচ, মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তানরাই বলছে কোটা সংস্কার সময়ের দাবী। এ আন্দোলনের সাথে তারাও একমত। এটিএন নিউজে ‘আমাদের কথা’ অনুষ্ঠানে এক মুক্তিযোদ্ধার মেয়ে বলেন, দেশকে মেধা শুন্য করে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান আমরা চাই না। আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা, আমি এটা বলতে গর্ববোধ করি। আমাদের মতো যারা কোটাধারী আছি সবাই এ আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত থাকবো। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পুলিশ কর্মকর্তা ফয়জুর রহমানের ছেলে ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল বলেছেন, কোটা প্রথা যৌক্তিক-স্বচ্ছ নয়। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাধারণ সম্পাদক সেলিম রেজা বলেছেন, প্রয়োজন হলে অবশ্যই সংস্কার করতে হবে। আমরা সংস্কারের বিপক্ষে নই। এ প্রয়োজন সরকার কখন বুঝবে সেটা দেখার বিষয়।
এদেশের মেধাবীরা যখন চাকুর না পেয়ে বিদেশীদের কাছে নিজের মেধাকে বিক্রি করে দিচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তানভীর রহমানের মত আরো হাজার হাজার ছাত্র আত্মহত্যা করেন। রাগে, ক্ষোভে, অপমানে হাজার হাজার মেধাবী বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে। সেদিনও হয়তো সরকার কোটা সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পারবো না। যারা বলছেন কোটা সংস্কার করলে মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান করা হবে তাদের কাছে প্রশ্ন- মুক্তিযোদ্ধারা কি স্বাধীনতার পর কোটা পাবেন বলে জীবন বাজী রেখে যুদ্ধ করেছেন? তাঁরা কি শুধু তাঁদের অধিকার অাদায়ের জন্য যুদ্ধ করেছেন? কোটাই যদি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত সম্মান হয় তাহলে সাতক্ষীরার মোহাম্মদ আলী, লাল মিয়া, মুক্তু মিয়াসহ যে সকল মুক্তিযোদ্ধা ভিক্ষা করে দিন কাটায় তাদেরকে কোন সম্মান দিচ্ছে?
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে বীর শ্রেষ্ঠ রুহুল আমীনের ছেলে শাখাওয়াত গ্রাম গঞ্জ থেকে পুরাতন জিনিসপত্র ক্রয় করে বিক্রি করে। কোটা তার কতটুকু উপকারে এসেছে। বীর প্রতিক হামিদুল হক যখন টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারেন না, মুক্তিযুদ্ধে স্বামী ও ৬ সন্তানদের হারানো মেহেরজান বিবিকে কোটা কতটুকু সম্মান দিতে পেরেছে এ প্রশ্নের জবাব কার কাছে পাবে দেশের সাধারণ মানুষ।
যে ভাষণকে বাঙালী জাতির মুক্তির সনদ বলা হয়, ৭ মার্চের সেই ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন- কেউ যদি ন্যায্য কথা বলে সে যদি সংখ্যায় একজনও হয় আমরা তা মেনে নেবো। বঙ্গবন্ধুর এ নীতি আমরা কতটুকু পালন করছি। আজকে যেখানে দেশের ৯৭ শতাংশ মানুষ চায় কোটা সংস্কার হোক তবে কোন কারণে এর বিরোধীতা? বিগত দিনগুলোতে এ আন্দোলন ছাত্রদের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকলেও পরবর্তীতে এটি শিক্ষক-বুদ্ধিজীবিরা একাত্মতা পোষণ করেন।
কোটা সংস্কার এখন সময়ের দাবী। সময়ের কাজ সময়ে করে সরকার জনগণের ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে দেবে এবং চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করবে এই আশা রাখি।
লেখক: প্রাণীবিদ্যা বিভাগ (৩য় বর্ষ), ফেনী সরকারী কলেজ।