গন্তব্য সীতাকুন্ড পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত চন্দ্রনাথ মন্দির ও গুলিয়া খালি সমুদ্র সৈকত। ঈদের ছুটিতে বাড়িতে এলো কলেজ লাইফের বন্ধু ইউনুছ, আশরাফ ও পুলিশ কর্মকর্তা বোরহান। শনিবার বিকালে আমরা চার বন্ধু আমার বাইকে করে অনেক ঘুরাঘুরি করার পর রাতে একটা চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে বসলাম। হঠাৎ বন্ধু বোরহান বলে উঠলো দূরে কোথাও থেকে ঘুরে আসা দরকার। সবাই বললো কোথায় যাওয়া যায়। এরপর ঠিক করা হলো গুলিয়া খালি সী বিচ যাওয়ার।
রবিবার সকালে আগের দিন রাতের সিদ্বান্ত অনুযায়ী ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে বাসা থেকে বের হয়ে পড়লাম। ফোন দিলাম একে একে সবাইকে। একসাথ হলাম মুহুরীগঞ্জ রেলস্টেশন’র সামনে। বন্ধু আশরাফ আসতে একটু দেরী হওয়ায় মিস করে ফেললাম ট্রেনটিও। এরপর বাসে না উঠে আমরা একটি পিকাপ ভ্যানের ড্রাইভারকে দাঁড় করিয়ে সবাই লাফ দিয়ে হইহুল্লোড় করে উঠে পড়লাম। আমাদের সাথে মুহুরীগঞ্জ বাজার থেকে যুক্ত হলেন কুয়েত প্রবাসী মইনুল ভাই। গাড়িটির পথচলা যখন শুরু হলো সবাই তখন গান আর আনন্দ উল্যাসে মেতে উঠলো। মইনুল ভাইয়ের গানের সুরে আমরা হারিয়ে গেলাম পাহাড়ি জনপদের প্রকৃতির মাঝে। প্রায় দেড় ঘন্টা পথচলার পর সকাল ১০ টায় পৌঁছলাম সীতাকু- বাজারে।
এরপর একে একে লাফ দিয়ে সবাই নেমে পড়লাম পিকাপ থেকে। চালককে ভাড়া দিয়ে হেটেই বাজারে গেলাম। এরপর স্থির করলাম আগে পাহাড়ের চূড়ায় চন্দ্রনাথ মন্দির যাবো। তারপর সেখান থেকে বিকাল বেলায় গুলিয়া খালি সমুদ্র সৈকত। কারন বিকালে জোয়ার পড়ে ভাটা হয়ে গেলে প্রকৃতির সৌন্দর্যটা উপভোগ করা যায়। যাইহোক! সীতাকু- বাজার থেকে একটা অটোরিকশা নিয়ে কলেজ রোড হয়ে একেবারে পাহাড় সংলগ্ন মন্দির এলাকার গেটে পৌঁছলাম।সেখানে গিয়ে দেখা যায় অনেকে সাইজ করা বাঁশের লাঠি নিয়ে উপরে উঠছে। কারন পাহাড়টি অনেক খাঁড়া এবং উঁচু। অসাবধানতা বশত যেকোন মহূর্তে দূর্ঘটনায় নিচে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। ওই সময় বাঁশের লাঠিই একমাত্র ভরসা হবে। এরপর এক দোকানী থেকে টাকা দিয়ে তিনটে লাঠি নিয়ে শুরু করলাম পাহাড়ের চূড়ায় উঠার পথচলা। গেট পেরিয়ে উপরে উঠতেই চোখে পড়লো বাম পাশে হনুমানজীর মন্দির আর ডান পাশে সীতা মন্দির, রাম, সীতা ও লক্ষনের স্নান করার কু-। ধারণা করা হয় সীতার স্নান করার কু- থেকে এই জায়গার নামকরণ করা হয়েছে সীতাকু-।
আরেকটু পথ পেরুতেই চোখে পড়লো বড় একটি মন্দির। এখানেই মূল পূঁজা হয়। যারা উপরে উঠতে পারেনা, তারা এখানেই এসে পূঁজা দিয়ে চলে যায়। কাঁদাময় পথে কিছুদূর যাওয়ার পর বন্ধু ইউনুছ ও আশরাফ থেমে গেলো। তারা উপরে আর উঠতে পারছেনা। সিদ্বান্ত হলো তারা দুজন আর উপরে যাবেনা। কি আর করা! আমরা তিনজন আমি বোরহান ও মইনুল ভাই উপরে উঠতে শুরু করলাম। অনেক ভ্রমনার্থী হাতে লাঠির উপর ভর করে উঠানামা করছে। কিছুক্ষণ সামনে এগোনোর পর চোখে পড়লো পাহাড়ের উপর থেকে সুপ্ত ধারায় অবিরাম পড়ছে পাহাড়ি ঝরনা। সেখানে কিছু যুবক পাহাড়ি ঠান্ডা জলে হইহুল্লোড়ে মেতে উঠেছে।
পথিমধ্যে উপরে উঠার সময় কয়েকবার নিজেদেরকে জিরিয়ে নিলাম। কারন কিছুদূর উপরে উঠলে হাপাতে হাপাতে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। যদিওবা উপরে উঠতে অনেক কষ্ট। তারমধ্যে বর্ষাকালে পাহাড় অনেক পিচ্ছিল থাকে। প্রায় দুই ঘন্টা হাটার পর অবশেষে গিয়ে পৌঁছলাম চন্দ্রনাথ মন্দিরের বাম পাশে অবস্থিত বিরুপাক্ষ মন্দির। মন্দিরের সামনে একজন পুরোহিত ধ্যান করা অবস্থায় বসে আছে। কিছুক্ষণ পর পর তিনি মন্দিরের ভিতরে প্রবেশ করে পূঁজো দিয়ে বের হওয়ার সময় ঘন্টি বাজান। ভিতরে আগরবাত্তি, জালানো মোমবাতি ও একটি টাকা পয়সা দেওয়ার দান বাক্স দেখা গেলো। সেখানে কথা হলো মন্দিরের পুরোহিত আটত্রিশ বছর বয়সী অশুক চক্রবর্তীর সাথে। নতুন ফেনী’র এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, চন্দ্রনাথ পাহাড়ের উপরে চন্দ্র ও বিরুপাক্ষ মন্দির। এটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১২’শ ফুট উপরে অবস্থিত। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের এই মন্দিরে প্রতিবছর বাংলা ফাল্গুন মাসে শিবরাত্রির বিশেষ পূজা হয়। এই পূজাকে কেন্দ্র করে সীতাকুন্ড চন্দ্রনাথ পাহাড় এলাকায় বসবাসকারী হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা এখানে বড় ধরনের একটি মেলার আয়োজন করে থাকে। এই মেলায় বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অসংখ্য সাধু এবং নারী-পুরুষ যোগদান করেন। যেটি শিবর্তুদর্শী মেলা নামে পরিচিত। অশুক চক্রবর্তী বলেন, তিনি এই বিরুপাক্ষ মন্দিরে দীর্ঘ ৯ বছর যাবৎ পুরোহিতের কাজ করেন। প্রতিনিয়ত অনেক তীর্থযাত্রী মন্দিরে মানত করে মোমবাতি প্রজ্জলন করে টাকা পয়সা দিয়ে পুঁজো করে বটবৃক্ষে লাল রশি বেঁধে দিয়ে যান।
মিরসরাই থেকে মন্দিরে পুঁজো দিতে আসা হিমাংক রানী দেবী নামের এক ভক্ত বলেন, পরিবারের মঙ্গল কামনা ও সুখ শান্তি আরো বৃদ্ধির জন্য শিব ঠাকুরের নামে মানত করে এখানে পুঁজা দিতে এসেছি। এখানে শত বছর বয়সী এই বট বৃক্ষের গোড়ায় একটি লাল ফিতা বেঁধেছি। যাতে আমার মনের সকল আশা পূরন হয়। উপর থেকে নিচের দিকে তাকালেই দেখা যায় মানুষগুলোকে পিঁপড়ার মত মনে হচ্ছে।
ফেনী থেকে চট্টগ্রাম যাচ্ছে একটি ট্রেন। সেটাও খুব ছোট, দেখে মনে হচ্ছে এক ফিট লম্বা একটি খেলনার ট্রেন যাচ্ছে। কষ্ট হলেও চারিদিকের সবুজে ঘেরা পাহাড়টি অনেক সুন্দর। যেকোন ভ্রমণ পিয়াসু মানুষের মনকে আকৃষ্ট করে তুলবে। এরপর সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার পর এবার নিচে নামার পালা। কিছুদূর নিচে নামার পর হঠাৎ শুরু হলো বৃষ্টি। বৃষ্টি শেষ হয়ে গেলে দেখলাম পাহাড় থেকে মেঘগুলো উড়ে এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি করছে। পিচ্ছিল পাহাড়ি রাস্তায় নিজেকে কোন রকমে বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচাতে পাহাড়ের পাড় ঘেঁষে একটু দাঁড়ালাম।
এরপর শুরু করলাম পথচলা। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বাঁশের লাঠির উপর ভর করে নিচে নেমে এলাম। ততক্ষনে ঠিক দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেলো। আবার সিএনজি করে বাজারে এসে দুপুরে খাবার খেয়ে আরেকটা সিএনজি নিয়ে রওয়ানা হলাম গুলিয়া খালি বীচের দিকে। সীতাকু- বাজার থেকে ৬ কিলোমিটার পথচলার পর পৌঁছলাম প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি গুলিয়া খালি সমুদ্র সৈকত। সেখান থেকে একটা নৌকার বোটে করে সমুদ্র বীচে গেলাম। স্থানীয় মানুষের কাছে এই সৈকত মুরাদপুর বীচ নামে পরিচিত। অনিন্দ্য সুন্দর গুলিয়াখালি সী বিচ কে সাজাতে প্রকৃতি কোন কার্পন্য করেনি। একদিকে দিগন্তজোড়া সাগর জলরাশি। আর অন্য দিকে কেওড়া বন এই সাগর সৈকতকে করেছে আরো অনন্য। কেওড়া বনের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া খালের চারিদিকে কেওড়া গাছের শ্বাসমূল লক্ষ করা যায়। এই বন সমুদ্রের অনেকটা ভেতর পর্যন্ত চলে গেছে।
এখানে পাওয়া যাবে সোয়াম্প ফরেস্ট ও ম্যানগ্রোভ বনের মত পরিবেশ। গুলিয়াখালি সৈকতকে ভিন্নতা দিয়েছে সবুজ গালিচার বিস্তৃত ঘাস। সাগরের পাশে সবুজ ঘাসের উন্মুক্ত প্রান্তর আমাদের চোখ জুড়িয়েছে। বীচের পাশে সবুজ ঘাসের এই মাঠে প্রাকৃতিক ভাবেই জেগে উঠেছে আঁকা বাঁকা নালা। এইসব নালায় জোয়ারের সময় পানি ভরে উঠে। নৌকার বোট থেকে নেমে সবাই আনন্দ উল্যাসে মেতে উঠলাম। কেউ দক্ষিণা হাওয়ায় উন্মাদ হয়ে সবুজের সাথে সখ্যতা করে সেলপিতে ব্যস্ত, আর কেউবা সাগরের জলে নিজের গা ভাসাতে বীচে নেমে গেলো। সাগরের জোয়ার শেষে ভাটা হয়ে গেলে অনেকে ফুটবল নিয়ে খেলাতে মেতে উঠেছে। আবার অনেকে সাগরের জলরাশির মধ্যে হইহুল্লোড়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
এরমধ্যে অনেক জেলে জীবিকা নির্বাহের তাগিদে ছুটে যাচ্ছে সাগরে মাছ ধরতে। সেখানে কিছুটা সময় পার করার পর গৌধুলীময় বিকেল আর মনোমুগ্ধকর সূর্যস্নাত সন্ধ্যাটা উপভোগ শেষে সবাই ফিরে এলাম আপন নীড়ে…
সম্পাদনা: আরএইচ/এমকেএইচ