মোহাম্মদ এনামুল হক একজন মহৎ হৃদয়ের অধিকারী। সাদা মনের মানুষ। সবাইকে কাদিয়ে নীরবে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তার সুন্দর দেহটির মধ্যে লুকানো ছিল একটা বিশাল হৃদয় আর স্বচ্ছ-পরিচ্ছন্ন মন। এই মনটিকে সারাটি জীবন ব্যবহার করেছেন শিক্ষার প্রদীপ জ্বালিয়ে মানুষকে আলোকিত করে মানুষের কল্যাণ সাধনের জন্য। তার চিন্তা-চেতনায় ছিল কিভাবে মানুষকে শিক্ষা-দীক্ষায় এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। সেই চিন্তা চেতনার প্রতিফলন হিসেবে কাজ করে গেছেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।
তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মার্ষ্টার্স (স্নাতকত্তোর) ডিগ্রী অর্জন করে আবহাওয়া অধিদপ্তরে যোগদান করেন। সরকারী চাকুরীর সুযোগ সুবিধা ছেড়ে দিয়ে লন্ডনখ্যাত সিলেট শহরের চাকচিক্যপূর্ণ জীবন বাদ দিয়ে পিতা-মাতার খেদমত করার মানসিকতায় শেকডের টানে ফিরে আসেন নিজ গ্রামের বাড়ি সোনাগাজী উপজেলার মতিগঞ্জ ইউনিয়নের পালগিরী গ্রামে। গ্রামে এসে নিকর্টবর্তী প্রতিষ্ঠান মঙ্গলকান্দি বহুমুখি উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষকতা শুরু করেন। উপজেলা প্রশাসনের অনুরোধে সোনাগাজী সরকারী মোহাম্মদ ছাবের পাইলট হাই স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। নারী শিক্ষাকে অগ্রিয়ে নেওয়ার জন্য পরবর্তীতে যোগদান করেন সোনাগাজী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। ইংরেজী শিক্ষকের স্বল্পতার কারণে একটি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করার পাশাপাশি তাকে নিকর্টবর্তী প্রতিষ্ঠান সমূহ আল হেলাল একাডেমী সোনাগাজী, সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাযিল (ডিগ্রী) মাদ্রাসা, সোনাগাজী সরকারী ডিগ্রী কলেজে পাঠদান করতেন। কয়েকটি বিদ্যালয়ের শত শত গরীব ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশুনার সহযোগীতা করার জন্য হাত বাড়িয়ে দেন। বিনা-বেতনে, অল্প বেতন ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াতেন নিজ বাড়িতে।
প্রকৃত শিক্ষক ছাত্রের কাছে পিতারই প্রতিচ্ছবি। সব শিক্ষক কিংবা পিতা আবার অভিভাবক হতে পারে না। স্যার ছিলেন একজন প্রকৃত শিক্ষক ও অভিভাবক। যা শুধু নিজের প্রতিষ্ঠান বা পরিবারের জন্য নয়। নয় তার ঘনিষ্ঠজনদের। তার প্রতিবেশী এবং এলাকার মানুষের জন্য নিবেদিত ছিল। ছাত্রদের অভিযোগ, অনুনয়, অভিমান ক্ষোভ-হতাশা, দু:খ-বেদনা সবকিছু মনোযোগ দিয়ে শুনতেন অভিভাবক তুল্য সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক এনামুল হক স্যার।
শিক্ষক-ছাত্রের মধ্যে যে মধুর সম্পর্ক বিদ্যামান সেটা স্যারের জীবন থেকে শিক্ষনীয়। তিনি ক্লাসে ছাত্রদের সামনে ইংরেজী ভাষার মত এত কঠিন ও জটিল বিষয়কে অত্যান্ত সহজ ও সাবলীল ভাবে প্রাণবন্ত করে তুলতেন। তিনি তার শিক্ষক জীবনে ক্লাসে বেত নিয়ে গেছেন অথবা ছাত্রদেরকে শারীরিক শাস্তি দিয়েছেন সেই রকম উদাহরণ বা দৃষ্টান্ত আমরা কখনও পাইনি।
একজন জন্মদাতা বাবা হিসেবে তিনি আমাদেরকে শারীরিক শাস্তি দিয়েছেন তা আমাদের মনে পড়ে না। তিনি ছিলেন ভদ্র-শিষ্ঠ এবং মর্জিত আচরণের মানুষ। তিনি কখনো কারো সাথে উচ্চবাক্যে কথা বলতেন না। কারো সাথে রুঢ বা কর্কশ ভাষায় কথা বলতেন না। যার দৃর্ষ্টান্ত প্রমাণ হল শত-শত মানুষের জানাযায় উপস্থিতি।
বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস, অবিরাম ৫দিনের আষাঢ়ের বৃষ্টি, অজপাড়া গাঁয়ের কর্দমাক্ত মাটি গভীর রাত্রিতে অনুষ্ঠিত জানাযায় শত-শত মানুষের উপস্থিতি প্রমাণ করে তিনি মানুষের মধ্যমণি ছিলেন। তার মৃত্যুর পর মানুষ আজো তার পৈতিক বাড়িতে আসেন কবর জিয়ারত করার জন্য। তিনি শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা শিক্ষা বিস্তারে কাজ করেন নি। তিনি নিজ হাতে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মসজিদ মাদরাসা মক্তব প্রতিষ্ঠা করেন। এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এগুলোর খেদমত করেন।
মানুষ মরণশীল শ্বাশত এই সত্যের মাঝেও তার কর্ম তাকে আজো বাঁচিয়ে রাখবে লাখ-লাখ মানুষের মাঝে। তার চিন্তা-চেতনা ধ্যান-ধারনায় ছিল সমাজ দেশ জাতি তথা সাধারণ মানুষ। নির্ভীকচিত্ত, বিশাল হৃদয় বিশিষ্ট এই সাদা মনের মানুষটি গত ২২ শে জুলাই বুধবার দুপুর ১২ঘটিকার সময় ঢাকাস্থ শহীদ সরওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। ওই দিনই রাত দশটায় জানাযার নামাজ শেষে তাঁর পৈতিক বাড়ীতে পিতা-মাতার কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।
লেখক: সহকারী শিক্ষক (ইংরেজী), মীর্জানগর তৌহিদ একাডেমী, পরশুরাম, ফেনী।