সমুদ্র সৈকত কথাটি মুখে আনলেই যেই দৃশ্যটি চোখের সামনে ভেসে উঠে তা হলো নীল জলরাশি, উত্তাল ঢেউ আর বালির সাম্রাজ্য। কিন্তু গুলিয়াখালী সৈকত ভিন্নরূপে সজিয়েছে নিজেকে। সবুজ ঘাসের চাদরে মোড়া স্তুপগুলো খেলে মনে হয় যেন যেন বিন্দু বিন্দু সবুজ দ্বীপ । একসাথে সবুজ আর সমুদ্রের মিলন কেবল গুলিয়াখালীতেই দেখা যায়। প্রথম দেখাতে দূর থেকে মনে হতে পারে কোন গলফ খেলার মাঠ। সোয়াম্প ফরেস্ট আর ম্যানগ্রোভ বনের অপূর্ব সমন্বয় কেবল এখানেই দেখা যায়। জোয়ারের পানি বেশি থাকলে রাতাগুলের অনুভূতি আর পানি নেমে গেলে কেওড়া বনের শ্বাসমূল আর আঁকাবাকা পানির নালা দেখলে সুন্দর বনের দৃশ্য মনে পড়ে যায়।
ফেনী সরকারি কলেজ প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সিনিয়র-জুনিয়ররা মিলে গিয়েছিলাম সহস্র-২ ও গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত দেখতে। বাড়ির কাছে হলেও আগে কখনো যাওয়া হয়নি। সকালে ফেনী থেকে রওনা দিই। ১১ থেকে ১টা পর্যন্ত ঝর্ণাতে সময় কাটিয়ে দুপুরে সীতাকুন্ড বাজারে দুপুরের ভোজন শেষ করি। খাবার টেবিলে ঘটে এক অবাক কান্ড। সবাই খাওয়ার পর আমি আর বিভাগের ছোট ভাই মামুন খেতে বসি। সে একাই ১২ পিস লেবু খেয়ে সাবাড় করে পেলে। সেই থেকে তার নাম এখন লেবু মামুন।

ছবি- সালমান চৌধুরী
যাই হোক ভোজন শেষ করে গন্তব্য গুলিয়াখালীর উদ্দেশ্য যাত্রা করি ।বাজার থেকে বাস গুলিয়াখালীর সৈকতে যায়না তাই সিএনজি ভাড়া করতে হয়। প্রায় ২০ মিনিটের মধ্য পৌছে যাই । কিন্তু সিএনজি থেকে নেমে জোয়ারের পানি দেখে হতাশ আমরা । ভেবেছি এত পানি নামতে নামতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে কিন্তু না ২০ মিনিটের মধ্য সব পানিয়া হাওয়া। সেই সময়ে আমরা বাঁধের পাড়ে বসে গানের আসর জমিয়েছিলাম। আসর জমে উঠেছিলো ঠিক এই সময়ে পানি নেমে গিয়েছে তাই গানের আসর রেখে সবাই সমুদ্রের আসরে পাড়ি জমালো। অবশ্য পানি থাকাকালীন খাল দিয়ে ইঞ্জিন চালিত নৌকা করে সৈকতে যাওয়া যায় ৩০ টাকা ভাড়া। আমরা হেটেই গিয়েছিলাম । হেটে না গিয়ে ইঞ্জিনচালিত নৌকা করে গেল কষ্ট অনেকটা কমে যাবে।
মাটি খুবই পিচ্ছিল আর কাদায় ভরা ছিলো পা পেলা খুব কষ্টকর । খুব সাবধানে পা পেলতে হয় একটু বেখেয়াল হলে যে কোন সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। যাওয়ার পথে অসংখ্য মরা সাপের বাচ্ছা দেখলাম। সাপ দেখলেই সেটাকে পর্যটকরা মেরে পেলছে। এ ব্যাপারে সচেতনতা তৈরী করা প্রয়োজন। প্রাণিবিদ্যার শিক্ষার্থী হিসেবে সাপ মরে পড়ে থাকার দৃশ্য দেখে ব্যাথিত হলাম।

ছবি- সালমান চৌধুরী
সবুজ সৈকতের বিভিন্ন জায়গায় গোলবার দিয়ে পর্যটকরা ফুটবল খেলছে। এ দেখে মনে পড়ে গেলো শৈশবের কথা। কাদা মাটিতে ফুটবল খেলে, গড়াগড়ি খেয়ে ঝাঁপ দিতাম পুকুরে। মিনিটি দশেক হাটার পর কাদা মাটি পেরিয়ে পা দিলাম সবুজ গালিচায়। সে এক অন্য রকম অনুভূতি মনে হচ্ছে সুইজারল্যান্ডের কোন সবুজ গ্রামে এসেছি। প্রথমবার এখানে যে কেউি আসলে সৈকতের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হবে। মনের অজান্তেই মুখ থেকে বের হবে ওয়াও! জোয়ারের পানি নামতে নামতে সৈকত জুড়ে অসংখ্য ছোট ছোট নালা তৈরী হয়েছে। নালা গুলো জালের মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থেকে ছোট ছোট মাটির স্তুপগুলো সবুজ দ্বীপের আকার ধারণ করছে। অনেকেই আবার গর্তে জমে থাকা পানিতে শুয়ে বাথটাবের স্বাদ নিচ্ছে। আমাদের সাথের কয়েকজন বাথটাবে নেমে ছবিও তুলে নিলো। এক জায়গায় ব্যাগগুলো রেখেই শুরু হলো ছবি তোলা ।

প্রাকৃতিক বাথটাবে গোসল, বাঁধের পাড়ে গানের আসর, সমুদ্র স্নান
আমাদের মধ্য একদল নেমে পড়লো ফুটবল নিয়ে । বাকীরা এই অপরূপ দৃশ্যর সাথে নিজেকে আবদ্ধ করতে ব্যাস্ত। নানান আঙ্গিকে প্রকৃতির সাথে নিজেকে ক্যামেরার ফ্রেমে বেঁধে রাখতে মগ্ন মেয়েরা কেউবা আবার শাড়ি পড়েও ফটোশ্যুট করছে। আমিও ছবি তুলছি আর হেঁটে হেঁটে দেখছি সৈকতের অপরূপ শোভা। সৈকতের সৌন্দর্য বহুগুন বাড়িয়ে দিয়েছে কেওড়া গাছগুলো। পুরো সৈকতজুড়ে একটু পর পর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কেওড়া গাছ । তবে এর শ্বাসমূল গুলো খুবই বিপদজনক হাটার সময় খেয়াল রাখতে হয়।

ছবি- সালমান চৌধুরী
সৈকতে গড়ে উঠেছে অনেকগুলো অস্থায়ী দোকান । দোকানগুলো অনেকটা হাফপ্যান্ট পরার মত । নিচের অংশ জোয়ার আসলে ডুবে থাকে বলে সেই অংশ খালি রেখে উপরের অংশে মাচাং বানিয়ে বসার ব্যাবস্থা করা হয়েছে। তবে একটি বিষয় উদ্বেগজনক সৈকতে নেই কোন আবজর্না পেলার সুষ্ঠু ব্যাবস্থাপনা। পর্যটকরা যেখানে সেখানে ময়লা পেলে সৈকতের সৌন্দর্য নষ্ট এবং পরিবেশের ক্ষতি করছে। এই ব্যাপারে যথায কর্তপক্ষে দৃষ্টি দিতে হবে। আমরা একটা দোকানের বাইরে টেবিলে বসে চা, বিস্কিট খেলাম। সমুদ্র আর সবুজের মিলনমেলায় বসে চা খাওয়ার ভাবটা অন্যরকম। গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকতের ঢেউগুলো ছোট হওয়ায় পর্যটকরা সমুদ্রে নামার চেয়ে উপরেই বেশি সময় কাটায়। বাঁধ থেকে সৈকত পর্যন্ত একটি রাস্তা বা সাঁকো তৈরী করলে পর্যটকরা আরামদায়কভাবে ভ্রমন করতে পারবে। কোন দুর্ঘটনা ঘটার আশংকাও থাকবেনা।

ছবি- সালমান চৌধুরী
সমুদ্র দর্শনে করতে করতে কখন যে মাগরিবের আযান পড়ে গেলো খেয়াল করিনি এতই মুগ্ধ হয়েছি যে ফিরতে আর মন চাইছেনা। আসার সময় সীতাকুন্ড বাজার থেকে সৈকত পর্যন্ত ভাড়া ৩০ টাকা নিলেও এখন সেটা ৫০ টাকা হয়ে গেছে এবং অন্ধকার হওয়ার সাথে সাথে ভাড়া বেড়ে জনপ্রতি ১০০ টাকা পর্যন্ত হয়। রাস্তা সংকীর্ণ হওয়ায় ফেরার সময় লম্বা জ্যামের সৃষ্টি হয়। এ বিষয়গুলো প্রতি প্রশাসন নজর দিলে পর্যটকের সংখ্যা বাড়বে এবং ভোগান্তিও কমবে।
সম্পাদনা:আরএইচ/এইচআর







