ছোটগল্প ‘অসহায়ত্ব‘
~মাহবুবা আক্তার স্মৃতি
উঠানে অস্থিরভাবে পায়চারি করছে হোসেন মিয়া। ভেতর থেকে সাফিয়ার কান্না ভেসে আসছে। কিন্তু সে আরেকটি কান্না শোনার জন্য মরিয়া হয়ে আছে, কিছুটা ভয়েও তাকে পেয়ে বসেছে। যদি তার ইচ্ছেটা পূরণ না হয়, যদি দেখে..কিছুক্ষণ পরেই বাচ্চার চিৎকার শোনা গেল। দাঈ এসে জানালো,
-হোসেন মিয়া, তোর একখান চান্দের লাহাইন ফুটফুটে মাইয়া হইছে।
মনে হলো, হোসেনের মাথায় কেউ ভারী বস্তু দিয়ে আঘাত করেছে।
-কও কি তুমি! এট্টু বালা কইরা দেইখ্যা কওনা খালা….কেমন ১টা মিনতি ঝরে পড়লো।
-আমি দেইখ্যাই কইছি, তোর মাইয়া হইছে।
হোসেন স্তব্ধ হয়ে দাওয়ায় বসে রইলো কিছুক্ষণ, সে কিছু ভাবতে পারছে না। একটু পর পর আকাশের দিকে তাকাচ্ছে, আর অস্ফুট সুরে বিলাপ করছে, “আল্লাহ, তুমি এইডা কি করলা,আবার বুঝি আমাগোর বুকে ছুরি বসাইবা, আল্লাগো…ঠুঁকরে কেঁদে উঠলো হোসেন।
-ঐ, না কাইন্দা, বউ আর বাচ্চার কাছে যা।
হোসেন ধীরে ধীরে ঘরের ভেতর গেল। গিয়ে দেখে, সত্যিই চাঁদের মতো ফুটফুটে একটা মেয়ে তার ঘরে জন্ম নিয়েছে। হঠাৎ কি মনে পড়তেই মেয়েকে কোলে তুলে কাঁদতে লাগলো…
-মাগো, তুমি ক্যান আইছো এই ঘরে। এই সমাজ, এই গাঁয়ের মানুষ তোমারে বালাভাবে বাঁচবার দিবো না। এইবলে আবারও কেঁদে উঠলো হোসেন মিয়া।
-কাইন্দো না আদুরীর বাপ, আল্লায় নারাজ হইবো, মাইয়ায় ওতো বড় হইয়া হুনলে কষ্ট পাইবো, তুমি কাইন্দো না।
-কান্দি কি আর সাধে?তুমি ভুইল্যা গেছো, আমাগোর আদুরীর সাথে কি হইছিল? কি সুন্দর মাইয়া ছিল আমার। ভাবছিলাম, মাইয়াডারে অনেক পড়ালেহা করামো। কিন্তু…
হোসেন আবারও কেঁদে উঠলো।
সাফিয়ার বুকেও কেন যেন আঘাত করলো। মনে পড়লো, কি সুন্দর মেয়ে ছিল তাদের…
আদুরি, বয়স ছিল নয় কি দশ, আর কোনো ছেলেমেয়ে হয়নি তাদের তখনো, অবশ্য সাফিয়া তখন ৩-৪মাসের পোয়াতি। সেদিন ছিল শুক্রবার, দুপুরের প্রায় কাছাকাছি । বাড়িতেই খেলছিল সে। হোসেন ক্ষেতে আর সাফিয়া গেছিল কিছু খড়ি যোগার আর চাল কিনে আনতে। যাবার আগে বলে গেছে–
-হুন, আমি কিছু খড়ি টোকাইয়া নিয়া আসি, ভাত রান্ধার মতোও কিচ্ছু নাই, দেহি গিয়া, তুই কিন্তু বাড়ি থাইক্যা কোনো দিক যাইস না।
-আইচ্ছা মা, তুমি দেখবা আমি ঘরেই আছি।
এই বলে, সাফিয়া চলে গেল।
হোসেনের কেন জানি কাজে মন দিতে পারছে না, শরীরটাও যেন তার কেমন লাগছে। সঙ্গে থাকা মজনুরে ডেকে বলল,”মজনু শরীরটা বড় বেমার মনে হইতাছে। বাড়ি যাই, যদি বাল্ লাগে, ঐবেলা আসুম নে..
-আইচ্ছা চাচা…
হোসেন বাড়িতে এসে দেখে সব কেমন চুপচাপ, কাউকেই দেখতে পেলো না। হঠাৎ ঘর থেকে আদুরীর চিৎকার শোনা গেল। দৌড়ে হোসেন গেলেন, ঘরে গিয়ে দেখে ২যুবক আর এলাকার মাতবরের ভাতিজা তার ছোট্ট মেয়েটাকে ধর্ষন করার চেষ্টা করছে, আদুরি চিৎকার করে কান্না করে তার বাবা-মাকেই ডাকছে, কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলেন, তাড়াতাড়ি হাতের কাছে যা ছিল তাই দিয়ে এলোপাতাড়ি মারতে লাগলো। দুই যুবক আর মাতবরের ভাতিজা দেখলো যে, মানু্ষ জানাজানি হয়ে যেতে পারে। তাই অগত্যা চলে গেল, যাবার সময় থ্রেট দিয়ে গেল যে,”কাউরে কইলে কিনতু বালা হইব না..”
হোসেন দৌঁড়ে মেয়ের কাছে যায়, তারপর মেয়েকে নিয়ে মাতবরের বাড়ি যায়। বলা হল, আগামিকাল সালিশ বসবে, তখন দেখা যাইবো…
সালিশ বসে, মাতবরের ভাতিজা সরাসরি অস্বীকার করে বলে যে,”চাচা, আমি কিচ্ছু করি নাই, হ এইডা ঠিক যে কাইল আমি হোসেন মিয়ার বাড়ি গেছিলাম,আসলে রাস্তা দিয়া যাবার সময় দেহি, হোসেন চাচার মাইয়া কান্না করতে ছিল, গরম পানি কয়েক জায়গায় ছিট্টা পড়ছে, দেহো (রনি, গতকাল যে ওরা আদুরির সাথে জোর করতে গিয়ে আদুরির হাতে, গলায় খামচে দিয়েছে,ওইগুলাই ইশারায় দেখালো)… তোরা কি কস? আমি কি ভুল কইছি? সাথে থাকা ২জন সাথে সাথে বললো,”হ চাচা, রনি ঠিক কইছো। শুধু শুধু হোসেন মিয়া আমাগোর নামে মিথ্যা দোষারোপ দিতাছে..
-না, কাইলকা, ওই লোকগুলোই আমারে খামচে দিছে.. ভয়ে ভয়ে কাঁদু গলায় বললো আদুরি।
-মাইয়া মানু,অতো কথা কও ক্যা?বেহায়া।লজ্জা শরম কিছু রাখবার লাগে।হোসেন,তুমি তো দেহি মাইয়ারে কিচ্ছু শিখাও নাই।আর তোমার কাছেও এইডা আশা করি নাই। টেকা দরকার,ধার নিবা, তাই বইল্যা মাইয়ারে নিয়া…ছি, ছি…
অপমান আর গঞ্জনা নিয়ে হোসেন তার মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরলো। বাড়ি এসে মেয়েকে ঘরে পাঠিয়ে একেবারে চুপ করে বসে থাকে। সাফিয়া দৌড়ে আসে স্বামীর কাছে, জিগ্যেস করে,কিগো, বিচার কি হইলো? রনিরে সাজা দিছে তো? হোসেন কোনো কথা বলে না।
-কিগো, কওনা ক্যান কিছু?
হোসেন এর পর কেঁদে ফেলে। নাগো, গরিবের বিচার নাই। উল্টা আরো আমারে শুনাই দিছে, আমি নাকি অভাবে পইড়া মাইয়া নিয়া ব্যবসায় নামছি..
কি কও তুমি! আল্লায় এই অন্যায়ের বিচার করবো, তুমি ঘরে আহো।
ঐদিন রাতেই প্রায় ১০-১১টার দিকে হোসেন আর সাফিয়া দেখে ৪-৫জন লোক তাদের ঘরে, ঐ ক্যাডা তোমরা, কি চাও?
সাথে সাথে ওদের আঘাত করে হাত-পা বেঁধে ফেললো।
হঠাৎ ১টি গলা বলে উঠলো, তোরে কই ছিলাম না, কাউরে না জানাইতে, আমার চাচার কাছে গিয়া নালিশ করছ? দেখ এইবার..
হোসেন আর সাফিয়ার বুঝতে বাকি নাই, ওরা কারা। এদিকে আদুরি ভয়ে কুঁকড়ে আছে।
এরপর ৪-৫জন ছেলে ধীরে ধীরে মেয়ের দিকে এগোতে থাকে,প্রথমে রনি, এরপর বাকি সবাই মেয়েটাকে যেন ছিড়ে ছিড়ে খেতে লাগলো, আদুরি চিৎকার করে কাঁদছে, হোসেন তার বউ কান্না করছে, আর মিনতি করছে,”তোমরা আমাগো মাইয়াডারে ছাইরা দাও বাবারা, আল্লাগো…তুমি আমার মাইয়াডারে বাঁচাও। আশে পাশের কেউ এগিয়ে আসেনি ভয়ে। এদিকে আদুরির কান্না থেমে যায়, নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকার পরও চলে পালাক্রমে ধর্ষণের লীলা। এর পর তারা চলে যায় নানারকম হুমকি দিয়ে।
রনি আর তার দল চলে যায়। এসময় হোসেনের এক প্রতিবেশি নাজমুল, রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল, দেখে যে ৪-৫জন মুখোশধারী লোক হোসেনের বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। হঠাৎ হোসের আর হোসেনের বউয়ের কান্নার শব্দ শুনে তাড়াতাড়ি গেল। গিয়ে দেখে, তাদের কি অবস্থা। হাত -পায়ের বাঁধন খুলে দেয়। দেখে যে, মেয়েটা রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে, সারা শরীরেই রক্ত,খামছির দাগ, বস্ত্রহীন। তাড়াতাড়ি ওকে নিয়ে হাসপাতাল গেল,ততোক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে। আদুরি মারা গেছে।
মাতবরের কানে বিষয়টা গেলে হোসেনকে বলে যে, সালিশ ডাইক্যা লাভ নাই, তুমি যদি এই সমাজে থাকবার চাও,
তাইলে চুপ কইরা থাকাই বালা অইবো। হোসেন অশ্রুসিক্ত আর ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বাড়ি ফেরে।
এই হল আসল ঘটনা, সাফিয়া মনে করতেই হোসেনের কোল থেকে মেয়েকে নিয়ে বলে যে, আমার এই মাইয়ার লগে এমুন হইতে দেয়া যাইবো না। চলো আদুরির বাপ, আমরা এই গ্রাম থাইক্যা চইল্যা যাই। হোসেন সাথে সাথেই রাজি হয়।
পরেরদিন তারা গ্রাম ছেড়ে পাড়ি জমায় অন্য ১টি গ্রাম কিংবা শহরে, যেখানে হয়তো সদ্য জন্ম নেয়া মেয়েটার একটু নিরাপদ আশ্রয় দিতে পারবে। কিন্তু আদৌ কি পারবে?